ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেব কলেরা শুরু হওয়ার চতুর্থ দিনে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। আমিন ডাক্তারের কাছে অষুধপত্র নেই। নিমতলির সিরাজুল ইসলামের কাছে লোক গিয়েছিল। তিনি এলেন না। নিমতলিতেও কলেরা লেগেছে। সেখানেকার অবস্থা ভয়াবহ। তবে সেখানে সরকারি সাহায্য এসেছে। সোহাগীতে এখনো কেউ আসে নি। কেউ বোধহয় নামও জানে না সোহাগীর।
পঞ্চম দিনে রহিমার ভেদবমি শুরু হল। আমিন ডাক্তার ছুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। করবার কিছু নেই। রুগীর পাশে বসে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী-বা করা যায়?
শরিফা রহিমার মাথা কোলে নিয়ে বসে ছিল। নুরুদ্দিন অনুফার হাত ধরে বারান্দায় বসে ছিল। শরিফা ঢুকরে কেঁদে উঠল, একি সৰ্বনাশ ডাক্তার।
আল্লাহ্র নাম নেন, আল্লাহ্ নিকাবান।
রহিমার শরীর খুবই খারাপ হল মাঝরাত্রে। শরিফা ধরা গলায় বলল, কিছু খাইতে মন চায় ভইন?
নাহ্। ভইন, আমার উপরে রাগ রাইখ না।
না, আমার রাগ নাই। তোমরার সাথে আমি সুখেই আছিলাম।
শরিফা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমিন ডাক্তার উঠোনের চুলায় পানি সেদ্ধ কছিল। শরিফা বেরিয়ে এসে বলল, এরে নিখল সাব ডাক্তারের কাছে নিলে বালা হইয়া যাইত।
সময় নাই দোস্তাইন। সময়ের অনাটন।
রহিমা মারা গেল শেষত্রে। অনুফাকে দেখে মনে হল না সে খুব বিচলিত হয়েছে। আমিন ডাক্তার বলল, অনুফা বেটি, সিদ্ধ পানিদিয়া গোসল কর। সবজামাকাপড় পানির মইধ্যে সিদ্ধ করণ দরকার।
অনুফা কোনো আপত্তি করল না। আমিন ডাক্তার অনুফার মাথায় পানি ঢালতে লাগল। অনুফা ফিসফিস করে বলল, চাচাজী, নিখল সাব ডাক্তার আইতাছে।
কী কস তুই বেটি?
নিখল সাব ডাক্তার এই গেরামে আসছে।
সেই এক রাত্রে সোহাগীতে মারা গেল ছয় জন। গ্রামবন্ধন দেওয়ার জন্যে ফকির আনতে লোক গেছে। ফকির শুধু গ্রামবন্ধনই দেবে না, ওলাউঠাকে চালান। করে দেবে অন্য গ্রামে। অমাবস্যার রাত্রি ছাড়া তা সম্ভব নয়। ভাগ্যক্রমে আগামীকাল অমাবস্যা।
ফকির সাব সকালে এসে পৌঁছলেন। ডাক্তার রিচার্ড এ্যালেন নিকলসন এসে পৌঁছলেন দুপুরবেলা। খবর পেয়ে আমিন ডাক্তার চৌধুরীবাড়ির ভাত ফেলে ছুটে এল।
ভালে আছ আমিন?
নিখল সাব হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন। বিস্ময়ের চোটে আমিন ডাক্তারের মুখে। কথা ফুটল না। ডাক্তার নিখল সাব চুরুটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমরা নিমতলি গিয়েছিলাম। সেখানে সরকারি সাহায্য এসেছে, কাজেই তোমাদের এখানে, আসলাম। আমাদের আরেকটা টীম গেছে সুশানপুকুর। তোমাদের অবস্থা কী?
স্যার, খুব খারাপ।
পানি ফুটিয়ে খাচ্ছে তোলোকজন? নিখল সাব হাসতে লাগলেন, যেন পিকনিক করতে এসেছেন।
নিখল সাব এসে পৌঁছবার পর আর একটিমাত্র রুগী মারা গেল। কৈবর্তপাড়ার নিমু গোঁসাই। এত অল্প সময়ে ওলাউঠাকে আয়ত্ত করার কৃতিত্বের সিংহভাগ পেল ধনু ফকির। ফকির সাব ওলাউঠাকে পশ্চিম দিকে চালান করেছেন। সেই কারণেই শেষ রুগীটি হয়েছে পশ্চিমের কৈবর্তপাড়ায়।
নিখল সাব ডাক্তার শুক্রবার চলে গেলেন। যাবার সময় অনুফাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। অনুফা কোনো রকম আপত্তি করল না।
নিখল সাব ডাক্তার বারবার জিজ্ঞেস করলেন, আমিন বলেছে তোমার মায়ের ইচ্ছে ছিল, তুমি আমার স্কুলে পড়। তুমি কি যেতে চাও?
অনুফা মাথা নাড়ল। সে যেতে চায়।
কাঁদবে না?
উঁহুঁ।
নাম কী তোমার?
অনুফা।
এত আস্তে বলছ কেন? আমাকে ভয় লাগছে?
উঁহুঁ।
নৌকা ছাড়ার ঠিক আগে আগে আমিন ডাক্তার চৌধুরীদের পাগল ছেলেটাকে ধরে এনে হাজির করল। যদি নিখল সাব কোনো চিকিৎসা করতে পারে। নিখল সাব। জিজ্ঞেস করলেন,কী নাম আপনার?
চৌধুরী জমির আলি। কী অসুবিধা আপনার?
জ্বি-না, কোনো অসুবিধা নাই।
রাত্রে ভালো ঘুম হয়?
জ্বি, হয়।
অত্যন্ত শান্ত ভদ্র কথাবার্তা। নিখল সাব ডাক্তার নৌকা ছেড়ে দিলেন। বড়ো গাঙের কাছাকাছি নৌকা আসতেই অনুফা বলল, নুরু ভাই খাড়াইয়া আছে ঐখানে।
নিখল সাব অবাক হয়ে দেখলেন, নুরুদ্দিন নামের শান্ত ছেলেটা সত্যি দাঁড়িয়ে আছে। এত দূর এল কী করে?
নৌকা ভেড়াব? কথা বলবে?
নাহ্।
যে-মেয়েটি সারাক্ষণের জন্য একবারও কাঁদে নি, সে এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট
ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট।
নুরুদ্দিনের পেটে সারাক্ষণ ভাতের খিদে লেগে থাকে। শরিফা রোজই বলে, আজরফ টেকাপয়সা লইয়া আসুক, দুই বেলা ভাত রানমু।
কোন দিন আইব?
কবে যে আসবে, তা শরিফাও ভাবে। কোনোই খোঁজ নেই। নুরুদ্দিন গয়নার নৌকায় রোজ দু বেলা খোঁজ করে। মাঝে মাঝে চলে যায় লালচাচীর বাড়ি।
দুপুরে কী রানছ চাচী? ভাত?
না রে, জাউ। খাবি জাউ? দেই এক বাটি?
নাহ্। নুরুদ্দিন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, রাইতে ভাত হইব নি চাচী?
দূর, ভাত আছে দেশটার মইধ্যে?
ভাত খাওয়নের ইচ্ছা হয় চাচী।
লালচাচী ঘোট নিশ্বাস ফেলে বলে, চাই চাউল ঘরে আছে। দিমু ফুটাইয়া?
আইচ্ছা দেও।
লালচাটী নুরুদ্দিনের কোলে বাচ্চা দিয়ে অল্প কিছু চাল বসায়। বাচ্চাটা অসম্ভব রুণ। ট্যা টা করে কাদে। কিছুতেই তার কান্না সামলান যায় না। লালচাচী শান্ত স্বরে বলে, ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট রে নূরা।
হ।
নতুন ধান উঠলে এই কষ্ট মনে থাকত না।
নুরুদ্দিন খেতে বসে হাসিমুখে বলে, অনুফা তিন বেলা ভাত খায়। ঠিক না চাচী?
হুঁ।
ফালাইয়াছড়াইয়া খায়। ঠিক না চাচী?
হুঁ। নিখল সাবের তো আর পয়সার অভাব নাই।
বিকালের দিকে নুরুদ্দিন তার মাছ মারার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বের হয়। বাড়ির পেছনের মজা খালটাতে গোটা দশেক লার বড়শি পাতা আছে। বড়শি গুলির মাথায় জ্যান্ত লাটি মাছ। লাটি মাছের প্রাণ বড়ো শক্ত প্ৰাণ, এই অবস্থাতেও সে দশ-বার ঘন্টা বেঁচে থাকে। নুরুদ্দিনের কাজ হচ্ছে লাটি মাছগুলি মরে গেল কিনা, তাই দেখা। মরে গেলে সেগুলি বদলে দিতে হয়। মাছ কিন্তু ধরা পড়ে না। জংলা ভিটায় এই পরিশ্রম করলে রোজ দু-তিনটা মাছ ধরা পড়ত। নুরুদ্দিনের বড়ো ইচ্ছা করে জংলা ভিটায় যেতে–সাহসে কুলায় না। একটা ফর্সা হাতের ছবি চোখে ভাসে। হাতভর্তি গাঢ় লাল রঙের চুড়ি। এত লাল চুড়ি হয় নাকি!