এই অঞ্চলের লোকদের হাতে যখন টাকাপয়সা থাকে, তখন হঠাৎ করে শহুরে ডাক্তার এসে উদয় হয়। লোকদের টাকাপয়সা যখন কমে আসতে শুরু করে, তখন বিদেয় হয়। আগেও এরকম হয়েছে। এতে আমিন ডাক্তারের তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি। সোহাগীর লোকজন পুরন ডাক্তারকেই ডাকে। কিন্তু এই বৎসর অসুবিধা হচ্ছে। নতুন যে ডাক্তার এসেছেন, তিনি সোহাগীর লোকজনদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন।
ডাক্তারটির নাম শেখ ফজলুল করিম। এসেছেন মোহনগঞ্জ থেকে। সেখানে ডাক্তার সাহেবের বড়োফার্মেসি আছে– শেখ ফার্মেসি। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে যে এ্যাসিসটেন্ট এসেছে, সে আরেক বিস্ময়। লোকটির বাড়ি জৌনপুরে। বাংলা বলতে পারে না। সন্ধ্যাবেলা ডাক্তার সাহেবের ঘরের উঠোনে বসে সুর করে তুলসীদাসের রামচরিতমানস পড়ে। ডাক্তার সাহেব নিজেও কম বিস্ময় সৃষ্টি করেন নি। তিনি সঙ্গে একটি ঘোড়া নিয়ে এসছেন। এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে ঘোড়া কী কাজে লাগবে। জিজ্ঞেস করলে উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলেছেন–শীতকালের জন্যে ঘোড়া আনা হয়েছে। তার মানে লোকটি শুধু বর্ষার সময়ের জন্য আসে নি, দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত মধুর স্বভাব। ক দিন হয় এসেছেন, এর মধ্যেই গ্রামের সবার নাম-ধাম জানেন। দেখা হলেই খোঁজখবর করেন। অষুধের জন্য গেলে প্রথমেই বলেন–বিনা পয়সায় অষুধ দিতে পারি। কিন্তু অযুধে কাজ হবে না। পয়সা দিয়ে অষুধ নিলে তবেই অষুধ কাজ করে। গ্রামের সবার ধারণা, কথাটি খুব লেহ্য।
ডাক্তার সাহেবের কাছে সপ্তাহে একটি কাগজ আসে–দেশের ডাক। তিনি উচ্চৈঃস্বরে সেই কাগজ পড়ে শোনান। পড়া শেষ হলে চিন্তিত মুখে বলেন, ইস, দেশের সর্বনাশের আর বাকি নাই। গ্রামের লোকজন সর্বনাশের কারণ ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু ডাক্তার সাহেবের বিদ্যাবুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়।
আমিন ডাক্তার মহা বিপদে পড়ে গেল। রুগীপত্তর একেবারেই নেই। পাওনা টাকাপয়সাও কেউ দিচ্ছে না। সোহাগীর লোকজন যেন ভুলেই গেছে এই গ্রামে আমিন ডাক্তার নামে পুরনো এক জন ডাক্তার আছে। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে অনেক ফন্দিফিকির করে, কোনোেটাই কোন কাজে আসে না। যেমন– এক দিন সকালে সেজেগুজে গম্ভীর মুখে তার ব্যাগ হাতে বেরুল। যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই বলল, নিমতলি থেকে কল এসেছে, রুগীর অবস্থা এখনতখন, আমিন ডাক্তারকে ছাড়া ভরসা পাচ্ছে না। বিশেষ করে নিমতলির কথা বলার কারণ হচ্ছে–নিমতলিতে সিরাজুল ইসলামের মতো নামী ডাক্তার থাকেন।
আষাঢ় মাসের গোড়াতেই আমিন ডাক্তার মহা মুসিবতে পড়ল। না-খেয়ে থাকার যোগাড়। এক দিন চৌধুরী সাহেব এসে দেখেন আমিন ডাক্তার দুপুরবেলা শুকনো চিড়া চিবাচ্ছে। তিনি বড়ই অবাক হলেন। ভাটির দেশে ভাতের অভাব নেই, আর এখন সময়টাই হচ্ছে ফেলে-ছড়িয়ে খাবার। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রোজগারপাতি কেমুন ডাক্তার?
ইয়ে, আছে কোন মত।
হুঁ।
কলেরা শুরু হইলে কিছু বাড়ব। অখন কম।
চৌধুরী সাহেব যাবার আগে বলে গেলেন, সে যেন অতি অবশ্যি আজ রাত থেকে দু বেলা তার ওখানে খায়। আমিন ডাক্তারের চোখে পানি এসে গেল। সন্ধ্যাবেলা সে গেল নতুন ডাক্তার শেখ ফজলুল করিম সাহেবের কাছে। দেশের ডাক কাগজটি এসেছে। সেইটি পড়া হচ্ছে। প্রচুর লোকজন ঘরে। ফজলুল করিম সাহেব আমিন ডাক্তারকে খুব খাতির করলেন। আমিন ডাক্তার এক পর্যায়ে বলল,
আপনের কাছে একটা পরামর্শের জইন্যে আসলাম ডাক্তার সাব।
কী পরামর্শ?
এই গ্রামে একটা ইস্কুল দিতাম চাই।
আপনি ডাক্তার মানুষ, আপনি স্কুল কি দেবেন।
ডাক্তারী আমি করতাম না। আমার চেয়ে ভালা ডাক্তার ওখন এই গ্রামেই আছে।
লোকজনকে অবাক করে দিয়ে আমিন ডাক্তার উঠে পড়ল। অনেক রাত্রে প্রথম বারের মতো খেতে গেল চৌধুরীবাড়ি। ছোট চৌধুরী বসে ছিল বারান্দায়।
তার গায়ে একটি সূতাও নেই। আমিন ডাক্তারকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠল, এই শালা আমিন, তরে আজই আমি খুন করবাম। শালা তুই আমারে দেইখ্যা হাসছস। শালা তর বাপের নাম আজই ভুলাইয়া দিয়াম।
বর্ষার প্রধান প্রস্তুতি শেষ
র্ষার প্রধান প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
সোহাগীর চারপাশে বাঁশ পুঁতে চইল্যা গাছ ঢুকিয়ে মাটি শক্ত করা হয়েছে। প্রবল হাওয়ায় যখন হাওড়ের পানি এসে আছড়ে পড়বে, সোহাগীতে তখন যেন মাটি ভেঙে না পড়ে।
উত্তর বন্দ সবচেয়ে নিচু। সেটি ড়ুবল সবার আগে। তারপর এক দিন সকালে সোহাগীর লোকজন দেখল যেন মন্ত্রবলে চারদিক ড়ুবে গেছে। থৈথৈ করছে জল। হুমম শব্দ উঠছে হাওড়ের দিক থেকে। জংলা ভিটার বাঁশ আর বেত-বনে প্রবল হাওয়া এসে সারাক্ষণ বোঁ-বোঁ শো-শোঁ আওয়াজ তুলছে। চিরদিনের চেনা জায়গা হঠাৎ করে যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে সবুজ রঙের ছোট্ট সোহাগী। নাইওরিদের আসবার সময় হয়েছে।
গভীর রাত্রে হাওড়ের নৌকার আলোগুলি কি অদ্ভুতই না লাগে। বিদেশী নায়ের মাঝিরাও লোহাগীর দিকে অবাক হয়ে ঢাকায়।
টেনে টেনে জিজ্ঞেস করে– কোন গ্রাম? কো-ও-ও-ন-গ্রা—ম?
সোহাগী, গ্রামের নাম সোহাগী।
চারদিকের অথৈ জলের মাঝখানে ছোট্ট গ্রামটি ভেসে থাকে। চৌধুরীবাড়ির লোকজন সাদা কেরোসিন তেলের হারিকেন জ্বালিয়ে সারা রাত হিজল গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। গভীর রাত্রে যখন গ্রামের সব আলো নিভে যায় তখন সেই আলো মিটমিট করে জ্বলে। দূর থেকে সেই আলো দেখে সোহাগীর নাইওরি মেয়েরা আহ্লাদে নৌকা থেকে চেচিয়ে ওঠে, ওই আমার বাপের দেশ, ওই দেখা যায় চৌধুরীবাড়ির লণ্ঠন। গাঢ় আনন্দে তাদের চোখ ভিজে ওঠে।