ফরিদ।
বল।
চাচাজীর সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসবি। আমার এখানে চলে আসবি, স্ট্রেইট চলে আসবি। নো হেংকিপেংকি।
আমি হাসলাম। যার মানে হা-না–দুই-ই হতে পারে।
আসবি কিন্তু।
দেখি।
বুড়ো মিয়া, সিরিয়াস রুগী। রিকশা খুব ধীরে টানবেন। যান, আরেক টাকা বখশিশ–আস্তে চালালে। ফরিদা তেইশ টাকা দিয়ে দিস। শোন, হুড তুলে দে।
বাবা বর্তমানে আছেন নাজির ভাইয়ের সঙ্গে। নাজির হোসেন আমার বড় মামার ছেলে। বত্সর দুই আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছেন।
এই দুই বৎসরেই তিনি সমগ্র পাড়ায় একটা ত্রাসের সৃষ্টি করেন। সেই সময় তিনি আই. কম. পড়তেন। এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। তার পড়াশোনার কথা আমার মনে নেই, কিন্তু সাতসকালে বালির বস্তার উপর কিল-ঘুষির কথা মনে আছে। অল্পদিনের মধ্যে আমার বড়োভাইও তাঁর সঙ্গে জুটে গেলেন। এবং দুজন একই সঙ্গে ফেল করলেন।
ফেল করবার পর বড়ভাইয়ের উৎসাহ খানিকটা মিইয়ে গেল, কিন্তু নাজির ভাই বিপুল উৎসাহে নাজির ড্রামা ক্লাব খুলে বসলেন। সেই ক্লাবের রিহার্সেল হত আমাদের বাসায়। দারুণ হৈ-চৈ ব্যাপার! নাজির ভাইয়ের অনেক শাকরে জুটে গেলো। বাবার মতো লোক পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করতে শুরু করলেন।
ছোটখাট অনেক রকম কাণ্ডকারখানা নাজির ভাই করতে লাগলেন। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটি করলেন দুর্গাপূজার রাতে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে মডেল স্কুলের হেডমাস্টার অমিয় বাবুর মেয়ের গলা থেকে ওড়না টেনে পাগড়ি বানিয়ে তিনি মাথায় দিলেন এবং অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে বললেন, সুফিয়া, বালিকা, তুমি কি করে জানলে ইংরেজ বিজয়ে আমরা অক্ষম?
সেই রাতেই পুলিশ তাঁর খোঁজে এল। তিনি পালিয়ে গেলেন সরিষাবাড়ি এবং কাঠের ব্যবসায় লেগে গেলেন। বাবাকে শেষ বয়সে নাজির ভাইয়ের সাথে থাকতে হচ্ছে, এটা ভাবতেও কষ্ট। কিন্তু কোনো উপায় নেই।
বাবা হয়ত যৌবনে প্রচুর পাপ করেছিলেন, এখন তাঁর প্রায়শ্চিতের কাল চলছে। ভাসমান জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কিছুদিন বড়োভাইয়ের সঙ্গে। ভালোই ছিলেন। সকালে মর্নিংওয়াক করতেন। বিকেলে পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকতেন। তারপর ভাবীর সঙ্গে ঝামেলা হতে লাগল। যখনই যাই, নানান অভিযোগ–ভাবী নাকি ইচ্ছা করে তরকারিতে লবণ বেশি দিচ্ছে। কাজের মেয়েকে বলে দিচ্ছে যেন তাঁর ঘর পরিষ্কার না করা হয়। এখানে থাকার চেয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা ভালো।
নিয়ে গেলাম আমার ছোট বোন অণুর কাছে–নারায়ণগঞ্জে। মাস ছয়েক ভালোই থাকলেন। তারপর এক দিন তাঁর টিনের ট্রাংক আর দুটি চটের ব্যাগ নিয়ে গেলেন নাজির ভাইয়ের সঙ্গে। সেখানেই নাকি থাকবেন। এখন সেখানেও টিকতে পারছেন না। গত সপ্তাহে চিঠি পেয়েছি তিনি অনুর কাছে ফিরে যেতে চান! বেশি দিন তোতা আর বাচবেন না। শেষ কটা দিন মেয়ের সঙ্গে থাকতে চান। নাজির হচ্ছে পরের ছেলে। নিজের ছেলে-মেয়ে থাকতে পরের কাছে থাকবেন কেন? ইত্যাদি। মনে হয় না বাবার সে-আশা পূর্ণ হবে। অনু রাজি হবে না।
নাজির ভাই বাসাতেই ছিলেন। তাঁর মুখ এমনিতেই লম্বা। আমাকে দেখে সেই মুখ আরো লম্বা হয়ে গেল। আমি বললাম, কেমন আছেন নাজির ভাই?
ভালো। তুমি কেমন আছ?
ভালোই আছি।
হাসপাতালে নাকি ভর্তি হচ্ছ?
হুঁ।
হয়েছেটা কি? সিরিয়াস কিছু?
টিউমার।
ক্যানসার নাকি? না শুধু টিউমার?
জানি না, ডাক্তার তো কিছু বলে না।
এই সব জিনিস কি আর ডাক্তার আগ বাড়িয়ে বলবে? বুঝে নিতে হয়।
আমার মনে হল নাজির ভাই আমার অসুখের খবরে বেশ খুশিই হলেন। লোকটিকে আমি দেখতে পারি না। এই কারণেও এ রকম মনে হতে পারে। মানুষ যত খারাপই হোক, অন্যের অসুখে খুশি হয় না। তাছাড়া নাজির ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই।
ফরিদ।
জ্বি।
ফুপাকে আমার এখান থেকে নিয়ে যাও। তোমার ভাই বা বোনের কাছে রাখ। এখানে আর পোষাচ্ছে না।
ঠিক আছে।
ঠিক আছে না। এসেছ যখন, আজই নিয়ে যাও। আবার কবে আসবে, তার কোনো ঠিক আছে নাকি?
দেখি।
দেখাদেখি না। নানান রকম যন্ত্ৰণা। তোমরা তো অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েই খালাস।
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি সত্যি আজ নিয়ে যেতে হলে মুশকিল। কিন্তু নাজির ভাইয়ের যা ভাব দেখা যাচ্ছে, আজই হয়ত গছিয়ে দেবে।
বাবা বাসায় নেই?
বাজারে গেছে। এসে পড়বে। চা খাও।
না, চা খাব না।
ঠাণ্ডা কিছু খাবে?
নাহ্।
না কেন? খাও। একটা কোক খাও। পেটটা ঠাণ্ডা থাকবে।
আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে নাজির ভাই ভিতরে চলে গেলেন। এ বাড়িতে পর্দাপ্রথার ব্যাপার আছে। নাজির ভাইয়ের স্ত্রী বোরা পরেন। বাড়িতে কোনো পুরুষ কাজের লোক রাখা হয় না। নাজির ভাই নিজেও নাকি কোন পীরের কাছে যাতায়াত করছেন। গত বৎসর শুনেছিলাম হন্ধে যাবেন। লটারিতে নাম ওঠে নি। কোথায় বারো শ টাকা ঘুষ দিলেই ব্যবস্থা হয়। ঘুষ দিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে যাওয়া বাতিল করেছেন। এ বছর চেষ্টা করবেন।
নাজির ভাইয়ের বসবার ঘর বেশ সাজান। সাজানর ধরনটাও আধুনিক। ফ্রেমে বাঁধান কাবা শরিফের ছবি নেই। কামরুল হাসানের একটি পেইনটিং আছে। কার কাছ থেকে মাত্র সাড়ে তিন শ টাকায় কিনেছেন। দুটি আলমারি আছে, বই-এ ভর্তি। শংকর থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-রচনাবলী। এই সব বই নাজির ভাই পড়েন বলে মনে হয় না। তবে কেউ এক জন পড়ে নিশ্চয়ই। অনেকগুলি বই ছেড়া, যত্ন করে কাগজ দিয়ে মোড়া। পেছনে কলম দিয়ে নাম লেখা।