নীলগঞ্জে শনিবারে হাট বসে। সেই হাটে মতি মিয়ার সঙ্গে নইম মাঝির হঠাৎ দেখা। নইম মাঝি বেশ কিছুক্ষণ চিনতেই পারে নি। হাত পা ফোলা-ফোলা। মাথার সেই কোঁকড়ান বাবড়ি চুল নেই। মুখভর্তি দাড়ি। খালি গায়ে একটা চায়ের স্টলের সামনে চুপচাপ বসে আছে।
কেডা, মতি ভাই না?
মতি মিয়া মুখ ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, নইম বালা আছ?
ও মতি ভাই, তুমি এইখানে করডা কী?
চা খাইলাম। বালা চা বানায়।
শইলা খারাপ নাকি মতি ভাই? তুমি না শম্ভুগঞ্জে আছিলা?
যাত্রার চাকরিডা নাই।
কর কী তুমি অখন?
করি না কিছু। গান বান্দি।
বাড়িত যাই না? লও আমার সাথে, নাও লইয়া আইছি।
না।
অখন যাইতা না তোত কোন সময় যাইবা?
অখন এটু অসুবিধা আছে।
কি অসুবিধা, বাড়িতে বেহেই চিন্তা করতাছে।
মতি মিয়া খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে থেমে থেমে বলল, একটা সাদি করছি নইম।
নইম মাঝির মুখে কথা সরে না। বলে কী মতি মিয়া!
কবে করলা?
মাস দুই হইল।
তাজ্জব করলা তুমি মতি ভাই।
মতি মিয়া ইতস্তত করে বলল, কেউরে হাইও না। তোমারে আল্লাহর দোহাই।
নইম মাঝি কাউকে বলল না, শুধু আজরফকে বলল।
পাঁচ কান করিম না আজরফ, নিজে গিয়া দেখ আগে। তর মারে হুনাইস না। মাইয়ামানুষ, বেহুদা চিন্নাইব।
আজরফের কোনো ভাবান্তর হয় না। যথানিয়মে কাজকর্ম করে। তারপর একদিন বাঁশ আর চাটাই দিয়ে রহিমার ঘর ঠিকঠাক করতে থাকে। শরিফার কাছে সমস্ত ব্যাপারটি খুব রহস্যময় মনে হয়। হঠাৎ কাজকর্ম ফেলে ঘর-দুয়ার ঠিক করার দরকারটা কী? নুরুদ্দিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ঘর ঠিকঠাক করে যে, বিষয় কী?
আমি কী জানি?
তুই গিয়া জিগা।
তুমি জিগাও গিয়া, আমার ঠেকা নাই।
শরিফার নিশ্চিত ধারণা হয়, আজরফ সম্ভবত বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করতে চাওয়াটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সময়-অসময় আছে। চাইলেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় না? দেশ জুড়ে আকাল। ঘরের মানুষটার কোন খোঁজ নেই। টাকাপয়সা অবশ্যি আছে। ভালোই আছে। ধানবেচা টাকা, উজান দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা। এদিকে সরকাররাও নিশ্চয়ই ভালো দিচ্ছে। গরুর মতো যে খাটে, তাকে দেবে না। কিন্তু টাকা থাকলেই বিয়ে করতে হবে? শরিফা বড়োই চিন্তিত বোধ করে। পরামর্শ করার লোক নেই। রহিমা থাকলে এই ঝামেলা হত না।
এক দিন নইম মাঝির বউ এসে বলল, আজরফরে দেহি চৌধুরীবাড়ির কোণায় কোণায় ঘুরে। এটু খিয়াল রাইখ্যো।
কথা সত্যি হলে খুবই ভয়ের কথা। চৌধুরীবাড়ির কোনো মেয়েকে মনে ধরলেও তা মুখ ফুটে বলা উচিত না। শরিফা কায়দা করে জানতে চায় ব্যাপারটা। আজরফকে ভাত বেড়ে দিয়ে হঠাৎ বলে বসে, চৌধুরীবাড়ির মাইয়ার লাখান মাইয়া পাইলে বৌ করতাম।
আজরফ নিরুত্তর।
হলদির লাখান শইলের রঙ।
আজরফকে দেখে মনে হয় না সে কিছু শুনছে।
চৌরীবাড়ির ছোড মাইয়ারে দেখছস নি আজরফ?
নাহ্।
শরিফার ঠিক বিশ্বাস হয় না। বড়ই অস্বস্তি বোধ হয় তার। তারপর এক দিন যখন আজরফ হঠাৎ ঘঘাষণা করে, আগামীকাল ভোরে সে নুরুদ্দিনকে নিয়ে নীলগঞ্জে যাবে তার বাবাকে আনতে, তখন সন্দেহ ঘনীভূত হয়। হঠাৎ বাপের খোঁজ বের করে আনবার জন্যে যাওয়া কেন? আর নুরুদ্দিনের জন্যেইবা নতুন গেঞ্জি কেনা হল কেন? নতুন গেঞ্জির দরকারটা কী ছিল?
মতি মিয়ার বৌটির নাম পরী।
মেয়েটির বয়স খুবই কম, এবং বড়োই রোগ। কথা বলে উজান দেশের মানুষদের মতো টেনে টেনে। নুরুদ্দিন খুব অবাক হল। সে ভাবতেও পারে নি, এ রকম আশ্চর্য একটি ব্যাপার তার জন্যে অপেক্ষা করছে। পরী নুরুদ্দিনের হাত ধরে তাকে পাশে বত্সল এবং টেনে টেনে বলল, ছোড মিয়ার গালে একটা লাল তিল, দেখছ নি কাণ্ড।
গালের লাল তিল যে একটি চোখে পড়ার জিনিস নুরুদ্দিন তা স্বপ্নেও ভাবে নি। তার লজ্জা করতে লাগল।
চা খাইবা ছোড মিয়া? চা বানাই? নতুন খেজুর গুড়ের চা।
নুরুদ্দিনের মতো বাচ্চা ছেলেকে চা খাওয়াবার জন্যে কেউ সাধাসাধি করে? তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে লজ্জিত মুখে চোখ ঘুরিয়ে ঘরবাড়ি দেখতে লাগল। দেখার মত কিছু নেই। ছোট্ট এক চিলতে ঘর, এক প্রান্তে দড়ির একটি খাটিয়ায় কাঁথা-বালিশ। ঘরের অন্য প্রান্তে একটি হারমোনিয়ামের উপর এক জোড়া ঘুঙুর। চা বানাতে বানাতে পরী বলল, নাচনিওয়ালী ছিলাম, বুঝছ নি ছোট মিয়া–হইলাম ঘরওয়ালী।
মতি মিয়া ধমক দিল, আহু, কী কও?
ক্যান, তোমার সরম লাগে?
পুরান কথার দরকার কী?
পরী খিলখিল করে হাসতে লাগল।
ফেরবার পথে মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে রইল। তাকে বড়োই চিন্তিত মনে হল। কিন্তু পরীর ভাবভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। নৌকার অন্য প্রান্তে নুরুদ্দিনের সঙ্গে সে ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছে, ঐটা কোন গ্রাম? ঘাসপোতা? ঘাসপোতা আবার কেমুন নাম?
ভাটি অঞ্চলে পানি কোন সময় হয়? তোমরার জংলা-বাড়ির ভিটাতে তুমি নাকি একটা পেততুনী দেখছিলা? হাতে লাল চুড়ি? কথাডা সত্য?
চৌধুরীবাড়ির একটা পুলার নাকি মাথা খারাপ?
কে ধনী বেশি? চৌধুরীরা না সরকাররা?
মতি মিয়া তেমন কোনো কথাবার্তা বলল না। বড় গাঙ থেকে ছোট গাঙে নৌকা ঢেকবার সময় শুধু বলল, জমির কাজ-কাম শুরু করণ দরকার।
আজরফ বলল, আপনে আর যাইতেন না শম্ভুগঞ্জ?
দূর, গান-বাজনা ছাড়ান দিছি। পোষায় না।
আজরফ কিছু বলল না। মতি মিয়া নিজের মনেই বলল, ঘর-সংসার দেখুন দরকার। গান-বাজনায় কি পেট ভরে? ভাত কাপড় আগে, বুঝছ?