রুগী দেখে আমিন ডাক্তার স্তম্ভিত। নয়-দশ বৎসরের একটা ছেলে। সমস্ত শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। চোখ ঘোর রক্তবর্ণ। শরীরে কোনো ব্যাথা বোধ নেই। মাঝে মাঝে মাথা তুলে বলছে, পেটের মইধ্যে পাক খায়।
আমিন ডাক্তার এক চামচ এলকালি মিকচার খাইয়ে শুকনো মুখে বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। নোগামতো একটা মেয়ে ছেলেটির হাত ধরে বসে ছিল, সে কাঁদতে শুরু করল। আমিন ডাক্তার বলল, নৌকার যোগাড় দেখেন, হাসপাতালে নেওন লাগব। দিরং করন যাইত না।
ডাক্তারদের জন্যে পান-তামাক দেওয়া হয়েছে বাহির-বাটিতে। সিরাজুল ইসলাম কিছুই স্পর্শ করবে না। সে এক ফাঁকে আমিন ডাক্তারকে বলল, হাসপাতালে নেওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এই রুগী ঘন্টা পাঁচেকের বেশি থাকবে না। টাকা-পয়সা যা দেয় নিয়ে সরে পড়েন। রুগী মরলে পয়সাও পাবেন না। আপনাকে কেউ দিয়েও আসবে না। ছোটলোকের দেশে কেউ ডাক্তারী করে?
আমিন ডাক্তার থেমে বলল, ওর হইছে কী?
কিছু বুঝতে পারছেন না?
না।
হুঁ। ওর কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরে পানি এসেছে, হাসপাতালেও কিছু করতে পারবে না।
কিছুই করণের নাই?
না।
সিরাজুল ইসলাম উঠে পড়ল। বেরুবার আগে বলল, আমি নিজের নৌকা নিয়ে। এসেছি। যদি যেতে চান যেতে পারেন।
এই রকম রুগী ফালাইয়া যাই ক্যামনে? থাকেন তাহলে।
সমস্ত দিন কাটল এইভাবে। রাত্রে অবস্থা খুব খারাপ হল। আমিন ডাক্তার বিষণ্ণ মুখে ঘরের দাওয়ায় বসে রইল। বেশ কয়েক বার ছেলের বাবাকে বলল, হাসপাতালে নেওন খুব দরকার। দিরং হইতাছে।
কেউ রুগী নাড়াচাড়া করতে রাজি হল না। নিমতলির পীর সাহেবকে আনতে নাকি লোক গিয়েছে। তিনি এসে যা বলেন, তা-ই করা হবে। পীর সাহেব মাঝরাত্রে পৌঁছলেন। ছোটখাট হাসিখুশি এক জন মানুষ। রুগীকে হাসপাতালে নেওয়া ঠিক হবে কিনা জানতে চাইতেই বললেন, ডাক্তার সাব যদি নিতে কন, তা হইলে নেন লাগব। ব্যবস্থা করেন। কিন্তু রুগী দেখে তাঁর মত বদলাল। শান্ত স্বরে বললেন, হাতে সময় বেশি নাই।
ভোরাত্রে ছেলেটি হঠাৎ সুস্থ মানুষের মত মাথা তুলে বলল, শীত লাগে বাজান।
চার-পাঁচটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আমিন ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, শীত কমছে?
ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, শীত লাগে। জর শীত লাগে। ও বাজান, শইলডার মইধ্যে খুব শীত।
ফজরের আজানের পরপর ছেলেটি মারা গেল। ছেলের মা খুব কাঁদছিল। কে যেন বলল, কাইলেন না। মতের সময় কান্দন হাদিসে মানা আছে।
নিমতলির পীর সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, দুঃখের সময় না কাঁদলে কোন সময় কাঁদব? কান্দুক, খুব জুরে জুরে কান্দুক।
বাড়ির সামনে একটি কাঁঠালগাছের নিচে দুপুর পর্যন্ত বসে রইল আমিন ডাক্তার। পকেটে কিছুই নেই যে একটা কেরাইয়া নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। এমন অবস্থায় কাউকে বাড়ি ফেরার কথাও বলা যায় না। পেটে অসম্ভব খিদে, মরা বাড়িতে চুলা ধরা হবে না, কাজেই খাওয়াদাওয়া হবে কিনা বলা মুশকিল। দুপুরের রোদ একটু পড়তেই আমিন ডাক্তার হেঁটে চলে গেল নিমতলি। নিমতলি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক পহর রাত হল। সেখান থেকে সোহাগী এল জলিলের নৌকায়। তখন মাঝরাত্রি, ঘরে খাবার কিছুই নেই। একটি টিনে চিড়া ছিল, সেটিও শূন্য। মতি মিয়ার বাড়িতে গেলে হত। কিন্তু এই দুপুররাত্রে যাওয়া ঠিক নয়। .
খিদের জন্য ঘুম হল না। ঘরের ভেতর অসহ্য গরম মশারিটি শতচ্ছিন্ন। ভভন করছে মশা। নতুন মশারি একটি না কিনলেই নয়। আমিন ডাক্তার শুয়ে শুয়ে কত কথাই না ভাবে। কত বিচিত্ৰ কথা মনে আসে। সুখানপুকুরের এক রুগী মরবার আগে হঠাৎ খুব আবক হয়ে বলেছিল, ঠাণ্ডা হাত দিয়া আমারে কে ছুইছে। ও ডাক্তর, বড় শীত লাগে। বড় শীত লাগে। বড় শীত।
মরবার আগে সবারই শীত লাগে কিনা, আমিন ডাক্তারের খুব জানতে ইচ্ছা করে।
মাছ মারার জায়গা
নুরুদ্দিন খুঁজে খুঁজে চমৎকার একটি মাছ মারার জায়গা বের করেছে। বাড়ি থেকে সোয়া মাইল দূরে জংলা ভিটার ভাঙা ঘাট। জায়গাটি বড়ো নির্জন। দু পাশ অন্ধকার করে আছে ঘন কাঁটাবন। ভাঙা ঘাটের ফাঁকেফুঁকে সাপের আড্ডা। সে জন্যেই বড়ো কেউ আসে না এ-দিকটায়। ঘাটের লাগোয়া প্ৰকাণ্ড একটা ডেফল গাছে পাকা ডেফল টুকটুক করে। নুরুদ্দিন ছিপ ফেলে ডেফল গাছে হেলান দিয়ে সারা দুপুর বসে থাকে।
তার সঙ্গে প্রায়ই আসে অনুফা। সে নুরুদ্দিনকে বিরক্ত করে না। লম্বা একটি নারিকেলের ডোগা হাতে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে কীসব কথা বলে। নুরুদ্দিন মাঝে মাঝে ধমক দেয়, এ্যাই চুপ। অত কথা কইলে মাছ আই?
অনুফা অল্প কিছু সময়ের জন্যে চুপ করে আবার গুনগুন শুরু করে।
এ্যাই, অনুফা পাগলী নাহি তুই?
অনুফা রাগ করে না। খিলখিল করে হাসে। নুরুদ্দিনের বড় মায়া লাগে।
মাছ মারার এই জায়গাটা নুরুদ্দিন খুব সাবধানে গোপন করে রাখে। ঘাস কাটার জন্যে খোন্দায় করে কৈবর্তপাড়ার মাঝিরা এই খাল দিয়ে বড়ো গাঙের দিকে যায়। শব্দ পেলেই ডেফল গাছের আড়ালে চট করে লুকিয়ে পড়ে নুরুদ্দিন। তবু কেউ কেউ দেখে ফেলে। তখন বড়ো ঝামেলা হয়।
এইডা কে? মতি ভাইয়ের পুলা না? এই, কী করস তুই?
মাছ মারি।
মাছ মারস? মাথা খারাপ নাহি তর? এইডা মাছ মারণের জায়গা? যা, বাড়িত যা।
মাছ মারার জন্যে জায়গাটা কিন্তু খারাপ নয়। আজকেও নুরুদ্দিন দু হাত লম্বা একটা বোয়াল মেরে ফেলল।
অনুফার বিষ্ময়ের সীমা রইল না, ও বাসরে, এইডা তো জব্বর মাছ নুরু ভাই!