যাই আলতাফ সাহেব।
আচ্ছা।
আলতাফ পাঁচটা পর্যন্ত চেয়ারে বসে রইল। পাঁচটার ঘণ্টা পড়ার পর ফাইল গুছাতে শুরু করল, ঠিক তখন বড় সাহেবের পিয়ন এসে বলল, স্যার আফনেরে বুলায়। যে কোন বুদ্ধিমান মানুষ পিয়নের ডাকের ধরণ থেকে বুঝে ফেলবে বড় সাহেবের মেজাজ ঠিক না। আলতাফ কিছু বুঝতে পারল না।
বড় সাহেবের নাম মনসুর আলী। ছোটখাট ধরনের মানুষ। তিনি প্রচণ্ড গরমেও স্যুট পরে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি কারোর সাতে পাঁচে থাকেন না। কিন্তু তারপরও তার ছায়া দেখলেই অফিসের সবাই চমকে উঠে। তিনি সচরাচর নিচের স্তরের কর্মচারিদের ডাকেন না। তাঁর নীতি হল–দূরত্ব বজায় রেখে চলার নীতি। আলতাফের মত একজন জুনিয়র কর্মচারি যে মাত্র সেদিন কাজে যোগ দিয়েছে তাকে খাস কামরায় ডাকার কারণ কি? গনি সাহেব চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঘটনা না জেনে যাওয়া যায় না।
.
বড় সাহেবের ঘরটা প্রকাণ্ড। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। এয়ারকুলারের কাঁটা এত নিচে নামানো যে ঘরে ঢুকলেই শীতের কারণে শরীরে কাঁপন ধরে যায়। ঘরের আলোও কম। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায় না। এত কম আলোতেও বড় সাহেব চোখে সানগ্লাস পরে থাকেন। এই অফিসের অতি পুরাতন কর্মচারি সগীর মিয়াও কোনদিন সানগ্লাস ছাড়া বড় সাহেবকে দেখেনি। অফিসের সবার ধারণা, বড় সাহেবের একটা চোখ নষ্ট বলেই তিনি কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখেন।
আলতাফ ঘরে ঢুকে ক্ষীণ গলায় কলল, স্যার ডেকেছেন?
বড় সাহেব বললেন, আপনার নাম আলতাফ হোসেন?
জি স্যার।
কাজে যোগ দিয়েছেন কবে?
দুমাস হয়েছে স্যার।
বসুন।
আলতাফ বসল। বড় সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, এই ফাইলটা আপনার তৈরি করা না? জুন মাসের এক্সপেনডিচার ফাইল।
ছি স্যার, আমার করা।
ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে একটা কাগজ পেলাম, মনে হচ্ছে আপনারই হাতের লেখা। দেখুন তো এটা আপনার হাতের লেখা কি-না।
বড় সাহেব পুরো ফাইলটাই এগিয়ে দিলেন। আলতাফ কাগজটার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, এটা আমারই লেখা।
কি লিখেছেন এখানে?
আলতাফ চুপ করে রইল। বড় সাহেব বললেন, আমি এই লেখার পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
আলতাফ বলল, এই পাতাটা স্যার ভুল করে ফাইলে দিয়ে দিয়েছি।
আমারো তাই ধারণা।
বড় সাহেব ফাইলটা আবার নিজের কাছে নিলেন। ভ্রু কুঁচকে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গুটি গুটি করে বিচিত্র কিছু জিনিস লেখা–
[III({||||||UILT}}}fb/T||||J0-1[ [TVIE DDDDDIDDDDD DDDDDD DDD DD][][[[ ]। JILIULUILO TUDIJU I MITJO. I MNO OLJO ||||||||||au[0]]]]] ]]]] [] [B]][][][000000 Tit]| || ||| |||}{VT|||]Jn-1 [ TV||||||g||||||L [ If [[[[[0000000[] [][0 D] [[ ৯][][] D IIUI|||||1|||||14pUTIIIU-IIIJITIJJ-IIITIVIL ||||ELF [1] DDDDDDDDDDD DDDD6D[D DDDDDDDD
TUITIEUTU||||IU-TIfITTRI)-| |||[[] [[ [ ] [][]]]]]]]]]]] [[[[n][D DDDDDDDDJT IUID] [EUTIIIU-IIf If}}TIOJn-[ IT}|||||| nakfTn BDn[[ [[[[ [[[[[[[[[]] [[]BD
বড় সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, জিনিসটা কি?
কিছু না স্যার।
যা লিখেছেন তা কি অর্থহীন, না কোন অর্থ আছে?
অর্থ আছে স্যার। পোকাদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছি স্যার।
কাদের নিয়ে লিখেছেন?
পোকাদের নিয়ে। যেমন তেলাপোকা, মাকড়সা, শুয়োপোকা, ..
সাংকেতিক ভাষায় লিখেছেন?
জি স্যার।
সাংকেতিক ভাষা আপনি জানেন, না নিজে তৈরি করেছেন?
আলতাফ হোসেন ইতস্ততঃ করে বলল, আমি তৈরি করেছি স্যার। তবে পোকারা আমাকে সাহায্য করেছে।
পোকারা আপনাকে সাহায্য করেছে?
জ্বি স্যার। এখানে দুধরনের সাংকেতিক ভাষা আছে। প্রথমটা তেলাপোকাদের কাছ থেকে নেয়া। দ্বিতীয়টা পেয়েছি ঘুনপোকাদের কাছ থেকে।
ঘুনপোকা?
জি স্যার, ঘুনপোকা। আমি যে টেবিলে কাজ করি সেই টেবিলে অনেক ঘুনপোকা থাকে। ওরা আমাকে লিখতে সাহায্য করেছে। স্যার, আমি এখন উঠি?
বসুন, আরো কিছুক্ষণ বসুন। তাড়া আছে?
জি না স্যার, তাড়া নেই।
আসুন, চা খাওয়া যাক। আপনি চা খান তো?
দিনে দুকাপ চা খাই স্যার। সকালে এক কাপ আর বিকালে এক কাপ।
এখন তে বিকাল, এখন খাওয়া যেতে পারে।
বড় সাহেব বেল টিপলেন। বেয়ারাকে চা দিতে বললেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, এখানে কি লিখেছেন একটু পড়ুন তো শুনি।
পোকাদের সাহায্য ছাড়া তো স্যার পড়া যাবে না।
তার মানে কি এই যে এ লেখা আপনি কখনো পড়তে পারবেন না?
পড়তে পারব। পোকা থাকলেই পড়তে পারব। আপনার ঘরে কোন তেলাপোকা বা ঘুনপোকা নেই। আমি কি স্যার আমার টেবিলে গিয়ে পড়ে নিয়ে আসব?
থাক, আরেক দিন দেখা যাবে।
বড় সাহেব উঠে দাঁড়াতে দীড়াতে বললেন, আপনি কি এইসব ব্যাপার নিয়ে অফিসের কারো সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন?
না স্যার।
না করাই ভাল। অফিস হল অফিসের কাজকর্মের জন্যে, পোকাদের সাংকেতিক ভাষা লেখার জন্যে না। ঠিক বলেছি না?
জ্বি স্যার।
আলতাফ বড় সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে দেখল, গনি সাহেব অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন।
আলতাফ সাহেব, ব্যাপারটা কি?
কিছু না।
বড় সাহেবের ঘরে এতক্ষণ কী করলেন?
চা খেয়েছি।
গনি সাহেবের মুখ কঠিন হয়ে গেল। তিনি এই অফিসের যথেষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তি। অফিসার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, অথচ তাঁকে এখনো বড় সাহেব তাঁর অফিসে চা খেতে বলেননি। চা খাওয়া দূরে থাক, রুমে কখনো ডাকেননি। এর মানেটা কি?