আমিন ডাক্তার বাড়ির পেছনে খোলা চুলায় রান্না চাপিয়েছে। রান্নার আয়োজন নগণ্য। ঝিঙ্গে তাজি আর খেসারির ডাল। ভেজা কাঠের জন্যে প্রচুর ধোঁয়া উঠছে চুলা থেকে। নুরুদ্দিন গিয়ে দেখে, একটা কাঠের চোঙায় মুখ দিয়ে আমিন ডাক্তার প্রাণপণে ফু দিচ্ছে। তার নিজের চোখ-মুখ লাল। কি রে নুরা, কী চাস? ভাত খাইবি?
নাহ্।
না কিরে ব্যাটা? ঝিঙ্গা ভাজা করলাম। গাওয়া ঘি আছে, দিয়াম নে এক চামুচ।
আইজ না চাচাজী। বাজানের একটা চিডি আনছি, পইড়া দেন। মতি মিয়া নিজেও লেখাপড়া জানে না। কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে—
আজরফ মিয়া দেয়াগো,
আশা করি পরম করুণাময় আল্লাহতালার কৃপায় সুস্থ শরীরে শান্তিমতো আছ। পর সমাচার এই যে, আমরা দল লইয়া অতি শীঘ্ৰ নেত্রকোণা যাইতেছি। বিবেকের গান খুব নাম কামাইয়াছে। স্বয়ং কানা নিবারণও বলিয়াছে–গলা খুব উত্তম। কিন্তু দুঃখের বিষয় পুরাতন বিবেক ফিরিয়া আসিয়াছে। কাজকর্ম ঠিকমতো করিবা। নতুন ধান উঠিবামাত্র আমাকে নি ঠিকানায় বিশটি টাকা অতি অবশ্য পাঠাইবা। কিঞ্চিৎ আর্থিক অসুবিধায় আছি। আজ এই পর্যন্ত। ইতি।
আমিন ডাক্তার চিঠি শেষ করে ভ্রূ কুঞ্চিত করে রইল। চিঠিতে করে ফিরবে, কি, কোনো উল্লেখ নেই। সবচেয়ে বড় কথা শরিফার কোনো কথা নেই।
আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, তর মায়ের কথাও লেখছে কোণাদিয়া— তোমার মাতার কথাও সর্বদা স্মরণ হয়। তুমি তাহার যথাসাধ্য যত্ন করিবাস্। নুরা তোর মায়েরে কইছ। তার কথাও লেখা।
আইচ্ছা। আর চাচাজী, আইজ আমরার ধান মাড়াই। আপনের যাওন লাগব। ২০৮।
দেহি।
দেহাদিহি নাই, যাওন লাগব।
রুগীইগী না থাকলে যাইয়াম নে এক ঘুরান।
ধান মাড়াইয়ের ব্যাপারে নুরুদ্দিনের খুব উৎসাহ।
মাঝরাতের দিকে চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ধান মাড়াই শুরু হবে। চলবে সারা রাত। এক জন পালা করে থাকবে গরুর পেছনে, অন্য সবাই দল বেঁধে উঠোনে বসে। গল্প শুনবে। গল্প বলার জন্যে কথক আছে। তাদের বড়ো দাম এই রাত্রে। পানতামাকের ডালা খোলা। শেষত্রে পিঠা-চিড়ার ব্যবস্থা।
নুরুদ্দিনের খুব ইচ্ছায় এবারও গত বারের মতো আলাউদ্দিনকে খবর দেওয়া হয়। পেশায় সে চোর, কিন্তু তার মত বড় কথক ভাটি অঞ্চলে আর নেই। সে যখন কোমরে লাল গামছা পেঁচিয়ে দু হাত নেড়ে কিচ্ছা শুরু করে, তখন নিঃশ্বাস ফেলতে পর্যন্ত মনে থাকে না।
শুনে শুনেন দশ জনাতে
শুনেন দিয়া মন।
লাল চাঁন বাদশার কথা হইয়াছে স্মরণ
তারপর হেই লাল চাঁন বাদশা উজির সাবরে ডাইক্যা কইল–ও উজির, একটা কথার জবাব দেও দেহি।
বাড়ি ফিরে নুরুদ্দিনের খুব মন খারাপ হল। কথক আলাউদ্দিন নিমতলি গিয়েছে, সন্ধ্যায় ফেরবার কথা, এখনো ফেরে নি। যদি না ফেরে? তার চেয়ে বড় কথা, শরিফা রেগে গিয়ে খড়ম ছুঁড়ে মেরেছে অনুফার দিকে। সেই খড়ম কপালে লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড। অনুফা বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। রহিমা মুখ কালো করে ঘরের কাজকর্ম করছে। নুরুদ্দিন অনুফার খোঁজে বেরুল। সে কোথায় আছে তা জানা। ছোট গাঙের পাড়ে জলপাই গাছের কাছে এসে নুরুদ্দিন ডাকল, ও অনুফা।
অনুফা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল।
আয়, বাড়িত যাই।
অনুফা কোনো আপত্তি করল না।
বড়ো অন্ধাইর, হাত ধর অনুফা।
অনুফা এসে হাত ধরল। নুরুদ্দিন বলল, আইজ ধান মাড়াই, জানস?
জানি।
আলাউদ্দিন আইত না।
অনুফা মৃদু স্বরে বলল, আইব।
কী কস তুই।
দেখবা তুমি, আইব।
তুই খুব পাগলী অনুফা।
অনুফা খিলখিল করে হাসল। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল আলাউদ্দিন তার দল নিয়ে এসে পড়েছে। চাঁদ এখনো ওঠে নি। অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আলাউদ্দিনের রোগা লম্বা শরীর। সে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে হুক টানছে।
কিচ্ছা শুরু হল অনেক রাত্রে। গ্রামের অনেকেই এসেছে। আজরফ হচ্ছে ঘরের কর্তা, পান-তামাক এগিয়ে দিচ্ছে। বউ-ঝিরা ভেতরবাড়িতে। আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য, চৌধুরী সাহেবও এসেছেন। তাঁর জন্যে চেয়ার আনা হয়েছে।
আলাউদ্দিন কোমরে লাল গামছা পেঁচিয়ে কিচ্ছা শুরু করেছে। সেই পুরান লাল চাঁন বাদশার গল্প। কিন্তু এ গল্প কি আর সত্যি সত্যি পুরনো হয়?
(গীত)
শুনে শুনেন দশ জনাতে
শুনেন দিয়া মন।
লাল চাঁন বাদশার কথা হইয়াছে শরণ।
লাল চাঁন বাদশার মনে বড়ো দুঃখ ছিল,
বার বল্প পার হইল পূত্র না জন্মিল।
লাল চাঁনের দুঃখ দেইখ্যা কান্দে গাছের পাতা
…………
উত্তর বন্দের সমস্ত ধান
উত্তর বন্দের সমস্ত ধান কাটা হওয়ার পরপরই ফিরাইল সাব চলে গেলেন। যাবার পর দিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হল। তা তো হবেই, মাঠ-বন্ধন নেই। শিল আটকাবার আসল লোকই নেই। কালাচান খবর নিয়ে এল–ফিরাইল সাবের জন্যে উত্তর বলে যে খড়ের ছাউনি করা হয়েছিল, তার চিহ্নমাত্র নেই। শিলাবৃষ্টিতে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সোহাগীর লোকজন স্তম্ভিত।
ফিরাইলের সাবের উপরে রাগ রইছে, বুঝলা না বিষয়টা?
রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। ফিরাইল সাব এই বৎসর উত্তর বলে শিল পড়তে দেন নি। সমস্ত নিয়ে ফেলেছেন নিমতলির বন্দে। ফিরাইল সাব বিদায় নেওয়ার আগে গ্রামে এসে উঠলেন কিছুক্ষণের জন্যে। গ্রামের বউ-ঝিরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে অবাক হয়ে ঢাকায়। দেখেই বোঝা যায় বড়ো সহজ লোক ইনি নন। তাঁর সাথে চালাকি চলবে না। শুকনো দড়ি-পাকান চেহারা। মাথার লম্বা চুলে জট বেঁধে গিয়েছে। হাতে জীয়ল গাছের শিকড়ে তৈরী একটি বাঁকা লাঠি। ফিরাইল সাব যাবার আগে বারবার বলে গেলেন–নিমতলির তালগাছের নিচে তিনটা বড়ো শউল মাছ পুড়িয়ে ভোগ দিতে। তালগাছে যে বিদেহী প্রাণীটি বাস করে, তাকে তুষ্ট রাখা খুবই প্রয়োজন। বাজ পড়ে যদি তাল গাছ দুটির একটিও পুড়ে যায়, তাহলে সমূহ বিপদ। বিপদ যে কী, তা তিনি ভেঙে বললেন না। পোয়াতি মেয়েছেলেদের উপর কঠোর নির্দেশ, তারা যেন কোনক্রমেই অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা–এই দুই চাঁদে উত্তর বন্দে না যায়।