আকাশ-পাতাল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল নুরুদ্দিন। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। চোখ গাঢ় রক্তবর্ণ। লোকজন ঠিক চিনতে পারছে না। আমিন ডাক্তার এসে যখন জিজ্ঞেস করল, কী হইছে নূরু?
নুরু ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।
কী হইছে ক দেহি নুরু?
ভয় পাইছি চাচা। কী দেখছস?
একটা মেয়েমানুষ সাঁতার দিয়া আমারে ধরতে আইছিল। হাতের মইধ্যে লাল চুড়ি।
প্রচণ্ড ঝড় হল সেই রাত্রে। ঘনঘন বিজলি চমকাতে লাগল। কালাচাঁন খবর আনল নিমতলির দোষ-লাগা তালগাছে বজ্ৰপাত হয়েছে।
পরদিন আমিন ডাক্তার নৌকা নিয়ে সারা দুপুর জংলা বাড়ির ভিটায় ঘুরে বেড়াল। কোথায়ও কিছু নেই। থইরকল গাছগুলি দেখে সেও নুরুদ্দিনের মতোই অবাক হল। উজান দেশের গাছ। ভাটি অঞ্চলে কখনো হয় না। গাছগুলিতে গাঢ় লাল রঙের ফল টুকটুক করছে। আমিন ডাক্তার আরো একটি জিনিস লক্ষ করল, জংলা বাড়ির ভিটা পানিতে ড়ুবে গেছে। কোনো বৎসর এরকম হয় না।
সোহাগীতে রটে গেল পাগলা নুরা রাসন্ধ্যায় গিয়েছিল জংলা বাড়ির ভিটাতে। গিয়ে দেখে পরীর মত একটা মেয়ে নেংটা হয়ে সাঁতার কাটছে। নুরাকে দেখে সেই মেয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ড়ুবসাঁতার দিল।
নুরুদ্দিনের জ্বর সারতে দীর্ঘদিন লাগল। নিমতলির পীর সাহেব নিজে এসে তাবিজদিলেন। গৃহবন্ধন করলেন। বারবার বলে গেলেন আর যেন কোন দিন জংলা ভিটায় না যায়। জায়গাটাতে দোষ হয়েছে। নিমতলির তালগাছে যে থাকত সে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। জংলা ভিটায় এসে তার আশ্রয় নেওয়া বিচিত্র নয়।
সোহাগীতে পানি ঢুকছে
সোহাগীতে পানি ঢুকছে, এই ভয়াবহ খবরটি চৌধুরীদের পাগল ছেলে প্রথম টের পেল। তার রাতে ঘুম হয় না। বাংলাঘরের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট টানে এবং কোনো রকম শব্দ হলেই চেঁচায়, কেডা? চোর নাকি? এই চোর, এই চোর। এ্যাইও। তার চেঁচামেচি চলে ভোের পর্যন্ত। ফজরের আজানের পর সে ঘুমাতে যায়। দুপুর পর্যন্ত নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।
সেই রাত্রে সে উঠোনে পাটি পেতে শুয়ে ছিল এবং তার স্বভাব মতো চোর চোর বলে কেঁচাতে-চেঁচাতে শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল, তখন সমস্ত উঠোনে থৈথৈ পানি। শোঁ-শী শব্দ উঠছে। শেয়াল ডাকাডাকি করছে চারদিকে। সে প্রথম কয়েক মহর্ত কিছুই বুঝতে পারল না। তার নিজস্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেঁচাল, কে, চোর নাকি? এই শালা চোর? এ্যাইও। তার পরমুহূর্তেই পানি আসে পানি আসে বলে বিকট চিৎকার করে ছুটতে শুরু করল। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেবের ঘোড়াটি বিকৃত স্বরে চেঁচাতে শুরু করল। গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের গোয়াল ঘরগুলি থেকে গরু ডাকতে লাগল। বেশির ভাগ মানুষ জেগে উঠল এই সময়। ছোট মসজিদের ইমাম সাহেব রাত সাড়ে তিনটায় আযান দিলেন। অসময়ের আযান–মহাবিপদের সংকেত দেয়। লোকজনের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। সরকারবাড়ি থেকে সরকার সাহেব দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দোনালা বন্দুক থেকে চার বার ফাঁকা আওয়াজ করলেন। ঘোট ঘোট ছেলেমেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে শুরু করল।
আমিন ডাক্তার যখন ঘর থেকে বেরুল, তখন তার উঠোনে প্রায় হাঁটু-পানি। এই রকম অসম্ভব ব্যাপার সোহাগীর মানুষ কখনো দেখে নি। ভাটি অঞ্চলে পানি এত দ্রুত ্কখনো বাড়ে না। আর বাড়লেও পানি এসে বাড়ির উঠোনে কখনো ঢোকে না। আমিন ডাক্তার চৌধুরীবাড়ি এসে দেখে ইতোমধ্যেই প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। একটি হ্যাজাক লাইট উঠোনের জলচৌকির উপর বসান। চৌধুরী সাহেব গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁকডাক করছেন। —
মেয়েছেলেগুলিরে সরকারবাড়িত লইয়া যাও। গরু-ছাগলের দড়ি কাট, জান বাঁচানির চেষ্টা কর। ভোর মত চাইয়া থাইক্য না।
আমিন ডাক্তার দৌড়াতে শুরু করল। মতি মিয়ার বাড়ি যাওয়া দরকার। পুরুষমানুষ কেউ নেই সেখানে। শরিফা সেরকম হাঁটাচলাও করতে পারে না। এতক্ষণ সে কথা মনেই হয় নি।
মতি মিয়ার বাড়ির উঠোনে অনেকখানি পানি। দক্ষিণ কান্দার একটি অংশ ভেঙে সরসর করে পানি ঢুকছে। উঠোনের বাঁ দিকটা নিচু। সেখানে জলের একটা প্ৰবল ঘূর্ণি উঠেছে। আমিন ডাক্তার মতি মিয়ার বাড়িতে ঢুকে বেশ অবাক হল। রহিমা সবকিছু নিপুণভাবে গুছিয়ে ফেলেছে। হাস-মুরগি গরু-ছাগল সমস্তই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চৌকির নিচে ইট দিয়ে অনেকখানি উঁচু করে তার উপর ধান রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় একটি বড় পোঁটায় রাখা হয়েছে। শরিফা চৌকির এক কোণায় বসে বসে কাঁদছিল। আমিন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলল, অখন। কান্দনের সময় না, দোস্তাইন। সরকারবাড়িত যাওন লাগব।
আমি কেমনে যাই।
নেওনের ব্যবস্থা করছি। অখন শরমের সময় না। হাতটা ধরেন দেহি।
সরকারবাড়ি কিন্তু যাওয়া গেল না। দক্ষিণ কান্দার ভাঙা অংশে জলের চাপ খুব বেশি। সরকারবাড়ি যেতে হলে ভাঙা জায়গাটা পেরুতে হয়। কৈবর্তপাড়ার জেলেরা সবাই চলে এসেছে দক্ষিণ কান্দায়। অনেকগুলি কুপি জ্বলছে সেখানে। চাটাই বিছিয়ে মেয়েরা সব উচ্চৈঃস্বরে কলরব করছে। শরিফাকে ওদের কাছে বসিয়ে রেখে আমিন ডাক্তার রহিমাকে আনতে গেল। রহিমা খুন্তি দিয়ে গভীর মনযোগের সঙ্গে ঘরের ভেতরে কী যেন খুঁজছে। আমিন ডাক্তারকে দেখে সে শান্ত স্বরে বলল, আজরফ এইখানে ধান বেচা টেকা লুকাইয়া রাখছে। পানি উঠলে সব নষ্ট হইব।
আমিন ডাক্তার বেশ অবাক হল, তোমারে কইছিল যে এইখানে লুকাইছে?
না।
তুমি জানলা কেমনে?