- বইয়ের নামঃ ফেরা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
মতি মিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছিল
ফেরার গল্প ভাটি অঞ্চল নিয়ে।
আমার নানার বাড়ির দেশ, যেখানে শৈশবের বর্ণাঢ্য দিনগুলি কাটিয়েছি। গল্পের মূল চরিত্রের কেউ আর বেঁচে নেই। তাদের কথা আজ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে করছি।
গল্পে বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছি। কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে অপ্রচলিত আঞ্চলিক শদের একটি নির্ঘন্ট বইয়ের শেষে জুড়ে দিয়েছি। ভাটি অঞ্চলের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গে সাহায্য করেছেন আমার মা এবং আমার হোটমামা মাহবুবুন্নবী শেখ। তথ্যগত ভুল কিছু থাকলে তার দায়দায়িত্ব তাঁদের।
ফেরা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ঈদ সংখ্যা উত্তরাধিকারে (১৯৮৩)।
০১.
মতি মিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছিল।
আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সঙ্গে ছাতাফাতা কিছুই নেই, বৃষ্টি নামলে ভিজে ন্যান্যাতা হতে হবে।
মতি মিয়া হনহন করে ডিসট্রিক্ট বোর্ডর সড়ক ছেড়ে সোহাগীর পথ ধরল। আর তখনি বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। মতি মিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না। সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা দরকার। শরিফার পা ফুলে ঢোল হয়েছে। কাল সারা রাত কোঁ-কোঁ করে কাউকে ঘুমাতে দেয় নি। সন্ধ্যার পর আমিন ডাক্তারের এসে দেখে যাবার কথা। এসে হয়তো বসে আছে। মতি মিয়া গম্ভীর একটা ঝাঁকড়া জামগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।
দেখতে দেখতে বৃষ্টির বেগ বাড়ল। ঢালা বর্ষণ, জামগাছের ঘন পাতাতেও আর বৃষ্টি আটকাচ্ছে না, দমকা বাতাসের শো-শোঁ আওয়াজ। দিনের যা গতিক, ঝড়-তুফান শুরু হওয়া বিচিত্র নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কোন অর্থ হয় না। মতি মিয়া উদ্বিগ্ন মুখে রাস্তায় নেমে পড়ল। পা চালিয়ে হাঁটা যায় না। বাতাস উল্টো দিকে উড়িয়ে নিতে চায়। নতুন পানি পেয়ে পথ হয়েছে দারুণ পিছল। ক্ষণে ক্ষণে পা হড়কাচ্ছে। সরকারবাড়ির কাছাকাছি আসতেই খুব কাছে কোথায় যেন প্ৰচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। আর আশ্চর্য, বৃষ্টি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মতি মিয়া অবাক হয়ে শুনল সরকার বাড়িতে গান হচ্ছে। কানা নিবারণের গলা বাতাসের শো-শোঁ শব্দের মধ্যেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে,
আগে চলে দাসী বান্দি পিছে ছকিনা,
তাহার মুখটি না দেখিলে প্ৰাণে বাঁচতাম না
ও মনা ও মনা …..
সরকারবাড়ির বাংলাঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। মতি মিয়া ধাক্কা দিতেই নাজিম সরকার মহা বিরক্ত হয়ে দরজা খুললেন। হ্যাঁ, কানা নিবারণই গাইছে। সেই গাট্টাগোট্টা চেহারা, পান-খাওয়া হলুদ রঙের বড়ো বড়ো কুৎসিত দাঁত। কানা নিবারণ গান থামিয়ে হাসিমুখে বলল, মতি ভাই না? পেন্নাম হই। অনেক দিন পরে দেখলাম।
মতি মিয়া বড়োই অবাক হল। কানা নিবারণের মতো লোক তার নাম মনে রেখেছে। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। কানা নিবারণ গম্ভীর হয়ে বলল, মতি ভাইরে একটা গামছা-টামছা দেন।
কেউ গা করল না। নাজিম সরকার রাগী গলায় বললেন, ভিজা কাপড়ে ভিতরে আসলা যে মতি? দেখ ঘরের অবস্থা কী করছ। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আর হইল না, ছিঃ ছিঃ।
কানা নিবারণ বলল, ঘরে না আইসা উপায় কি? বাইরে ঝড়-তুফান।
নাজিম বড়োই গম্ভীর হয়ে পড়লেন। থেমে থেমে বললেন, তুমি গান বন্ধ। করলা কেন নিবারণ?
কানা নিবারণ সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু করল–
দুধের বরণ সাদা সাদা কালা দিঘির জল
তাহার মনের গুপ্ত কথা আমারে তুই বল।
মনটা উদাস হয়ে গেল মতি মিয়ার। শরিফা বা আমিন ডাক্তার কারোর কথাই মনে রইল না। কন্যার মনের গুপ্ত কথাটির জন্যে তারো মন কাঁদতে লাগল। আহা, এত সুন্দর গান কানা নিবারণ কী করে গায়? কী গলা।
গান থামল অনেক রাতে। ততক্ষণে মেঘ কেটে আকাশে পরিষ্কার চাঁদ উঠেছে। গাছের ভেজা পাতায় চকচক করছে জোঙ্গা। মতি মিয়া উঠোনে নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না এমন অদ্ভুত লাগে। বিড়ি টানতে টানতে নিবারণ বাইরে আসতেই মতি মিয়া বলল, কেমন চাঁদনি রাইত, দেখছেন নি নিবারণ ভাই?
চাঁদনি রাইত নিবারণকে তেমন অভিভূত করতে পারল না, বিড়িতে টান দিয়ে সে প্রচুর কাশতে লাগল। কাশির বেগ কমে আসতেই গম্ভীর হয়ে বলল, বাড়িত যান মতি তাই, রাইত মেলা হইছে।
আর গাওনা হত না?
নাহ, আইজ শেষ। ওখন বেশি গাই না। বুকের মধ্যে দরদ হয়।
ডাক্তার দেখান নিবারণ ভাই।
নিবারণ বিরক্ত মুখে এক দল থুথু ফেলে, চোখ কুঁচকে বলল, বাড়িত যান। আমার ডাক্তার লাগে না।
রাস্তায় নেমেই মতি মিয়া লক্ষ করল–আবার মেঘ করেছে। দক্ষিণ দিকে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চৌধুরীবাড়ির কাছাকাছি আসতেই দুই পহরের শেয়াল ডাকল। এতটা রাত হয়েছে নাকি? চারদিক নিশুতি। চাঁদ মেঘের আড়ালে পড়ায় ঘুঘটে অন্ধকার, গা ছমছম করে।
কেডা, মতি নাকি?
মতি মিয়া চমকে দেখে, হোট চৌধুরী। উঠোনে জলচৌকি পেতে খালিগায়ে বসে আছেন। এঁর মাথা পুরোপুরি খারাপ। গত বৎসর কৈবর্তপাড়ার একটা ছেলেকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন।
কে, একটা কথা কয় না যে? মতি নাকি?
জ্বি।
এত রাইতে কই যাও?
বাড়িত যাই।
তোমার বড় পুলাড়া তোমারে খুজতেছে। তোমার বৌয়ের অবস্থা বেশি বালা না। নীলগঞ্জে নেওন লাগব।
জি আচ্ছা।
জ্বি জ্বি কর কেন মতি মিয়া? তাড়াতাড়ি বাড়িত যাও।
মতি মিয়া তবু দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট চৌধুরীর অভ্যাস হচ্ছে ভালোমানুষের মতো কথা বলে হঠাৎ তাড়া করা। সে কারণেই চট করে সামনে থেকে চলে যেতে ভরসা হয় না।