এ বৎসর খুব ভালো ফলন হয়েছে সোহাগীতে। লগ্নির ধান দেওয়ার পরও ধান। রাখার জায়গা নেই। আবুল কালামের মতো হতদরিদ্র ভাগচাষীরও খোরাকি ছাড়াই পঁচিশমণ ধান হল। এমন অবস্থায় জমকালো বাঘাই সিন্নি হবে, তা বলাই বাহুল্য। ধন কাটা শেষ হবার পরই প্রথম পূর্ণিমায় বাঘাই সিনির দল বেরুল। এই সব সাধারণত ছেলেহোকরার ব্যাপার। কিন্তু আমিন ডাক্তারের সে-খেয়াল নেই। দলের পুরোভাগে সে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচে-কুঁদে এক হুলস্থূল ব্যাপার। মূল গায়ক এক জন, অন্য সবাই ধুয়া ধরে :
(মূল গীত)
আইলাম গো
যাইলাম গো
বাধাই সিন্নি চাইলাম।
(ধুয়া) চাইলাম গো। চাইলাম গো।
এই পর্যায়ে হাত-পা ছুঁড়ে নাচ শুরু হয়। মেয়েরা মুখে আচল চাপা দিয়ে হাসতে-হাসতে বাঘাই সিন্নির জন্যে ধামাভর্তি চাল বের করে দেয়।
আমিন ডাক্তারকে দেখে বয়স্কদের অনেকেই দলে ভিড়ে গেল। সুবহান আলির মতো রাশভারি মাতবর ব্যক্তি পর্যন্ত বাঘাই সিনির গানের ধুয়ায় সামিল হল।
সিন্নির আয়োজন হয়েছে উত্তর বন্দে। চারদিকে ফকফকা জ্যোৎস্না, দূরে সোহাগী গ্রাম ছবির মতো দেখা যায়। খোলা প্রান্তরে হাওয়া এসে শো-শোঁ বোঁ-বোঁ শব্দ তোলে। বাঘাই সিৱি দিলের উৎসাহের কোনো সীমা থাকে না। এক দিকে সিন্নি রান্না হয়, অন্য দিকে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে বাঘাই সিনির গান হয়। বড়ো গাঙ দিয়ে বিদেশী নৌকা যায়। তারা কৌতূহলী হয়ে হাঁক দেয়, কোন গ্রাম?
সোহাগী?
বাঘাই সিনি নাকি গো?
হ ভাই।
কেমন জমল?
জব্বর।
হই হো হেই হো।
শুধু খোরাকির ধান রেখে বাকি সব ধান আজরফ নীলগঞ্জের হাটে বিক্রি করে দিল। শরিফা আপত্তি করছিল। কিন্তু আজরফ শক্ত সুরে বলল, ধান থাকলেই খরচ হইব–যে জিনিসের দরকার নাই, সেইটাও কিনা হইব।
যুক্তি অকাট্য। ইতোমধ্যেই নৌকা সাজিয়ে বেদেনীরা আসতে শুরু করেছে। শাড়ি চুড়ি থেকে শুরু করে পিঠা বানানর ছাঁচ–কী নেই তাদের কাছে? কিনতে কারোর গায়ে লাগে না। নগদ টাকা দেওয়ার ঝামেলা নেই, ধান দিলেই হয়।
আজরফ নীলগঞ্জের হাটে ধান বেচে কত টাকা পেল, তা শরিফা পর্যন্ত জানতে পারল না। শরিফা খুব বিরক্ত হল, কিন্তু নিজে থেকে জানতে চাইল না। টাকাপয়সার হিসাব পুরুষমানুষের কাছে থাকাই ভালো। আর এই সংসারে পুরুষ বলতে তো এখন আজরফই আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই যেন ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে চলাফেরা করে। যন্ত্রের মতো কাজ করে। নীলগঞ্জ থেকে সে এবার অনেক জিনিসপত্র কিনেছে। নুরুদ্দিনের জন্যে এনেছে লুঙ্গি আর মাছ মারার বড়শি। তার এবং রহিমার জন্যে এসেছে শাড়ি। শরিফা দুঃখিত হয়ে লক্ষ করল, দুটি শাড়ির জমিনই এক রকম। দামও নিশ্চয়ই এক। রহিমা তার কে? থাকতে দেওয়া হয়েছে দয়া করে, এর বেশি আর কী? তার জন্যে সস্তার শাড়ি কি নীলগঞ্জের হাটে ছিল না? শুধু এখানেই শেষ নয়, অনুফার জন্যে সে একটা জামাও এনেছে। জামায় বড়ো বড়ো ছাপার ফুল। মেলা দাম নিশ্চয়ই।
বর্ষা এসে গেছে। ক দিন ধরেই ক্ৰমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাটে এক হাঁট কাদা। আজরফ ঘরেই বসে থাকে। করার তেমন কিছু নেই। আগামী পাঁচ মাস ধরে জোয়ান মর্দ ছেলেরা ফড় খেলবে, যোলকটি খেলবে। কেউ কেউ ফুর্তির খোঁজে চলে যাবে উজান দেশে। এই পাঁচ মাস বিশ্রামের মাস, ফুর্তির মাস।
শরিফা খবর পেল। আজরফ যাচ্ছে উজান দেশে। কী সর্বনাশের কথা। এইটুক ছেলে, সে যাবে উজানে? উজানের মেয়েগুলি ফষ্টিনষ্টিতে ওস্তাদ। কী থেকে কী হবে–কে জানে। তার উপর বাজারের খারাপ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়লে ফতুর হয়ে আসতে হবে। কিন্তু আজরফের উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে কাজকর্মের খোঁজে যাবে। উজান মুলুক থেকে কিছু টাকাপয়সা যদি আনা যায়, তাহলে ধানবেচা টাকার সঙ্গে যোগ করে জমি রাখা যাবে। শরিফা স্তম্ভিত।
আমরারে দেখাশোনা করব কে?
নূরা আছে। রহিমা খালা আছে, তারা দেখব।
শরিফা কাঁদে খুনখুন করে। আপন মনে বিড়বিড় করে, রক্তের মধ্যে দোষ। ঘরে মন টিকে না। রহিমাকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ছেলেডা কি বিয়া করতে চায়?
রহিমা মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, না বুজি।
হাস ক্যান রহিমা? হাসির কথা কিছু কই নাই। বিয়া যখন করতে চায় তখন পুলাডি এই রকম ঘর ছাড়নের ভয় দেখায়।
না বুজি, বিয়া করব কি। বাচ্চা পুলা।
আজরফকে এখন আর বাচ্চা পুলা বলা যায় না। গম্ভীর হয়ে দাওয়ায় যখন বসে থাকে, তখন শরিফার পর্যন্ত সমীহ করে কথা বলতে ইচ্ছা করে।
এর মধ্যে হঠাৎ মতি মিয়ার একটি চিঠি এসে উপস্থিত। শম্ভুগঞ্জ থেকে লেখা। আমিন ডাক্তার এসে চিঠি পড়ে দিয়ে যায় ও মদন থানার রাধাপুর ইউনিয়ন বোর্ডর প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে একটি সোনার মেডেল দিয়াছেন। মেডেলটি ছয়আনি ওজন—-
মেডেলের ব্যাপারটি সর্বৈব মিথ্যা। রূপার একটি মেডেল সাড়ে তিন টাকা খরচ করে মতি মিয়া নিজেই কিনেছে। আসরে নামার সময় গায়ে কোনো মেডেল না থাকলে লোকজনের ভক্তি পাওয়া যায় না। আমিন ডাক্তারকে চিঠিটি তিন-চার বার পড়ে শোনাতে হয়। সেরাত্রে তাকে খাওয়াদাওয়াও করতে হয়। ডাক্তার হৃষ্ট চিত্তে শরিফাকে বলে, বুঝছেন নি দোস্তাইন, মতি মিয়া কানা নিবারণরে ছাড়াইয়া যাইব কইয়া রাখলাম।
শরিফাকে এই সংবাদে খুব উল্লসিত মনে হয় না।
বর্ষার জন্যে অসুখবিসুখ হতে শুরু করেছে। পেট খারাপ, জ্বর–অসুখ বলতে এই দুটিই। মানুষের হাতে টাকা আছে। কিছু হতেই ডাক্তারের ডাক পড়ে। কাজেই আমিন ডাক্তারের ভালো সময় যাওয়ার কথা। কিন্তু তা যাচ্ছে না। বর্ষার আগে আগে নতুন এক জন ডাক্তার এসে পড়েছে।