রহিমা জবাব দিল না। একমনে খোঁড়াখুড়ি করতে লাগল।
ডাক্তার ভাই।
কি?
আপনে অনুফা আর নুরুদ্দিনরে লইয়া যান, আমার দিরং হইব।
অনুফা নুরুদ্দিনের সঙ্গে চৌকিতে বসে খোঁড়াখুড়ি দেখছিল।
সে মৃদুস্বরে বলল, হগলে মিল্যা একসাথে যাইয়াম চাচা।
খুঁতিতে বাঁধা টাকা পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। রহিমা বলল, আপনার কাছে রাখেন ডাক্তার ভাই।
আমার কাছে কেরে?
মেয়েমাইনষের হাতে টেকা থাকন নাই। দোষ হয়।
দক্ষিণ কান্দায় তারা যখন পৌঁছল, তখন পুব দিক ফর্সা হতে শুরু করেছে। কান্দার পশ্চিম পাশে অনেকগুলি ছেলেমেয়ে মিলে খুব হৈচৈ করছে। কৈবর্তদের একটি ছেলে দৌড়াদৌড়ি করছিল, পা পিছলে নিচে পড়েছে-তাকে তুলে এনে শক্ত মার লাগান হচ্ছে। কৈবর্তদের প্রবীণ নরহরি দাস তামাক টানছে আর বলছে,
শক্ত মাইর দেও। খুব শক্তে দেও। তামশা পাইছে।
আমিন ডাক্তার বলল, ও নুরা, তোর মারে খুইজ্যা বাইর কর, খবরদার কান্দার কিনারাত যাইস না। এক চড় দিয়া দাত ফালাইয়া দিয়াম।
নুরুদ্দিন অনুফার হাত ধরে চক্ষের নিমিষে ছুটে গেল। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে বলল, কারবারটা দেখছনি রহিমা, না করলাম যেটা, হেইটা করন চাই।
রহিমা মৃদুস্বরে বলল, আপনেরে একটা কথা কইম চাই।
কী কথা?
কথাডা আপনি কিন্তুক রাখবেন আমিন ভাই।
আমিন ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, বিষয় কী?
অনুফারে নিখল সাব ডাক্তারের কাছে পাঠাইতাম চাই। হেইখানে ইস্কুলকলেজ আছে। লেহাপড়া শিখব।
আইজ হঠাৎ এই কথা কী কও?
ডাক্তার ভাই, পানি নামলে এইহানের অবস্থা খুব খারাপ হইব, আজরফের দুইডা পেট চালানর ক্ষ্যাম থাকত না।
তুমি তো অনেক দূরের কথা কও রহিমা।
নাহ্ ডাক্তার ভাই, দূরের কথা না।
নিখল সাব ডাক্তারের কাছে নিলে খিরিষ্টান হওন লাগে। হেই কথাডা জান তো?
জানি।
তুমি চিন্তাডা এট্টু বেশি করতাছ রহিমা। এই পানি থাকত না–যেমন হঠাৎ আইছে, হেই রকম হঠাৎ যাইব।
ডাক্তার ভাই, এই পানি মেলা দিন থাকব।
কান্দার ঠিক মাঝখানে কারা যেন একটা আগুন করেছে। দুর্যোগের সময় মানুষ প্রথমে অকারণেই একটা আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করে। আজকের এই আগুনের অবশ্যি প্রয়োজন ছিল। ভেজা গা শুকোতে হবে, তা ছাড়া বিলের দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমিন ডাক্তার দেখল, ফজলুল করিম সাহেব আগুনের কাছে এসে হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর এখানে আসার কথা নয়। তাঁর ঘরের কাছেই সরকারবাড়ি।
এই যে, ও ভাই আমিন ডাক্তার, এ কী অবস্থা?
অবস্থাটা খারাপই, আপনে এত দূরে আসলেন।
আমার ঘোড়ার খোঁজে আসছি। মরেই গেছে নাকি, কী বিপদ দেখেন তো!
পাইছেন ঘোড়া?
কই পাব বলেন? ছিঃ ছিঃ, মানুষ থাকে এইখানে।
নুরুদ্দিন আর অনুফা জারুল গাছের গুড়িতে চুপচাপ বসে আছে। গাছটি কান্দার ধার ঘেঁষে উঠেছে। নিচে তাকালেই পানির ঘোলা আবর্ত চোখে পড়ে। শরিফা বেশ কয়েক বার ডাকল, নুরু, অত পানির ধারে থাকিস না। কাছে আইসা ব।
নুরু গা করে না। ফিসফিস করে অনুফাকে কী যেন বলে, অনুফা খিলখিল করে হেসে ওঠে। শরিফা ধমকে ওঠে, হাসিনা। খবরদার। বিপদের মইধ্যে হাসি। কিছুই তর মায় তরে শিখায় নাই?
ভোরবেলা দেখা গেল ঘোলা পানি কান্দা দুই-চুই করছে। নরহরি দাস মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
ছাব্বিশ সনের বানের লাখান লাগে গো।
কৈবর্তদের চারটি নৌকা জারুলগাছের গুড়িতে শক্ত করে বাঁধা। আমিন ডাক্তার বেশ কয়েক বার বলেছে, নৌকাতে করে সবাইকে সরকারবাড়িতে নিয়ে যেতে। সরকারবাড়ি অনেকখানি উঁচুতে। তাছাড়া পাকা দোতলা বাড়ি। মেয়েছেলেরা সবাই দোতলায় থাকতে পারবে। কৈবর্ত রাজি নয়। তারা দক্ষিণ কান্দাতেই থাকতে চায়।
সারা রাত ঝড়-বৃষ্টি কিছুই হয় নি। সকালবেলা দেখা গেল, আকাশে ঘন কালো মেঘ। দুপুরের পর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। নরহরি দাস চিন্তিত মুখে বারবার বলতে লাগল, গতিক খুব খারাপ। ভগবানের নাম নেন গো।
বিকালের দিকে বৃষ্টির চাপ কিছু কমতেই দেখা গেল ছোট ঘোট খোন্দা নিয়ে সরকারবাড়ির কামলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারবাড়ির ছোট বৌ নাকি পানিতে পড়ে গেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি চলল। রাত প্রথম পহর পোহাবার আগেই কান্দার উপর আধ হাত পানি।
পানি থাকল সব মিলিয়ে ছ দিন। এতেই সোহাগীর সর্বনাশ হয়ে গেল।
ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য
ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য সোহাগীর লোকজনের জানা নেই। চৈত্র মাসের দারুণ অভাবের সময়ও এরা ফেলে-ছড়িয়ে তিন বেলা ভাত খায়। এবার কার্তিক মাসেই কারো ঘরে এক দানা চাল নেই। জমি ঠিকঠাক করার সময় এসে গেছে। বীজধান দরকার। হালের গরু দরকার। সিরাজ মিয়ার মতো সম্ৰান্ত চাষীও তার কিনে রাখা ঢেউটিন জলের দামে বিক্রি করে দিল।
ঘরে ঘরে অভাব। ভেজা ধান শুকিয়ে যে-চাল করা হয়েছে সে-চালে উৎকট গন্ধ। পেটে সহ্য হয় না। মোহনগঞ্জ থেকে আটা এসেছে। আটার রুটি কারোর মুখে রোচে না। কেউ খেতে চায় না। লগ্নির কারবারীরা চড়া সুদে টাকা ধার দিতে শুরু করল।
ঠিক এই সময় কলেরা দেখা দিল। প্রথম মারা গেল ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেবের কম্পাউণ্ডারটি। হাতির মত জোয়ান লোক দু দিনের মধ্যেই শেষ। তার পরদিনই একসঙ্গে পাঁচ জন অসুখে পড়ল। আমিন ডাক্তার দিশাহারা হয়ে পড়ল। অষুধপত্র নেই। খাবার নেই। কী ভাবে কী হবে?
রাতে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে সবাই। ওলাউঠার সময় খুবই দুঃসময়। তখন বাইরে বেরোলে রাত-বিরাতে বিকট কিছু চোখে পড়তে পারে। চোখে পড়লেই সর্বনাশ।