ছোট চৌধুরী গর্জন করে ওঠেন, কথা কানে ঢুকে না? থাপ্পড় দিব, ছোটলোক কোথাকার। যা, বাড়িত যা।
মতি মিয়া বাড়ি ফিরে দেখে আমিন ডাক্তার বসে আছে। শরিফার জ্ঞান নেই। আজরফ চুলা ধরিয়ে কি যেন জ্বাল দিচ্ছে।
আমিন ডাক্তার বলল, অবস্থা বড় সঙ্গিন। রাইত কাটে কিনা সন্দেহ।
মতি মিয়া কিছু বলল না। যেন সে আমিন ডাক্তারকে দেখতেই পায় নি। আজরফের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় ধমক দেয়, অত রাইতে কী জ্বাল দেস?
চা। আমিন চাচা চায়ের পাতা আছে।
আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলল, সারা রাইত জাগন লাগব, চা ছাড়া জুইত হইত না। বুঝছনি মতি, নীলগঞ্জ নেওন লাগব।
আমিন ডাক্তার লোকটি ভীতু প্রকৃতির। রুগীর অবস্থা একটুখানি খারাপ দেখলেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলগঞ্জ নেবার জন্যে, বারবার বলে, রাইত কাটা সম্ভব না। রাইতের মধ্যেই ভালো-মন্দ হইতে পারে।
কিন্তু আজ রুগীর অবস্থা সত্যি খারাপ। আমিন ডাক্তার চিন্তিত মুখে ক্ৰমাগত হঁকা টানে। মতি মিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, মেয়েমানুষের মত বেআকেল জিনিস খোদার আলমে নাই, বুঝলা ডাক্তার?
ডাক্তার ইকা টানা বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে বলে, নীলগঞ্জ নেওনের ব্যবস্থা কর মতি।
কইলেই তো ব্যবস্থা হয় না। যোগাড়-যন্ত্র লাগে। সকাল হউক। টেকাপয়সার যোগাড় দেখি।
আইজ রাইতেই নেওন লাগব মতি।
মতি মিয়া কথা না বলে খেতে বসে। আজরফ ভাত বেড়ে দেয়। তাত শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে গেছে। কাঁচা মরিচে ঝালের বংশ নেই। মতি মিয়া আধপেটে খেয়েই হাত ধোয়। হোট ছেলে নুরুদ্দিন আমিন ডাক্তারের গা ঘেঁষে বসেছিল। সে দীর্ঘ সময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস করে বলে ফেলে, আমারে নীলগঞ্জ নেওন আগব বাজান।
বহু কষ্টে রাগ সামলায় মতি মিয়া। আমিন ডাক্তার বলে, চা খাও। আজরফ, রে বাপরে চা দে।
আমারে দিস না।
আরে খাও। বালা চা। মোহনগঞ্জের খরিদ।
নীলগঞ্জ যাওয়ার যোগাড়-যন্ত্র করতে অনেক সময় লাগে। বাঁশের যে-খুঁটিতে পয়সা জমান হত, সেটি কাটা হয়। সব মিলিয়ে সাত টাকার মতো পাওয়া যায় সেখানে। এতটা মতি মিয়া আশা করে নি। আজরফ চলে যায় নৌকার ব্যবস্থা করতে। ঠিক হয় আজরফ নুরুদ্দিন দুজনেই সঙ্গে যাবে। আমিন ডাক্তারও যাচ্ছে। নীলগঞ্জ হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার সাহেবের সঙ্গে তার নাকি ভালো জানাশোনা। আপনি আপনি করে কথা বলে।
খালি বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্যে আনা হয়েছে রহিমাকে। রহিমার মেয়েটি কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। শরিফার জ্ঞান ফিরেছে। সে বিড়বিড় করে কী যেন বলে, ঠিক বোঝা যায় না। মতি মিয়া কড়া ধমক লাগায়, চুপ। একদম চুপ। বেআক্কল মেয়েমানুষ।
শরিফা চুপ করে যায়। আমিন ডাক্তার এক ফাঁকে বলে, আমারে যে সাথে। নিছ সেই বাবদ দুই টেকা ভিজিট কথা স্মরণ রাখবা মতি।
মতি মিয়া দারুণ বিরক্ত হয়।
তোমারে সাথে নেওনের কথা তোকই নাই। নিজের ইচ্ছায় তুমি যাইতাছ।
আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়।
নৌকায় উঠবার মুখে ৰূপৰূপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। দুইয়ের নিচে খড় বিছিয়ে শরিফার বিছানা। শরিফার গায়ের সঙ্গে সেঁটে লেগে থাকে নুরুদ্দিন। ডাক্তার বসেছে নৌকার সামনের মাথায়। এর মধ্যেই সে ভিজে চুপসে গেছে। তার সঙ্গে ছাতা আছে। কিন্তু রুগী নিয়ে কোথায়ও যাওয়ার সময় ছাতা মেলতে হয় না। খুব অলক্ষণ। নৌকাতে দুটি মুরগি এবং একটি পাকা কাঁঠাল নেওয়া হয়েছে। নীলগঞ্জ বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
মুরগি দুটি অনবরত ডানা ঝাপ্টায়। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে হঁক ধরায়। বৃষ্টির ছাট থেকে ককে আড়াল করে রাখতে তাকে অনেক কায়দা-কানুন করতে হয়। পাকা কাঁঠালের গন্ধের সঙ্গে তামাকের গন্ধ মিশে অদ্ভূত একটা মিশ্ৰ গন্ধ তৈরী হয়। তুমুল বৰ্ষণের মধ্যে নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আজরফ টপাটপ বৈঠা মারে। মতি মিয়ার বড়ো মায়া লাগে।
শীত লাগে আজরফ?
নাহ্।
মাথাডা গামছা দিয়া বাঁধ। মাথা শুকনা থাকলে সব ঠিকঠাক–বুঝছস?
বুঝছি।
বৈশাখ মাসের বিষ্টির মজাটা কি জানস নি আজরফ?
না।
মজাটা হইল, অসুখ-বিসুখ হয় না। সব আল্লাহর কেরামতি।
আজরফ কথা বলে না। ছৈয়ের ভেতর থেকে শরিফা বিড়বিড় করে কী যেন বলে। অসহ্য বোধ হয় মতি মিয়ার।
কি কও?
পুলাড়া ভিজতাছে।
দুত্তেরি মেয়েমানুষ। বিষ্টির সময় ভিজত না?
অসুখ করব।
চুপ থাক মাগী, খালি প্যানপ্যাননি।
আমিন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলে, মেয়ে জাতের সাথে এই সব গালিগালাজ করা ঠিক না মতি।
তুমি ফরফর কইর না, চুপ থাক।
আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়। ছপছপ বৈঠা পড়ে। মৈয়ের ভেতর থেকে মুরগি দুটির ডানা ঝাপটানর আওয়াজ আসে। দূরের সোপোতার হাওরের দিক থেকে হত হত শব্দ হয়। গা ছমছম করে আজরফের। নৌকা এখন বড়ড়া গাঙে পড়বে। জায়গাটা খারাপ। গাঙের মুখটাতেই তিনটি প্রকাণ্ড শ্যাওড়া গাছ। রাতে নাম নেওয়া যায় না, এমন সব বিদেহী জিনিসদের খুব আনাগোনা।
নৌকা নীলগঞ্জে পৌঁছল দুপুরের পর। মতি মিয়ার নড়বার শক্তি নেই। একনাগাড়ে নৌকা বেয়ে সমস্ত শরীর কালিয়ে গেছে। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ার চিন্তা ছাড়া তার মাথায় এখন আর কিছু টুকছে না। আমিন ডাক্তার একাই গেল হাসপাতালে খোঁজ নিতে। ঘন্টাখানিক পর ফিরে এল মুখ কালো করে। হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব গেছেন ছুটিতে। কখন আসবেন কেউ জানেনা। কম্পাউণ্ডার সাহেবের মেয়ের বিয়ে। তিনি গেছেন বাঁশখালি। বিষ্যত্বর নাগাদ আসবার কথা। মতি মিয়ার কোনো ভাবান্তর হল না। সে গম্ভীর মুখে বলল, চেষ্টার তো কোন ত্রুটি করি নাই, কী কও ডাক্তার? কপালের লিখন না যায় খণ্ডন করণের তো কিছু নাই।