শক্ত কইরা মাতা ধর। পানিত যেন না পড়ে, সাবধান।
পাকা বৰ্ণেলের মতো মুখ করে নুরুদ্দিন দ্বিতীয় বার ছিপ ফেলতে যায়। কিন্তু বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, এখন আর মাছে খাবে না।
চল, বাড়িত যাই অনুফা।
না।
না কি? দিয়াম এক চড়। বিষ্টি পড়ছে দেখস না?
পড়ুক বলেই অনুফা মাছ হাতে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে গেল। এই তার একটা খেলা। দৌড়তে দৌড়তে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হবে, কোথাও এক দণ্ডের জন্যে থামবে না।
জংলা ভিটা থেকে বেরিয়ে নুরুদ্দিন দেখে খুব মেঘ করেছে। ডেফল গাছের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যায় নি। নুরুদ্দিন দৌড়াতে শুরু করল। অনেকখানি ফাঁকা জায়গা পার হতে হবে। রানীমার পুকুরপাড়ে উঠে আসার আগেই সে ভিজে ন্যান্যা হয়ে গেল। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে সিরাজ চাচার নতুন চালাঘর। লালচাচী ছোটাছুটি করে ধান তুলছে। শুকাতে দেওয়া ধানের বেশির ভাগই গেছে ভিজে। লালচাচী নুরুদ্দিনকে দেখেই চেচিয়ে বললেন, নুরু, হাত লাগা। তর চাচা আইজ খুব চেত।
ধান তোলা শেষ হতেই বৃষ্টি থেমে গেল। লালচাচী হাসিমুখে বললেন, কাটা কেমুন হইল নুরা?
বিষ্টি আবার আইব চাচী।
ধান তো বেবাক ভিজছে নুরা। করি কী এখন ক দেহি? একলা মানুষ আমি, অত ধান শুকাইতে পারি? তুই বিবেচনা কর দেহি?
নুরুদ্দিন বেশ খানিকক্ষণ বসে রইল লালচাচীর ঘরে। লালচাচীকে সে বেশ পছন্দ করে। নুরুদ্দিনের ধারণা, লালচাচীর মতো সুন্দরী (এবং ভালে) মেয়ে সোহাগীতে আর একটিও নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, লালচাচী তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে–যেন সে এক জন অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি। ও নুরা, তোর চাচারে কইলাম আমার হোড ভাইটারে আইনা রাখতে–কাজকামে সাহায্য হইব। তোর চাচা কী কয় জানস?
কী কয়?
কয়, চোরের গুষ্টি আইনা লাভ নাই।
কথাডা ঠিক অয় নাই চাচী, অলেহ্য হইছে।
আমার দাদা চোর আছিল, এইডা অস্বীকার যাই ক্যামনে? কিন্তুক হেইডা কোন আমলের কথা! পুরান কথা তুইল্যা মনে কষ্ট দেওন কি ঠিক?
না, ঠিক না চাচী।
হেইদিন তরকারির লবণ এটু বেশি হইছে, তোর চাচা কয়–চোরের গুষ্টির রান্দাবাড়া শিখনের তো কথা না।
কথাডা অলেহ্য হইছে চাচী।
অত চোর-চোর করলে বিয়া করল ক্যান? আমি কি পায়ে ধইরা সাধছিলাম?
ঠিক কথা চাচী।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। লালচাচী কিছুতেই ছাড়বে না। বাপের বাড়ির পুরনো সব গল্প আবার শুনতে হল। গুড় দিয়ে এক থালা মুড়ি খেতে হল।
বাড়ি ফিরে নুরুদ্দিনের মুখ শুকিয়ে গেল। আজরফ নাকি তাকে বেশ কয়েক বার খোঁজাখুঁজি করেছে। আজরফকে আজকাল সে খুব ভয় পায়। আজরফ তাকে কিছুই বলে না। তবু কেন জানি ভয়ভয় লাগে। শরিফা বলল, বিষ্টি-বাদলা না। হইলে রাইতে ধান মাড়াই দিতে চায়। তরে খুঁজছিল, কী যেন কইতে চায়।
কী কইতে চায়?
জিগাই নাই। অত কথা আমি জিগাই না।
নুরুদ্দিনের মনে হল, শুধু সে একা নয়–তার মা নিজেও আজকাল আজরফকে সমীহ করে চলে।
বন্দের মইধ্যে গিয়া জিগাইতাম?
যা, জিগা গিয়া।
উত্তর বলে আজ খুব কাজের ঘটা। ফিরাইল সাব বলেছেন, দু-এক দিনের মধ্যে প্ৰচণ্ড শিলাবৃষ্টি হবে। সেই শিলা ফেরাবার ক্ষমতা তাঁর নেই। কাজেই সম্ভব হলে আজকের মধ্যেই যেন ধান তুলে ফেলা হয়। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। মশা তাড়াবার জন্যে ভেজা খড় পুড়িয়ে ধোঁয়া করা হয়েছে। ছোট ঘোট ছেলেমেয়েরা জ্বলন্ত খড়ের দড়ির কাছে হুঁকো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খুব কাজের চাপ তাদের। ডাক পড়তেই হঁকো নিয়ে ছুটে যেতে হচ্ছে। ধানকাটার পুরো দলটি বৃষ্টিতে ভিজে জবজব। উত্তর বলেও আধ হাতের মতো পানি। ঘনঘন হুকায় টান দিয়ে শরীর চাঙ্গা করে নিতে হয়। উজান দেশের বেশ কিছু কামলা এসছে ধান কাটতে। এদের হয়েছে অসুবিধা। দিন-রাত পানিতে থাকার অভ্যাস না থাকায় হাত-পা হেজে গিয়েছে। তারা ক্ষণে ক্ষণে কাজ ফেলে শুকনায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আজরফকে খুজে বের করতে বেশ দেরি হল। উত্তর বন্দে আজ সবাই ধান কাটছে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় লোকজন চেনা যাচ্ছে না। তার উপর আজরফ কার জমিতে কাজ করছে তাও ঠিক জানা নেই। তাদের নিজেদের জমির সবটাই পুব বন্দে।
নুরুদ্দিন গলা উচিয়ে ডাকল, ও ভাইসাব।
খুব কাছ থেকে উত্তর হল, এই দিকে আয় নুরা।
আমারে নি খুঁজছিলা?
আজরফ কাজ থামিয়ে উঠে দাঁড়াল। লুঙ্গির গেজ থেকে একটা কাগজ বের করে বলল, বাজানের চিঠি। জলিল মাঝির সাথে পাঠাইছে। ডাক্তার চাচারে দিয়া পড়াইয়া আন।
আইচ্ছা।
আর হন, আইজ ধান মাড়াই হইব।
কোন সময়? রাইত।
গরু পাইবা কই?
কালাচান চাচারে কইয়া রাখছি। তুই আরেক বার গিয়া জিগা।
আইচ্ছা।
যা, বাড়িত যা।
ভাত খাই না?
আইজ সরকারবাড়িত খাইয়াম। হেরার ধান কাটতাছি।
একটা বোয়াল মাছ মারছি, দুই আত লম্বা।
আজরফ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জংলা বাড়ির ভিটাত আর যাইস না নুরা। জায়গাড়া খারাপ। দোষ আছে। হের উপরে আবার সাপের উপদ্রুপ।
নুরুদ্দিনের মুখে কথা ফোটে না। তার গোপন জায়গার কথা আজরফ কীভাবে জানল কে জানে।
বাড়িত যা নুরা।
উত্তর বন্দ থেকে একা-একা বাড়ি ফিরতে নুরুদ্দিনের বড়োই ভালো লাগে। এত বড়ো বন্দ এই অঞ্চলে আর নেই। দিন-রাত হাওয়ায় শো-শোঁ শব্দ তোলে। উত্তর পশ্চিমে তাকালে কিছুই চোখে পড়ে না। শুধু মনে হয়, দূরের আকাশ নেমে এসেছে মাটিতে। পুব দিকে তাকালে নিমতলি গ্রামের সীমানার তালগাছ দুটি আবছা চোখে পড়ে। তালগাছ দুটিতে দোষ আছে। গভীর রাত্রে মাছ মারতে এসে অনেকেই দেখেছে, একটা জাম্বুরার মতো বড়ো আগুনের গোলা গাছ দুটির মাথায়। এ গাছ থেকে ও গাছে যাচ্ছে, আবার ক্ষণে ক্ষণে মিলিয়ে যাচ্ছে।