Site icon BnBoi.Com

পুতুল – হুমায়ূন আহমেদ

পুতুল - হুমায়ূন আহমেদ

পুতুলের ঘর থেকে

উৎসর্গ
নীলু, কল্যাণীয়াসু

কত না দিন রাতি
তুমি ছিলে আমার খেলার সাথী’

.

০১.

পুতুলের ঘর থেকে তাদের বাগানটা দেখা যায়। এত সুন্দর লাগে তার! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তাদের বাগান অন্যদের বাগানের মতো নয়। তিনটা বিশাল বড়ো বড়ো গাছ, একটা রেনট্রি গাছ। এত বড়ো যে মনে হয় এই গাছের পাতাগুলো আকাশে লেগে গেছে। আর দুটি হচ্ছে কদম ফুলের গাছ। কদম ফুলের গাছ দুটি পাশাপাশি–যেন দুই জমজ বোন, এক জন অন্য জনের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। বর্ষাকালে গাছ দুটিতে কী অদ্ভুত ফুল ফোটে। সোনার বলের মতো ফুল।

পুতুলের মা জেসমিন কদম ফুলের গাছ দুটি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কারণ হচ্ছে শুয়োপোকা। কদম গাছে খুব শুয়োপোকা হয়। আর শুয়োপোকা দেখলেই জেসমিনের বমি পেয়ে যায়। তিনি প্রতি শীতকালে একবার করে বলেন–গাছগুলো কাটিয়ে ফেলা দরকার। শেষ পর্যন্ত কেন জানি কাটা হয় না। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে যায়। অদ্ভুত কদম ফুলগুলো ফোটে। কী যে ভাল লাগে পুতুলের!

এখন শীতকাল। ক’দিন আগে ঠিক করা হয়েছে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব কেটে ফেলা হবে। জেসমিন বজলু মিয়া বলে একটি লোককে ঠিক করেছেন। লোকটির মুখে বসন্তের দাগ। তার একটা চোখও নষ্ট। ভালো চোখটি দিয়ে সে সবার দিকে বিশ্রীভাবে তাকায়। বজলু মিয়া গতকাল এসে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব দেখে গেছে। দড়ি দিয়ে কি সব মাপ– টাপও নিয়েছে। বলে গেছে সোমবারে লোজন নিয়ে আসবে।

পুতুলের এই জন্যেই খুব মন খারাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই। তার কান্না পেয়ে যায়। বাগানে এলেই সে এখন গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কি সব কথা বলে। হয়তো-বা সান্ত্বনার কোনো কথা। আজও তাই করছিল। গাছের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে লক্ষ করল তার বাবা বাগানে হাঁটছেন। তাঁর হাতে একটা ভাঁজ-করা খবরের কাগজ। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছেন। খুব রেগে গেলে তিনি এ রকম গম্ভীর হয়ে যান। বাগানে কিংবা ছাদে মাথা নিচু করে হাঁটেন। পুতুলের মনে হল আজ বোধ হয় বাবা-মা’র মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। এই একটা খারাপ ব্যাপার। দু’দিন পর পর তাঁরা ঝগড়া করেন। ঝগড়া করবে ঘোটরা। আড়ি দেবে–ভাব নেবে। বড়োরা এ রকম করবে কেন?

পুতুল ছোট ঘোট পা ফেলে রেনট্রি গাছটার দিকে যাচ্ছে। তার চোখ বাবার দিকে। বাবা কতটা রেগে আছেন সে বুঝতে চেষ্টা করছে। পুতুলের বয়স এগারো। এই বয়সের ছেলেরা চারদিকে কি হচ্ছে না-হচ্ছে খুব বুঝতে চেষ্টা করে।

রহমান সাহেব পুতুলকে রেনট্টি গাছটার দিকে যেতে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি জানেন, এই গাছের নিচে পুতুল প্রায়ই এসে বসে। এটা সম্ভবত পুতুলের কোনো গোপন জায়গা। সব শিশুদের কিছু গোপন জায়গা থাকে। তাঁর নিজেরও ছিল। পুতুলকে দেখে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। তবে তিনি পুতুলের মতো নিঃসঙ্গ ছিলেন না। অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁদের বাড়িটা ছিল হৈচৈ হুল্লোড়ের বাড়ি। নিজের ভাইবোন ছাড়াও চাচাতো ভাইবোন, ফুপাতো ভাইবোন, পাড়ার ছেলেপেলে। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি হৈচৈ।

রহমান সাহেব রোদে পিঠ দিয়ে বসলেন। বসতে হল ঘাসে। এমন ভাবে বসেছেন যেন পুতুল কী করছে দেখা যায়। তিনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, পুতুল কী করে না-করে খবর রাখতে পারেন না। ছেলেটা খুবই একা। তাকে আরো কিছু সময় দেওয়া দরকার। তা তিনি দিতে পারছেন না। তিনি মৃদু গলায় ডাকলেন, পুতুল।

জ্বী বাবা?

কী করছ তুমি?

কিছু করছি না। কাছে আস।

পুতুল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি লক্ষ করলেন, পুতুলের খালি পা। অথচ তাকে অনেক বার বলা হয়েছে খালি পায়ে বাগানে না আসতে। গায়েও পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। শীতের সকালবেলা পাতলা একটা জামা পরে কেউ থাকে? রহমান সাহেব খুব বিরক্ত হলেন। বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। ছেলেটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ রকম হাসিমুখের একটি ছেলেকে ধমক দিতে মায়া লাগে।

তুমি প্রায়ই ঐ রেনট্রি গাছটার নিচে বসে থাক। কী কর ওখানে?

কিছু করি না। বসে থাকি।

কিছু নিশ্চয়ই কর। শুধু শুধু কি কেউ বসে থাকে?

পুতুল লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। তার হাসি বলে দিচ্ছে সে শুধু শুধু বসে থাকে না। রহমান সাহেব বললেন, বসে বসে ভাব, তাই না?

হ্যাঁ  ভাবি।

কী নিয়ে ভাব?

পুতুল উত্তর না দিয়ে আবার লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। রহমান সাহেবের ইচ্ছে করল ছেলেটাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মাথা ভর্তি রেশমের মতো চুল। দেখলেই হাত বোলাতে ইচ্ছে করে।

আজ তোমার শরীর কেমন?

ভালো।

কী রকম ভালো সেটা বল–খুব ভালো, না অল্প ভালো–নাকি মন্দের ভালো।

খুব ভালো।

আচ্ছা ঠিক আছে। যাও–যা করছিলে কর।

পুতুল গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার আছে। কিছু বলতে চাচ্ছে অথচ বলতে পারছে না। রহমান সাহেবের খানিকটা মন খারাপ হল। এত বাচ্চা একটি ছেলে, সে কেন মনের কথাগুলো সহজভাবে বাবা-মা’কে বলতে পারবে না। তিনি নরম গলায় বললেন, পুতুল তুমি কি কিছু বলতে চাও?

পুতুল মাথা নাড়ল। সে বলতে চায়। রহমান সাহেব বললেন, কী বলতে চাও বাবা?

গাছগুলো কেন কাটবে?

গাছ কাটা তোমার পছন্দ নয়?

না।

ছোটরা অনেক কাজ করে, যেগুলো বড়োরা পছন্দ করে না। আবার ঠিক তেমনি বড়োরা অনেক কাজ করে যা ঘোটরা পছন্দ করে না। গাছগুলোতে শুয়োপোকা হয়, তোমার মা এই পোকাটা সহ্য করতে পারেন না।

পুতুল চুপ করে রইল। রহমান সাহেব বললেন, তাছাড়া আরেকটা কারণও আছে। গাছগুলোর জন্যে ঘরে আলো-হাওয়া তেমন ঢুকতে পারে না। এখন দেখবে প্রচুর রোদ আসবে। এখন যাও, যা করছিলে কর।

পুতুল তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। বাবা তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলেন নি, এজন্যে তার খুব ভালো লাগছে। অবশ্যি কেউ তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলে না। তার শরীর ভালো নয়, এই জন্যে। এ বাড়িতে যে আসে সেই বলে, তোমার শরীর কেমন পুতুল? বলেই খুব করুণ করে তাকায়। পুতুলের বিশ্রী লাগে। করুণ করে কেন তাকাবে? সে কি কাউকে বলেছে। করুণ করে তাকাতে?

পুতুল দেখল চায়ের কাপ হাতে মা বাগানে আসছেন। মা’র মুখ গম্ভীর। হয়তো বাবার সঙ্গে ঝগড়া করবেন। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করার সময় বা ঝগড়ার ঠিক আগে মা’র মুখ এমন গম্ভীর থাকে। গম্ভীর থাকলেও মা’কে খুব সুন্দর লাগে পুতুলের। মা হচ্ছেন পরীর মতো সুন্দর। এখন তিনি পরেছেন একটা নীল শাড়ি। সকালবেলার রোদে নীল শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে তাঁকে! মনে হচ্ছে সত্যি একটা নীল পরী। পুতুলদের বাগানে বেড়াতে এসেছে। কিছুক্ষণ বেড়াবে, নাচবে, গান গাইবে, তারপর আকাশে উড়ে চলে যাবে।

জেসমিনের আজ খুব মেজাজ খারাপ। কাজের মেয়েটা একটা কুকাণ্ড করেছে। বেলজিয়াম থেকে আনা কুকি জার’টা ভেঙে ফেলেছে। তাঁর খুব সখের জিনিস। টাকা খরচ করলেই এসব জিনিস পাওয়া যায় না।

বাগানে এসে তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। তিনি দেখলেন পুতুল মাটিতে কী সব আঁকাআঁকি করছে। পায়ে জুতো স্যান্ডেল কিছু নেই। গায়ে পাতলা একটা শার্ট। কে জানে হয়তো শার্টের নিচে গেঞ্জিও নেই।

পুতুল।

জ্বি মা?

মাটি ছানছ কেন? মাটি দিয়ে এটা কী ধরনের খেলা?

পুতুল চুপ করে রইল। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কেউ কড়া কোনো কথা বললে তার কান্না পেয়ে যায়।

পা খালি কেন? এগারো বছর বয়স হয়েছে, এখনো সব শিখিয়ে দিতে হবে? সকালে নাশতা খেয়েছ?

হ্যাঁ।

কী খেয়েছ?

পরিজ, ডিম, কলা, একটা রুটি-মাখন।

দুধ খাও নি?

না।

কেন খাও নি জানতে পারি?

পরিজ দুধ দিয়ে খেয়েছি তাই …

পরিজ তো দুধ দিয়েই খায়। পরিজ কি কেউ পানি দিয়ে খায়? তোমাকে কি বলা হয় নি সমস্ত দিনে দু’গ্লাস দুধ খেতে হবে? সকালে এক গ্লাস, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় এক গ্লাস।

পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন বিরক্ত মুখে বললেন, যাও, সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধোও। দুধ খাও আর একটা সোয়েটার গায়ে দাও। আমি যা যা অপছন্দ করি তুমি বেছে বেছে সেই সব কর। খুব অন্যায়।

পুতুল চলে যেতেই জেসমিন রহমান সাহেবের দিকে তাকালেন। খুব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি মাটিতে বসে আছে কেন?

এমনি বসলাম।

তোমাকে দেখে তোমার ছেলে এইসব শিখছে। কাউকে বললেই তো বাগানে একটা চেয়ার এনে দিত। এমন তো না যে ঘরে লোকজনের অভাব।

রহমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জেসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এই তো পাজামায় দাগ লাগিয়ে ফেলেছ।

একটু-আধটু দাগ লাগলে কিছু হয় না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে মেজাজ খারাপ না করাই ভালো। আমার সঙ্গে ঝগড়া যদি করতেই হয়, বড়ো কোনো ব্যাপার নিয়ে কর।

তার মানে?

রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। বারান্দায় ইয়াসিন এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি হাতের ইশারায় ইয়াসিনকে দুটি চেয়ার দিয়ে যেতে বললেন। ইয়াসিন সঙ্গে সঙ্গে দুটি বেতের চেয়ার দিয়ে গেল। রহমান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, বস জেসমিন একটা জরুরী ব্যাপার নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করি।

কী জরুরী ব্যাপার?

আগে বস, তারপর বলছি।

বসতে-টসতে পারব না। যা বলার বল।

তোমার কি মনে হয় না পুতুল খুব একা একা থাকে?

একা একা থাকবে কেন? বাড়িতে প্রচুর লোকজন আছে। তা আছে, তবু আমার মনে হয় ও একটু একা। আমি তাকে সময় দিতে পারি না। তুমি ব্যস্ত থাক তোমার কাজকর্ম নিয়ে।

তুমি কি চাও আমি সব ছেড়েছুঁড়ে ছেলে কোলে নিয়ে সারাদিন বাসায় থাকি?

না-না, তা চাইব কেন? আমাদের সবারই তো নিজের কাজ আছে। তবুও অসুস্থ ছেলে, ঠিকমতো যদি …

তুমি কি বলতে চাও আমি ঠিকমতো ওর যত্ন নিই না?

পুতুল দুধ খেতে খেতে শুনল মা-বাবা দু জনই খুব উঁচু গলায় কথা বলছেন। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনের এমন চমৎকার সকালে কেউ এ-রকম করে কথা বলে?

দুধ খেতে তার বিশ্রী লাগছে। প্রায় বমি চলে আসছে। উপায় নেই, খেতে হবে। খাওয়া জিনিসটা যদি পৃথিবী থেকে উঠে যেত কি চমৎকার হত। এ রকম একটা দেশ যদি থাকত, যেখানে কাউকে কিছু খেতে হয় না–বিশেষ করে দুধ।

রমিলা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। পুতুল করুণ গলায় বলল, খেতে পারছি বুয়া। রমিলা বলল, না খাইলে আম্মা রাগ হইব। কষ্ট কইরা খাইয়া ফেল গো সোনাচান।

বমি চলে আসছে। বেসিনে ফেলে দিই?

আম্মা জানতি পারলে সর্বনাশ।

মা জানবে না।

বলতে বলতে পুতুল দুধের গ্লাস বেসিনে উল্টো করে দিল। ঠিক তখন জেসমিন ঢুকলেন। ব্যাপারটা তিনি লক্ষ করলেন। পুতুলের বুক ধুকধুক করছে। হাত-পা ঘামছে। কে জানে হয়তো মা বুঝে ফেলেছেন।

পুতুল।

জি মা?

আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।

আচ্ছা।

তোমার একা একা লাগবে না তো?

উঁহু।

উঁহু আবার কেমন শব্দ? বল–না।

না।

লক্ষ্মী হয়ে থাকবে সারাদিন।

আচ্ছা।

খেলবে, গল্পের বই পড়বে। বিকেলে তোমার ছোটমামা এসে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে।

আচ্ছা।

গল্পের বই আছে তো তোমার? মানে নতুন গল্পের বই-পড়া হয় নি এমন।

আছে, লাল কমল নীল কমল।

খুব ভালো। বসে বসে লাল কমল নীল কমল পড়। আজ আরো কিছু নতুন বই কিনে দেব। খিদে পেলে বুয়াকে বলবে, সে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দেবে।

আচ্ছা।

মা লাল রঙের গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বেরুলেন বাবা। মা তার গাড়ি নিজেই চালান। বাবা কখনো নিজে চালান না। বাবার সাদা ডাটসান ড্রাইভার চাচা চালায়। যাবার আগে বাবা সব সময় তাকে আদর করেন। অদ্ভুত আদর। দু আঙুলে পুতুলের নাক চেপে বলেন–

কুটু কুটু পুটু পুটু ইট পুট
পুতুল সোনা খুটখুট।
ঔ ঔ হৈ চৈ
পুতুল সোনা কৈ কৈ?

তিনি এমন শক্ত করে নাক চেপে ধরেন যে পুতুলের রীতিমতো ব্যথা করে, তবু বাবার আদর এত ভালো লাগে! তার ইচ্ছে করে বাবা সারাক্ষণ তার নাক চেপে ধরে, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলুক। মা’র আদরও তার খুব ভালো লাগে। মা আদর করেন ঘুমুতে যাবার আগে। কিছুক্ষণ মাথায়

বিলি কেটে বলেন, এত সুন্দর চুল কেন তোমার বল তো? শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। এই বলে তিনি তার কপালে চুমু খেয়ে গল্প বলা শুরু করেন। কী যে সুন্দর সে সব গল্প। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। মা অবশ্যি একটার বেশি গল্প কখনো বলেন না। গল্প শেষ হওয়া মাত্র নীল বাতি জ্বালিয়ে মশারি ঠিকঠাক করে বলেন, গুড নাইট পুতুল সোনা।

গুড নাইট মা মনি।

সুইট ড্রিমস।

সুইট ড্রিমস মা মনি।

আজ বাবা চলে যাবার সময় পুতুলকে আদর করেন নি। হয়তো মনে ছিল না। সব সময় কি আর আমাদের সব কিছু মনে থাকে? পুতুল লাল কমল নীল কমল বই নিয়ে রেনট্রি গাছের নিচে গিয়ে বসল। ঠিক তখন দেখল, বাবার গাড়ি ফিরে আসছে। এত তাড়াতাড়ি বাবা চলে এলেন! এক মিনিটও তো হয় নি বাবা গিয়েছেন।

রহমান সাহেব ফিরে এসেছেন ছেলেকে আদর করবার জন্যে। তাঁর গাড়ি যখন বড়ো রাস্তায় পড়েছে, তখনি মনে হয়েছে একটা ছোট্ট ভুল করা হল। বাচ্চারা এইসব জিনিস খুব মনে রাখে। ছোটবেলায় তাঁকে ঠিক একই ভাবে আদর করতেন মতি চাচা। দু আঙুলে নাক চেপে গ্রাম্য একটা ছড়া বলতেন–

নিমের পাতা তিতা রে
জামের পাতা নীল।
গাঙের পারে বইয়া বইয়া
গাঙের পানি গিল।

বলতেন অতি দ্রুত। কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যেত না, কিন্তু শুনতে এত সুন্দর লাগতো। যতবার মতি চাচা তাদের বাড়িতে আসতেন, তত বারই এই ঘটনা ঘটত। শুধু একবার ঘটল না। মতি চাচা ভুলে গিয়েছিলেন। হয়তো। তার কী যে কষ্ট হয়েছিল। মনে আছে কষ্টের তীব্রতায় খাটের নিচে বসে তিনি খানিকক্ষণ কেঁদেও ছিলেন। শিশুরা খুব অভিমানী হয়। পুতুলও আজ হয়তো মন খারাপ করে আছে। কে জানে হয়তো-বা কাঁদছে।

তাছাড়া গাছ কাটার ব্যাপারে তার মনে একটা খটকা লেগেছে। হয়তো এটা নিয়ে সে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। ভালোমতো আলোচনা করে এই কষ্টটাও দূর করা উচিত। দরকার হলে গাছ কাটা পিছিয়ে দিতে হবে। অবশ্যি জেসমিন তাতে রাজি হবে না।

.

তিনি লক্ষ্য করছেন পুতুল রেনট্রি গাছের নিচে বই হাতে বসে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

পুতুল।

জ্বি বাবা।

কাছে আস।

পুতুল সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। ঠিক তখনই টেলিফোন বাজল। রহমান। সাহেব টেলিফোন ধরতে ভেতরে চলে গেলেন। টেলিফোন এসেছে জয়দেবপুর থেকে। তার মোল্ডিং কারখানায় কী সব ঝামেলা হচ্ছে। শ্রমিকরা ওভারটাইম চেয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছে, এক্ষণি যাওয়া দরকার। তিনি মুখ অন্ধকার করে বেরিয়ে গেলেন। যার জন্যে এসেছিলেন, তা-ই করা হল না। পুতুলকে আদর করতে আবার ভুলে গেলেন।

রোদ বেশ কড়া। পুতুলের গরম লাগছে। শার্ট খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করলেও খোলা যাবে না। খালি গায়ে থাকা খুব অভদ্রতা। মা জানলে খুব রাগ করবেন। পুতুল বই খুলে পড়তে শুরু করল–

অনেক কাল অনেক কাল আগে বনের ধারে বাস করতেন এক রাজা। সেই রাজার দুই পুত্র–নীল কমল, লাল কমল। এই দু জন রাজার দু চোখের মণি। এরা চোখের আড়াল হলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। যখন সিংহাসনে বসেন, তার দু পুত্রকে দু পাশে বসান। যখন খেতে বসেন তখনো দু ভাই দু’ পাশে। রানী সোনার থালা থেকে মাছের মুড়ো তুলে দেন রাজার পাতে। রাজা সেই মুড়ো দু’ ভাগ করে তুলে দেন দুই ছেলের থালায়। এইসব দেখে রানী ছটফট করেন হিংসায়। কারণ তিনি আসল মা– নন। তিনি লাল কমল আর নীল কমলের সত্য। এই দু জন তাঁর চোখের বালি, গলার কাঁটা। দিন-রাত ফন্দি করেন কী করে এই দু’ জনকে দূর কোনো দেশে নির্বাসন দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একদিন তাঁর মাথায় বুদ্ধি এল। খাটে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলেন। রাজা ছুটে এসে। বললেন–

কী হয়েছে রানী?

রানী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি আর বাঁচব না গো, আমার হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম হয়েছে।

সে আবার কী!

এই ব্যারামে শুধু হাড় মুড়মুড় করে–ওগো, আমি আর বাঁচব না গো।

এর কি কোনো অষুধ নেই?

অষুধ থাকবে না কেন? এক শ’ বার আছে। সতেরো নদী যে দেশে এক জায়গায় মিলেছে সেই দেশের রাজবাড়ির বাগানে আছে এক ডালিম গাছ। সেই ডালিম গাছে বছরে একটি মাত্র ডালিম হয়। ভয়ঙ্কর এক কালকেউটে সেই ডালিম পাহারা দেয়। ঐ ডালিম খেলেই আমার অসুখ সারবে।

তাহলে আর চিন্তা কি? ঐ ডালিম আনতে আজই আমি প্রধান সেনাপতিকে পাঠাচ্ছি।

তাতে কোনো লাভ হবে না মহারাজ। একমাত্র রাজার কুমাররাই ঐ ডালিম আনতে পারে। আর কেউ পারে না।

লাল কমল আর নীল কমলকে পাঠিয়ে দিই।

আহা, ওরা যে দুধের শিশু। তাছাড়া আমি ওদের সৎমা। সৎমার জন্যে কেউ কি আর এত কষ্ট করে?

শুনে লাল কমল আর নীল কমল বলল, আমরা করব। আমরা মা’র জন্যে ডালিম নিয়ে আসব।

রওয়ানা হল দুই রাজকুমার। কত পথ, কত গ্রাম, কত নগর, কত অরণ্য পার করে তারা চলছে তো চলছেই। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। যেতে যেতে যেতে যেতে তারা পৌঁছল মনা রাক্ষুসীর দেশে।

পুতুল মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। রাজপুত্রদের দুঃখে তার চোখ ভিজে উঠছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে। এমন রাগ লাগছে সস্তার ওপর। এত পাজি কেন সত্যটা? ভাগ্যিস তার সম্মা নেই।

সন্ধ্যাবেলা ছোটমামা এলেন। ছোটমামাকে পুতুলের ভালো লাগে। ছোটমামা খুব মজার মানুষ। সারাক্ষণই গল্পগুজব করেন। আজ করছেন না। কেমন যেন বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছেন।

কি রে পুতুল, কি করছিস?

কিছু করছি না মামা।

পিতা এবং মাতার দু’ জনেরই কোনো খোঁজ নেই! ব্যাপারটা কেমন হল বল তো?

পুতুল তাকিয়ে আছে। পুতুলের মামা নাজমুল তার বিরক্তি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আজ সন্ধ্যায় তার এক জায়গায় যাবার কথা। ছোটখাট উৎসবের ব্যাপার আছে। সেখানে যাওয়া যাছে না। পুতুলকে তার খুবই পছন্দ। কিন্তু আজকের দিনটিতে এ বাড়িতে থাকতে না পারলেই ভালো হত?

পুতুল।

জ্বি মামা?

একটা মুশকিল হয়ে গেল রে আমার যে এক জায়গায় যেতে হয়। চলে যাও।

তুই একলা একলা থাকবি?

মা সন্ধ্যাবেলায় এসে পড়বে।

আরে না। তার আসতে আসতে রাত ন’টা। লায়নেস ক্লাবে কি যেন মিটিং।

তুমি চলে যাও।

নাজমুল চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথার চুল টানতে লাগল। মামার চিন্তিত মুখ দেখে পুতুলের মায়া লাগছে আহা, বেচারা তাকে ফেলে যেতে পারছে না, আবার থাকতেও পারছে না।

পুতুল।

জ্বি মামা?

আমার সঙ্গে যাবি? চল তোকে নিয়েই না-হয় যাই। যাবি?

যাব।

পুতুলের চোখ আনন্দে দপ করে জ্বলে উঠল। মুখ হাসি হাসি। নাজমুলের আরো বেশি খারাপ লাগছে। এই অসুস্থ নিঃসঙ্গ ছেলেটাকে সঙ্গে নেওয়া ঠিক হবে না। আপা খুব রাগ করবে। পুতুলকে ঘর থেকে বের করতেই তার আপত্তি। পুতুলের হার্টের ভাল্বে কি জানি সমস্যা আছে সে কোনো রকম উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না। এক তলা থেকে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠা পর্যন্ত নিষেধ। বুয়া কোলে করে তুলে দেয়। ফাইভ পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছে। এখন তাও বন্ধ। দু জন মাস্টার এসে তাকে ঘরে পড়ান। আগামী বছরের জানুয়ারিতে পুতুলের হার্টের ভাল্ব ঠিক করা হবে। আমেরিকার সিয়াটলের সেইন্ট লিউক হাসপাতালে। এখন তারই প্রস্তুতি চলছে।

মামা আমি কোন শার্টটা পরব?

নাজমুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তোর যাওয়াটা ঠিক হবে না রে, তুই থাক। আমিও যাচ্ছি না। আয়, গল্পগুজব করি।

তোমার তো কাজ আছে, তুমি চলে যাও। আমার অসুবিধা হবে না।

সত্যি বলছিস?

হুঁ। গল্পের বই পড়ব–লাল কমল নীল কমল।

স্যার আসবে না আজ?

আজ তো ছুটির দিন।

ও আচ্ছা। মনেই ছিল না। আমি চলে যাব তাহলে?

যাও মামা।

মন খারাপ করবি না তো?

একটু করব। বেশি না। নাজমুল চলে গেল। পুতুল কিছুক্ষণ তার লেগো সেট নিয়ে খেলল। পিস্তল বানাল, এরোপ্লেন বানাল। খানিকক্ষণ টিভি দেখল। ছুটির দিনে টিভি দেখতে কোনো বাধা নেই। খুব বাজে কি একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে টিভিতে। মোটা এক জন মানুষ চোখ বন্ধ করে একঘেয়ে স্বরে বলে যাচ্ছে–

দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নৈরাজ্য চলছে। সুকুমার কলার কিছু নীতিমালা আছে। কোনো কিছুই নিয়ম বহির্ভূত নয়। ভাঙতে হবে বলেই নিয়ম ভাঙা একটা ফ্যাসান। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফ্যাশান আমদানির যৌক্তিকতা আমাদের ভাবতে হবে। …

পুতুল টিভি বন্ধ করে গল্পের বই নিয়ে বসল। লাল কমল নীল কমলের গল্প ভোরবেলা যতটা ভালো লেগেছিলো, এখন ততটা লাগছে না। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে।

রাত ন’টা বাজতেই বুয়া তাকে ভাত খেতে ডাকল। সে নিঃশব্দে ভাত খেল। হাত-মুখ ধুয়ে ঠিক সাড়ে নটায় ঘুমুতে গেল। রমিলা বলল, আমি বারিন্দায় বইস্যা আছি। ভয়ের কিছু নাই।

আমি ভয় পাচ্ছি না তো, তুমি চলে যাও।

বাত্তি জ্বালান থাউক।

না বাতি নিভিয়ে দাও।

পুতুলের ঘুম আসছে না। কান পেতে আছে, কখন গেটে শব্দ হবে। সে বুঝতে পারবে বাবা-মা এসে পড়েছেন। সিঁড়িতে তাঁদের পায়ের শব্দ শোনা যাবে। মা ঘরে ঢুকে মশারি তুলে দেখবেন, পুতুল ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি

অপেক্ষা করতে করতে পুতুল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। তার বাবা-মা এলেন তারো অনেক পরে।

খুব ভোরে পুতুলের ঘুম ভাঙল

খুব ভোরে পুতুলের ঘুম ভাঙল।

আধার ভালো করে কাটে নি। জানালার পাশে পাখি কিচমিচ করছে। বাগানে হাল্কা কুয়াশা। পুতুল নিঃশব্দে একতলায় নামল। বুয়া টেবিল সাজাচ্ছে রান্নাঘরে বাবুচি নিজের মনে কি সব কথা বলছে, আর ঘটাং ঘটাং শব্দ করছে।

রমিলা পুতুলকে দেখে বলল, খালি পাও ক্যান গো? আম্মা রাগ করব!

পুতুল হাসিমুখে বলল, দরজা খুলে দাও।

ক্যান?

বাগানে যাব। কুয়াশা দেখব।

রমিলা দরজা খুলে দিল। দোতলার জানালা থেকে মনে হচ্ছিল বাগানে কুয়াশা, এখানে এসে তা মনে হচ্ছে না। মালি সবে ঘুম থেকে উঠেছে। কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছে আর কালো রঙের থু থু ফেলছে। পুতুলেরও এ রকম কালো রঙের থু থু ফেলতে ইচ্ছে হল। চাইবে নাকি কয়লার গুড়ো?

মালি বলল, ফুল নিবা সোনাবাবু?

হ্যাঁ, নেব।

ফুল ছিড়া ঠিক না। গাছের জিনিস গাছে থাকন লাগে।

মালিটা কি অদ্ভুত! নিজেই বলছে ফুল নেবে কি না, আবার নিজেই বলছে, ফুল তোলা ঠিক নয়। আর কী অদ্ভুত একটা নামে সে পুতুলকে ডাকে–সোনাবাবু। সোনাবাবু আবার কেমন নাম!

পুতুল বলল,আজ কি সোমবার?

মালি দাঁত বের করে বলল, হ সোনাবাবু, আইজ সোমবার।

আজ গাছ কাটার লোক আসবে, তাই না?

হ। আম্মা আমারে কইলে আমি কাইট্টা দিতাম, এর জইন্যে আবার বাইরের লোক লাগে–কন দেহি সোনাবাবু?

পুতুল চুপ করে রইল। মালি বলল, ও সোনাবাবু।

কি?

শীত লাগে না?

না।

খালি গেঞ্জি গায়ে শীত লাগব। একটা শার্ট পর। আর জুতা।

সে ছোট ছোট পা ফেলে গেটের কাছে চলে এল। গেট তালাবন্ধ, তবে গেটের ভেতরেও একটা ছোট্ট গেট ছিল। সেটা ভোলা। দারোয়ান আশেপাশে নেই। বোধ হয় ঘুমুচ্ছে। সারারাত জেগে থাকে বলে সে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। পুতুল কি মনে করে যেন গেটের বাইরে চলে এল। কেউ তাকে দেখল না। সে ঝাঁঝরি থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে দিচ্ছে।

পুতুল কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। রোদ উঠেছে কী সুন্দর রোদ। দেখে মনে হচ্ছে এই রোদ চুমুক দিয়ে খাওয়া যায়। পুতুল রাস্তা পার হয়ে ও মাথায় গেল। তার পরপরই হঠাৎ কি মনে করে দ্রুত পা ফেলতে লাগল। একবার শুধু পেছন ফিরে তাদের বাড়িটা দেখল। কী সুন্দর, কী প্রকাণ্ড একটা বাড়ি! বাগানবিলাস লতিয়ে উঠেছে দোতলার ছাদ পর্যন্ত। দু’রকমের পাতা ছেড়েছে–হালকা লাল এবং ঘন নীল। দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আঙুলে লাল এবং নীল রঙ মাখিয়ে কেউ এক জন বাড়িটার গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।

পুতুল এগুচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কোথায় যাচ্ছে। আসলে কিছুই জানে না। হাঁটতে ভালো লাগছে, হাঁটছে। কোনো দিন সে একা একা এত দুর আসে নি।

একটা বুড়ো লোক কাঁধে একটা ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পুতুলের মনে হল লোকটা সাপুড়ে, অবিকল এ রকম একটা সাপুড়ে এক বার সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। সে গাড়ির ভেতর থেকে দেখতে পেয়ে অনেক অনুরোধ করে গাড়ি থামিয়েছিল। জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলেছেন, সাপের খেলা একটা নোংরা ব্যাপার। এর মধ্যে দেখার কী আছে?

অল্প একটু দেখব মা–এক মিনিট।

যা দেখার গাড়ির ভেতর থেকে দেখ।

এখান থেকে তো মা দেখা যাচ্ছে না।

যা দেখা যাচ্ছে তাই দেখ। ওকি, আবার কাঁচ নামাচ্ছ কেন? ধুলো ঢুকবে।

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখল পুতুল। লোকটা কী অসম্ভব সাহসী! একটা বিরাটি সাপ গলায় পেঁচিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলছে–

খা খা খা
বক্কিলারে খা
কিরপিনেরে খা
ননদীরে খা
কিরপিনেরে খা
খা খা খা
বক্কিলারে খা।

এই লোকটাও বোধ হয় সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে গলায় সাপ জড়াবে। ‘বক্কিলারে খা’ গান ধরবে। পুতুল গভীর আগ্রহ নিয়ে দাড়িওয়ালা লোকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছে।

লোকটি এক সময় অবাক হয়ে বলল, ও বাবা কি চাও তুমি?

পুতুল লজ্জিত গলায় বলল, কিছু চাই না। আপনার ঝুড়িটার ভেতরে কি সাপ আছে?

লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, পুলা কেমুন কথা কয়! সাপ থাকবে ক্যান?

কি আছে?

পাটালি গুড়।

লোকটি ঝাঁকা নামিয়ে গুড় দেখাল। সুন্দর চাকা চাকা গুড়। মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।

খাইবা?

জি না। লোকটা একটা গুড়ের টুকরা বাড়িয়ে দিল।

নেও বাপধন, নেও। শরমের কিছু নাই। আদর কইরা দিলাম। কী। অদ্ভুত কথা! ঝুড়ির মইধ্যে সাপ! সাপ দিয়া আমি কি করুম গো বাপধন?

লোকটি খুব হাসতে লাগল। সাপের ব্যাপারটায় সে খুব মজা পেয়েছে। লোকটির হাসি দেখে পুতুলের হাসি লাগছে।

নাম কি তোমার?

পুতুল।

পুতুল আবার কেমুন নাম?

লোকটি আবার হাসতে লাগল। এই লোকের মনে হয় হাসির রোগ আছে–যা দেখে তাতেই তার হাসি আসে।

বাড়ি কোনটে?

এটা আবার কোন ধরনের কথা, বাড়ি কোনটে। পুতুল কিছু বলল না। হাতের মুঠোয় রাখা গুড়ের দলায় ছোট্ট কামড় দিল। সুন্দর গন্ধ। খেতেও কী চমৎকার! আগে জানলে সে রোজ গুড় খেত। ভালো ভালো খাবারগুলো তাদের বাসায় কখনো আনা হয় না। এবার সে মা’কে গুড় কেনার কথা বলবে।

.

পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না এই খবরটা জেসমিনকে দেওয়া যাচ্ছে না। রমিলা খবর দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। জেসমিন ঘুম ঘুম চোখে চেঁচিয়েছেন, দরজা নাড়ছে কে? রমিলা ক্ষীণ স্বরে বলল, আম্মা আমি।

বিরক্ত করবে না।

রমিলা নিচে নেমে এল। মালি এবং দারোয়ানকে আবার পাঠাল, বাড়ির আশেপাশে খুঁজে আসবে। সে নিজে গেল ছাদে। যদিও ছাদ এর আগে একবার সে নিজেই দেখে এসেছে।

জেসমিন খবর পেলেন, সকাল নটায়।

সাড়ে ন’টার মধ্যে ঢাকা শহরের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনরা জানল, পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

পুলিশকে জানান হল বেলা দশটায়।

.

সকাল দশটা।

পুতুলকে সোহরাওয়ারদী উদ্যানে দেখা যাচ্ছে। সে বেশ আয়েশ করে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে এবং কৌতূহলী চোখে ঠিক তার বয়সী একটি ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

ছেলেটি রোগা ট্যাঙটেঙা। পরনে একটা নীল প্যান্ট। এ ছাড়া গায়ে দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই। গোলগাল মুখ। ছেলেটা একটু পরপর বয়স্ক মানুষের মতো বিরক্তিতে মুখ কোঁচকাচ্ছে। তার এক হাতে একটা কুকুরছানা। কুকুরছানাটা ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করছে। তখনই ছেলেটি মুখ বিকৃত করছে। ছেলেটির নাম অন্তু মিয়া। সেও বেশ কিছু সময় ধরে পুতুলকে লক্ষ্য করছে। এ রকম সুন্দর একটা গেঞ্জি গায়ে তার বয়েসী একটা ছেলে একা একা এখানে কী করছে সে ভেবে পাচ্ছে না। অন্তু মিয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটার সঙ্গে আলাপ জমানোর, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সে পিচ করে থুথু ফেলল। এমন ভাবে ফেলল যেন থুথু পুতুলের পায়ের কাছাকাছি পড়ে! অন্তুর নিশানা খুব ভালো। ঠিক পায়ের কাছেই পড়ল। পুতুল অবাক হয়ে বলল, থুথু দিচ্ছ কেন?

ছেলেটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, আমার ইচ্ছা।

আরেকটু হলে আমার পায়ে পড়ত।

না, পড়ত না। নিশানা আছে, এই দেখ।

বলেই অন্তু পরপর তিনবার থুথু ফেলল। প্রতিবারই সেই থুথু পুতুলের পায়ের আশেপাশেই পড়ল, কিন্তু পায়ে লাগল না। ছেলেটির এই ক্ষমতায় পুতুল অভিভূত হয়ে পড়ল। সে বলল, তোমার কি নাম?

অন্তু মিয়া।

এটা তোমার কুকুর?

হুঁ।

কুকুরটার কি নাম?

অখনও ঠিক করি নাই।

আমাদের একটা বিড়াল ছিল, তার নাম ছিল লিলিয়ান। ট্রাকের নিচে পড়ে লিলিয়ান মারা গিয়েছিল।

অন্তু বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটির পাশে এসে বসতে–ঠিক সাহসে কুলোচ্ছেনা। এইসব বড়লোকদের ছেলেপুলে বদের হাডিড হয়। এক্ষণি হয়তো তার বাবাকে ডেকে মার খাওয়াবে। এরা নিজেরা মারামারি করতে পারে না, অন্যকে দিয়ে মার খাওয়ায়। অন্তু বলল, তোর হাতে কি?

গুড। তুমি আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন? তুই তুই করে বলা ।

খুব খারাপ।  বললে তুই কি করবি? মারবি আমাকে? আয় না দেখি কত শক্তি। আয় দেখি?

পুতুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু আমি মারামারি করব কেন?

তুই বদের হাড্ডি।

আমি কেন বদের হাড়ি হব? এসব তুমি কী বলছ!

তুই শয়তানের ঘোড়া।

তুমি এরকম করে আমাকে বকা দিচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?

তুই শিয়ালের গু।

ছিঃ। এসব নোংরা কথা কেন বলছ?

অন্তু মিয়া খুব সাবধানে অনেকখানি দূরত্ব রেখে বেঞ্চিতে বসল। কুকুরটাকে লেজে ধরে খানিকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখল। বেচারি কুইকুই করছে। এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে অন্তুকে খামচি দিতে। দিতে পারছে না। অন্তু খুব মজা পাচ্ছে। পৃভুল বলল, ওকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?

আমার ইচ্ছা।

পশু পাখিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না।

কষ্ট দিলে কী হয়?

আল্লা পাপ দেন। কুকুরটাকে ছেড়ে দাও।

অন্তু মাথার উপর একটা পাক দিয়ে কুকুরটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। পুতুলের মনে হল কুকুরটা বোধ হয় মরেই গেছে। কিন্তু না, মরে নি। সে আবার পায়ে পায়ে অন্তুর দিকেই এগিয়ে আসছে। অন্তুর পায়ের কাছে এসে কুঁই কুঁই করছে। কুকুরের ভাষা পুতুল বোঝে না, কিন্তু পুতুলের মনে হল কুকুরটা বলছে, আমাকে কোলে নাও। আমাকে কোলে নাও! অন্তু এখন আর কুকুরটার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল নিচু হয়ে কুকুরটাকে নিজের কোলে তুলে নিল। কুকুরটাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাই তুলে গা-টা এলিয়ে শুয়ে পড়ল, যেন পুতুলের কোলে শুয়ে ঘুমানোই তার অভ্যাস। পুতুল মনে মনে কুকুরটার জন্যে একটা নামও ঠিক করে ফেল–ইয়েলো টাইগার। সে অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এর জন্যে নাম ঠিক করেছি। নামটা রাখবে?

কী নাম?

ইয়েলো টাইগার।

এইটা আবার কেমন নাম?

ইয়েলো টাইগার মানে–হলুদ বাঘ।

ও বুঝছি-অইলদা বাঘ।

পুতুল হেসে ফেলল। অন্তু মিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল না। সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আধ-খাওয়া বিড়ি বের করল। আগুন না ধরিয়েই মুখে দিল। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করার ভঙ্গি করতে লাগল। পুতুল অবাক হয়ে দেখছে। অন্তু বলল, বিড়ি খাইবা?

না, সিগারেট খেলে পাপ হয়।

সিগারেট না, বিড়ি।

বিড়ি খেলেও পাপ হয়।

বিনা আগুনে খাইলে কিছু হয় না!

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

তুমি আর কি জান?

মেলা জিনিস জানি। কেমনে রিকশার পাম ছাড়া লাগে হেও জানি।

পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অন্তু মিয়া বিড়ির টুকরা পকেটে ঢুকিয়ে খুব দ্রুত মুখ নাড়ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা চিবুচ্ছে।

কি খাচ্ছ তুমি।

পান খাই। খাওয়া-খাওয়া খেলা।

অন্তু মিয়া আঙুলে চুন নিয়ে পানের সঙ্গে চুন মেশানর ভঙ্গি করে পানের পিক ফেলারও সুন্দর অনুকরণ করল। পুতুল এ রকম অদ্ভুত খেলা। আগে আর দেখে নি। বড় মজা তো! অন্তু বলল, রিকশার পাম কেমনে ছাড়ে তুমি জান?

না।

খুব সোজা। একটা পিন লাগে। দিয়াশলাইয়ের কাটি দিয়াও হয়।

রিকশার পাম ছাড়লে কী হয়?

হাওয়া যায় গিয়া। রিকশা চলে না।

পুতুল তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। অন্তু বলল, হরতালের সময় রিকশা বন করন লাগে- জান না?

না তো।

রিকশা সাইকেল সব বন করন লাগে। তখন হাওয়া ছাড়তে হয়।

তাই নাকি?

হ। হরতাল হইল গিয়া গরিবের জইন্যে। হরতাল করলে গরিবের ভালো হয়। দ্যাশ স্বাধীন হয়।

দেশ তো স্বাধীন হয়েছে।

আরো ভালো মতো হয়। গরিবের পেটে খানা-খাইদ্য আয়।

তুমি গরিব?

না। আমি গরিব না।

অন্তু প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দু’টি চকচকে টাকা বের করে দেখায়। যার পকেটে এ রকম চকচকে দু’টি নোট, তাকে গরিব বলার কোনো কারণ নেই। পুতুলের পকেটে তো টাকা নাই। মনে মনে পুতুল ছেলেটাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। অবশ্যি তারও টাকা আছে। ঈদের দিনে সালাম করে পাওয়া টাকা! কত টাকা যে সেদিন পায়! মা সব টাকা দিয়ে প্রাইজ বণ্ড কিনে রেখে দেন। সে যখন বড় হবে তখন পাবে। পুতুল বলল, আমারো টাকা আছে। অনেক টাকা।

কই দেহি?

এখন নেই।

অন্তু অদ্ভুতভাবে হাসল। পুতুলের মনে হল অন্তু তার কথা মোটেই বিশ্বাস করছে না। তার একটু মন খারাপ হল। ইস, অন্তুকে যদি তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রাইজ বণ্ডগুলো দেখান যেত।

অন্তু বলল, রিকশার পাম ক্যামতে ছাড়তে হয় দেখবা?

এই প্রথম সে তুমি তুমি করে বলছে। পুতুলের বড়ো ভালো লাগল। সে আগ্রহ করে বলল, দেখব। অন্তু বলল, আও আমার সাথে।

পুতুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগুচ্ছে। চমৎকার লাগছে পুতুলের। তারা দু জন বড় রাস্তায় এসে পড়ল। পুতুলকে দাঁড় করিয়ে অন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের সামনে কয়েকটা খালি রিকশা। একটি রিকশার রিকশাওয়ালা পাশেই উবু হয়ে বসে চা খাচ্ছে। পুতুল দেখল অন্তু ভালো মানুষের মতো রিকশাটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যেপথে হাওয়া দেওয়া হয় সেখানে কী যেন করল। শোঁ শোঁ শব্দ হল। রিকশার মালিক লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই অন্তু হাওয়া। সে ছুটছে বিদ্যুৎগতিতে। রিকশাওয়ালা কুৎসিত গালি দিচ্ছে। বাকি সবাই দাঁত বের করে হাসছে। পুতুল এমন অদ্ভুত উত্তেজনার দৃশ্য এর আগে দেখে নি, তার গা ঝিমঝিম করছে। রীতিমতো তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। সে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। অন্তু বসে আছে। অন্তুর মুখভর্তি হাসি। তার পায়ের কাছে ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। পুতুল বলল, রিকশার চাকা নষ্ট করেছ তোমার পাপ হবে।

চাকা নষ্ট হয় নাই, শুধু হাওয়া গেছে।

তবু তোমার পাপ হবে।

অন্তুকে পাপের চিন্তায় খুব বিচলিত মনে হল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ফান্টা খাইবা?

খাব।

অন্তু এমন এক ভঙ্গি করল যেন ফান্টার বোতল ধরে আছে। এক হাতে বোতলের মুখ খুলে নিজেই বিজবিজ করতে লাগল। বোতলের গ্যাস

বেরিয়ে গেলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ।

নেও খাও।

পুতুল হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য বোতলটা নিল। অন্তু বলল, পাইপ আছে, পাইপ দিয়া তারপর খাও। মজা পাইবা।

অদৃশ্য পাইপ দিয়ে অদৃশ্য বোতল থেকে দু জনে ফান্টা খাচ্ছে। পুতুল সত্যি সত্যি খুব মজা পাচ্ছে। অন্তু আবার সত্যিকারের দু’টি ঢেকুর তুলল। বড় মজার ছেলে তো!

অন্তু, তোমার বাসা কোথায়?

বাসা নাই।

বাসা নাই মানে? রাত্রে ঘুমাও কোথায়?

ইস্টিশনে। রেল ইস্টিশন–কমলাপুর।

স্টেশনে ঘুমাও কেন?

ইস্টিশনই ভালো। কেউ কিছু কয় না। সরকারী জায়গা।

স্টেশন সরকারী জায়গা?

হুঁ। এই যে পার্ক–এও সরকারী।

তুমি অনেক কিছু জান, তাই না?

হুঁ জানি।

তোমার আব্বা আম্মাও স্টেশনে থাকেন?

মা মইরা গেছে। বাপ থাকে ময়মনসিং। ইস্টিশনে ভিক্ষা করে।

উনি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করেন?

অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পুতুল বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ।

অন্তু হাই তুলে হাল্কা গলায় বলল, মাঝেমইদ্যে আমিও ভিক্ষা করি।

তুমিও কর?

হ!

কিভাবে কর?

কোনো ভদ্দরলোক দেখলে কই-সারাদিনের না খাওয়া-একখান টাকা দিবেন?

মিথ্যা কথা বল কেন?

কোনটা মিথ্যা?

এই যে বললে, সারাদিন না খাওয়া।

মিথ্যা না। মাঝেমইদ্যে সারাদিন না খাওয়া যায়। খাওয়া-খাদ্য হইল ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে থাকলে হয়, না থাকলে হয় না।

পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী অদ্ভুত কথা বলছে ছেলেটা! খাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার!

ইয়েলো টাইগার আবার ফিরে এসেছে। অন্তুর পায়ের কাছে কুইকুই করছে। অন্তু একটা লাথি বসাল। কুকুরটা ছিটকে পড়ল দূরে। কী অদ্ভুত কাণ্ড। সেখান থেকে আবার এদিকেই আসছে। যে মারছে তার কাছেই আবার আসছে। পুতুল বলল, কুকুরটা বার বার তোমার কাছে আসছে কেন?

অন্তু তার জবাব দিল না। এবার সে ইয়েলো টাইগারকে কোলে তুলে নিল। চিৎ করে শুইয়ে পেটে কাতুকুতু দিতে লাগল। ইয়েলো টাইগার খুব মজা পাচ্ছে। কেমন গা মোচড়াচ্ছে। লেজ নাড়াচ্ছে। আবার একটু যেন হাসার চেষ্টাও করছে। কুকুর আবার মানুষের মতো হাসতেও পারে নাকি!

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বললেন, আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।

রহমান সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার একটা ছেলে হারিয়ে গেছে-আমি ভয় পাব না?

এখন এগারোটা বাজে। ছেলেটাকে আপনি দু ঘন্টা আগে হারিয়েছেন। দু ঘন্টা সময় কিছুই না। আশে পাশে কোনো বন্ধুর বাড়িতে খেলতে গিয়েছে।

ও কোথাও যায় না।

কোথাও যায় না বলেই যে কোনো দিনও যাবে না, এমন তো কথা নেই!

রহমান সাহেব খুব চেষ্টা করলেন যাতে তাঁর কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ না পায়। সেই চেষ্টা সফল হল না। বিরক্তি প্রকাশ পেল। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

আপনি কি একটু চা খাবেন? চা দিতে বলি?

যখন তখন চা খাবার অভ্যেস আমার নেই।

রহমান সাহেব ভাবলেন নিজের পরিচয় ভালোভাবে দেবেন। তাহলে এরা হয়তো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। এ রকম আলগা দেখাবে না। দেওয়ার মতো পরিচয় তাঁর আছে। তাঁর বাবা তিন বছরের মতো শিল্পমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন–শিল্পমন্ত্রী। তাঁর দাদা খান বাহাদুর ওয়াদুদ রহমান বৃটিশ সরকারের আমলে গণ পরিষদের সদস্য ছিলেন প্রায় এগারো বছর। এবং তার নিজেরও মন্ত্রী হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। আলাপআলোচনা হচ্ছে। তিনি নিজে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না, কারণ রাজনীতি তাঁর পছন্দের বিষয় নয়।

কমিশনার সাহেব।

জ্বি, বলুন।

আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। যে আমার ছেলের খোঁজ এনে দেবে বা ছেলেটাকে এনে দেবে তার জন্যে পুরস্কার। এই পুরস্কার আপনাদের পুলিশ বাহিনীর জন্যেও প্রযোজ্য।

আপনি মনে হচ্ছে বেশি রকম অস্থির হয়েছেন।

অস্থির হবার কারণ আছে। পুতুল কখনো একা ঘরের বাইরে যায় নি। সে অসুস্থ, হার্টের একটা জটিল ব্যাধিতে ভুগছে। আমি পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই।

করতে চাইলে নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু আমার ধারণা, ছেলেটি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। শতকরা নবৃই ভাগ ক্ষেত্রে তাই ঘটে। রাগ করে বা নিছক এ্যাডভেঞ্চারের লোভে ছেলে ঘর থেকে বের হয়, খানিকক্ষণ হাঁটিহাঁটি করে ফিরে আসে।

আমার স্ত্রী খুব অস্থির হয়েছেন। তার ধারণা, ছেলেধরার হাতে পড়েছে।

ছেলেধরা বলে কিছু নেই। বিদেশে ছেলেমেয়ে পাচার হয় বলে যে শুনি।

ভুল শোনেন। বিদেশীরা এত ঝামেলা করে ছেলেমেয়ে নেবে না। আইনের ভেতর দিয়েই তারা বাচ্চাদের দত্তক নিতে পারে। এতিমখানা আছে, সেবা সংস্থা আছে।

রহমান সাহেব তাকিয়ে আছেন। পুলিশ কমিশনারের কোনো কথা তাঁর মাথায় ঢুকছে বলে মনে হল না। কমিশনার সাহেব সহজ গলায় বললেন, আরেকটা জিনিস দেখুন। ঢাকা শহরে বাচ্চা ছেলেমেয়ের কোনো অভাব নেই। হাজার হাজার ছেলেপুলে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ফুটপাত বা রেলস্টেশনে রাত কাটায়। ছেলেধরা বলে যদি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তারা এইসব ঠিকানাবিহীন বাচ্চাদের ধরবে। আপনার বাচ্চাকে ধরে ঝামেলায় পড়তে চাইবে না।

রহমান সাহেব বললেন, আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। আপনার কথা সবই শুনলাম। পুরস্কারের ব্যাপারে আমি মনস্থির করছি।

কত টাকা পুরস্কার?

বেশ বড় এ্যামাউন্ট। এক লক্ষ টাকা!

কী বলছেন আপনি!

আমার ছেলেটা অসুস্থ। ওর দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার।

এই পুরস্কার ঘোষণা করার ফলে একটা ঝামেলা হতে পারে ছেলেটা দুষ্ট লোকের হাতে পড়তে পারে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত আমাকে সময় দিন। রাত দশটার ভেতর ফিরে না এলে পুরস্কার ঘোষণা করবেন।

ইতিমধ্যে আপনারা কী করবেন জানতে পারি?

নিশ্চয়ই পারেন। আমরা ঢাকা শহরের যতগুলো পুলিশ ফাঁড়ি আছে সবাইকে জানাব। ওয়্যারলেসে বাইরের থানাগুলোতেও জানান হবে। শহর থেকে বেরুবার যে-সব পথ আছে–যেমন ধরুন রেলস্টেশন, বাস লঞ্চ টার্মিনাল-সেখানকার পুলিশদের সতর্ক করে দেয়া হবে। হাসপাতাল গুলোতে খোঁজ নেব।

হাসপাতালে খোঁজ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে।

তাহলে তো কাজ আপনারা অনেক দূর এগিয়েই রেখেছেন। মাইকে আপনারা বাড়ির আশে পাশে একটা ঘোষণা দিতে পারেন। মাইকের ঘোষণায় বেশ কাজ দেয়।

দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে রাস্তায় মাইক বের হল। ছেলে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার হতে লাগল।

ভাইসব, বিশেষ ঘোষণা। একটি ছেলে হারানো গিয়াছে। তাহার বয়স এগারো। পরনে হাফ প্যান্ট এবং শার্ট। নাম পুতুল। রোগা, ফর্সা। কপালে কাটা দাগ আছে। শার্টের রঙ মেরুন। খালি পা। ভাইসব, অনুরোধ করা যাচ্ছে কেহ যদি ছেলেটির কোন সন্ধান পান…

.

জেসমিন সকাল থেকেই বারান্দায় একটি মোড়া পেতে বসে আছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর কোনো বোধশক্তি নেই।

আত্মীয়-স্বজনরা সকাল থেকেই এ বাড়িতে আসছেন। তাঁদের কারো সঙ্গেই জেসমিন কোনো কথা বলছেন না। দু’-এক জন কিছু সান্ত্বনার কথা। বলতে চেয়েছিলেন, তাঁদের জেসমিন খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছেন, দয়া করে। আমাকে বিরক্ত করবেন না।

গাছকাটার জন্যে বজলু মিয়া দু’ জন লোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তাকেও ধমক দিয়ে বিদেয় করা হয়েছে।

দুপুরের কিছু আগে নিমতলির পীর সাহেব বলে এক চ্যাংড়া ছেলেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এ নাকি হারানো লোক খুঁজে পাবার ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। যে হারিয়ে গেছে তার কিছু কাপড়চোপড় শুকলেই সে নাকি অনেক কিছু বলতে পারে।

রহমান সাহেব লোকটিকে পুতুলের শার্ট দিতে বললেন। সে অনেকক্ষণ নানানভাবে শার্ট শুকল, তারপর চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে রইল–যেন ধ্যান করছে। ধ্যান ভাঙবার পর সে গম্ভীর গলায় বলল, তারে আমি দেখতেছি একটা বাসে। জানালার পাশে বসছে। তার সাথে দাড়িওয়ালা একটা বুড়া কিসিমের লোক। ছেলেটার হাতে আছে একটা কমলা। বাসটা যাইতেছে ফরিদপুরে।

রহমান সাহেব লোকটির কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করলেন না। তবু ফরিদপুরের ডিসিকে টেলিফোন করলেন। এক জন লোক পাঠালেন ফরিদপুরে।

নিমতলির পীর সাহেবকে পাঁচ শ’ টাকা দেয়া হল এবং বলা হল সত্যি সত্যি যদি পুতুলকে ফরিদপুরে পাওয়া যায় তাহলে তিনি পীর সাহেবের জন্যে নিমতলিতে একটা ছোটখাট বাড়ি বানিয়ে দেবেন।

.

পুতুল এবং অন্তু মিয়াকে একটা ঠেলাগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। পুতুলের গায়ে গেঞ্জি নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরে গেঞ্জিটার সলিল সমাধি ঘটেছে। মাছ মারার জন্যে গেঞ্জি ব্যবহার করা হয়েছিল। দু জন দু’দিক থেকে ধরে জালের মতো টেনেছে। দুটো দারফিনা মাছ ধরা পড়েছে। পুতুল সেই মাছ ধরা পড়ায় উত্তেজনায় এতই উত্তেজিত ছিল যে গেঞ্জি যে তলিয়ে যাচ্ছে সেটা লক্ষ করে নি। মাছ দু’টি দু’ জন ভাগ করে নিল। অন্তু মিয়া ভাগাভাগির পরপরই হঠাৎ উদার গলায় বলল, আমার লাগবে না, তুমি নিয়া যাও।

পুতুল গভীর আগ্রহে মাছ দু’টি মুঠোর মধ্যে পুরল। তখনি ধরা পড়ল, গেঞ্জি নেই। সেই গেঞ্জি খুঁজতে কত কাণ্ড! পুতুলই একবার ডুবে যায় যায় অবস্থা। মোটামতো এক মহিলা টেনে তুলেই এক চড়।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, আপনি আমাকে মারলেন কেন?

মহিলাটি ঠোঁট উল্টে বলল, ও মা! পুলায় আবার শুদ্ধ ভাষা কয়। উঠ শুকনায়। আবার চড় খাইবি।

পুতুল উঠে পড়ল। নোংরা পানিতে দাপাদাপি করার ফল হয়েছে চমৎকার। পুতুলকে এখন আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সমস্ত শরীরে কাদার আস্তরণ জলছাপের মতো ফুটে উঠেছে চুল হয়েছে এলোমেলো।

ঠেলাগাড়িতে এদের দুজনকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত। দু’ জনের মাঝখানে ইয়েলো টাইগার’ কু কু করছে। তার নজর পুতুলের হাতের দিকে, সেখানে দুটি মরা মাছ এখনো আছে। ইয়েলো টাইগার সুযোগের সন্ধানে আছে! কখন মাছ দু’টি নিয়ে নিতে পারবে। পুতুল এই মতলব টের পেয়েছে। সে আছে খুব সাবধানে। মতিঝিল পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে এল। মতিঝিল পার হবার পরই ঠেলাওয়ালা ওদের নামিয়ে দিল। মুখ বিকৃত করে বলল, যা যা নাম। মাগনা গাড়ি বহুত চাপছস।

পুতুল বলল, আপনি আমাদের তুই তুই করে বলছেন কেন? ভালোভাবে বললেই তো আমরা নেমে যাই।

চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কয় আবার। এক চড় খাবি। নাম।

পুতুল নেমে গেল। অন্তুকে একটু বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। পুতুল বলল, এখন কী করবে?

হাঁটুম।

যাবে কোথায়?

ইস্টিশনে। ইস্টিশনে আমার ভইন থাকে।

ভইন বলছ কেন? বল বোন।

ওই একই কথা। যার নাম ভইন তারই নাম বোন।

তা ঠিক।

পুতুল তুমি যাইবা আমার সাথে?

না, আমি এখন বাসায় চলে যাব। এখন না গেলে মা রাগ করবে।

ইস্টিশনে আমার ভইনরে দেখবা না?

হ্যাঁ দেখব। তার কী নাম?

তার নাম হইল গিয়া মরিয়ম।

মরিয়ম?

হঁ।

হঁ বলতে নেই। বলতে হয় হ্যাঁ।

ওই একই কথা।

দু’ জন ছোট ঘোট পা ফেলে এগুচ্ছে। পুতুল লক্ষ করল অন্তু গভীর মনোযোগর সঙ্গে রাস্তা থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে।

ওইগুলো দিয়ে তুমি কী করবে?

খেলুম।

কী খেলা?

চাড়া খেলা। সিগারেটের প্যাকেট হইল টেকা। ফাইভ ফাইভের প্যাকেট হইল পাঁচ শ’ টেকা, স্টার হইল দশ টেকা, আর বেনসন হইল হাজার টেকা।

সত্যি!

বলতে বলতেই পুতুল একটা ফাইভ ফাইভের প্যাকেট পেয়ে গেল। কী অদ্ভুত উত্তেজনা! দশ মিনিটের মধ্যে দুটো গোল্ড ফ্লেক এবং একটা স্টারের প্যাকেট পাওয়া গেল। এক-একটা খালি প্যাকেট দেখা যায় আর দু’ জন একসঙ্গে ছুটে যায়। এমন আনন্দ পুতুল এর আগে কখনো পায় নি।

প্যাকেট সংগ্রহের খেলা বেশিক্ষণ চলল না। রাখার জায়গা নেই। ইয়েলো টাইগারকেও সামলাতে হচ্ছে। অন্তু এক সময় বলল, ফালাইয়া দেই, কেমন?

কেন, ফেলবে কেন?

টেকা রাখনের জায়গা নাই, করমু কি?

এত কষ্ট করে জোগাড় করা টাকা নর্দমায় ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। উপায় নেই, টাকার পাহাড় হয়ে গেছে। ফেলতেই হবে। অন্তু অবশ্যি টাকা ফেলার ব্যাপারটাতেও একটা মজা নিয়ে এল। প্রথমে কুচি কুচি করে ছেঁড়া হয়, তারপরই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। কে কত দূর নিতে পারে। দারুণ আনন্দের একটা খেলা।

ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। যদিও তার কু কু করার কোনো কারণ নেই। সে বেশ আরামেই আছে। সে আছে অন্তুর প্যান্টের পকেটে, মাথাটা শুধু বের হয়েছে। অন্তু ইয়েলো টাইগারের দিকে তাকিয়ে একটা নরম গলায় বলল, কি রে ব্যাটা, ক্ষিধা লাগছে?

ইয়েলো টাইগার অবিকল মানুষের মতো মাথা নাড়ল।

বেশি ক্ষিধা?

কুঁ কুঁ কুঁ।

অন্তু গম্ভীর গলায় বলল, জন্তু-জানোয়ার যখন ছোট থাকে তখন মানুষের কথা বুঝে। বড় হইলে বুঝে না।

পুতুল বলল, কে বলল তোমাকে?

আমি জানি।

কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?

অন্তু সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পুতুল আসছে তার পেছনে পেছনে। তার খিদে পেয়েছে। বেশ ভালো খিদে। এটা বেশ মজার ব্যাপার। বাসায় থাকার সময় একেবারেই খিদে লাগত না। এখন শুধু নানান ধরনের খাবারের কথা মনে হচ্ছে।

বাড়ি ফিরলে খিদের সমস্যাটি মেটে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। পুতুলের শুধুই মনে হচ্ছে, বাড়ি ফিরে কাউকে পাওয়া যাবে না। বাবা গেছেন কাজে। মাও নিশ্চয়ই বাইরে। এ সময় তিনি কখনো ঘরে থাকেন না।

অন্তু বলল, তোমার ক্ষিধা লাগছে?

হঁ লেগেছে।

আমারও লাগছে। জব্বর ক্ষিধা।

অন্তুর বোন বয়সে অন্তুর দু’বছরের ছোট। তাকে তার বয়সের চেয়েও ছোট দেখায়! ওদের দেখতে পেয়েই সে ছুটে এল। পুতুলের মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা যেন সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে, এক্ষণি আছাড় খেয়ে পড়বে।

মরিয়মের গায়ে একটা হলুদ রঙের ফ্রক। ফ্রকের উপর মোটা একটা খাকী রঙের স্যুয়েটার। স্যুয়েটারটা সে আজ সকাল বেলা পেয়েছে। রেলপুলিশের এক হাবিলদার দিয়েছে। এই হাবিলদারটা খুব ভালো। প্রায়ই এটা-ওটা দেয়! গত শীতে মোটা একটা কাঁথা দিয়েছিল। সেই কাঁথা বেশি দিন রাখা গেল না। এক রাতে কাঁথা গায়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছিল, সকাল বেলা জেগে দেখে-কাঁথা নেই, কে টান দিয়ে নিয়ে গেছে। তার পাশে এক বুড়ি ঘুমুচ্ছিল। নির্ঘাৎ বুড়ির কাণ্ড!

কাঁথাটা থাকলে এই শীতটা আরাম করে পার করে দেয়া যেত। এ বছর বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবে মরিয়মের মুখে কষ্টের কোনো ছাপ নেই। সে আনন্দে ঝলমল করছে,কারণ আজ তার খুব ভালো রোজগার হয়েছে। সে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে পানি বিক্রি করে। এলুমিনিয়ামের একটা জগভর্তি পানি নিয়ে মিষ্টি সুরেলা গলায় চেঁচায়– পানি পানি। ঠাণ্ডা কলের পানি। গরমের দিনে তার রোজগার ভালো হয়। শীতের সময় পানি কেউ খেতে চায় না।

অন্তু বলল, বিক্রি হইছে কিছু?

মরিয়ম হেসে ফেলল। ফ্রকের পকেট থেকে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। আজ পানি কেউ কেনে নি। কিন্তু এক ভদ্রলোক হঠাৎ টাকাটা দিয়েছেন। মরিয়ম এক কামরা থেকে আরেক কামরায় পানির জগ নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কিনছেনা। তার এত মন খারাপ হল। পানি না কিনলে আজ তাদের দুই ভাইবোনের কিছু খাওয়া হবে না। গতরাতেও তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। একটা পাউরুটি কিনে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। পাউরুটিগুলো এমন জিনিস যে, খাওয়ার পরপরই খিদে লাগে। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাদাম অনেক ভালো জিনিস অনেকক্ষণ পেটে থাকে।

মরিয়ম পানির জগ হাতে ট্রেন থেকে নিচে নামল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আজ আর পানি বিক্রি হবে না। এক জন ভদ্রলোক প্লাট ফর্মে দাঁড়িয়ে জুতো পালিশ করাচ্ছেন! সে কৌতূহলী হয়ে জুতো পালিশ দেখতে লাগল। এই জিনিসটা দেখলে তার ভালো লাগে। ময়লা জুতো গুলো দেখতে দেখতে কেমন চকচকে হয়ে যায়। এমন কি জুতোর দিকে তাকালে আয়নায় মুখ পর্যন্ত দেখা। যে লোকটা জুতো পালিশ করাচ্ছিল তাকে খুব কৃপণ বলে মনে হল। কারণ দু’টাকার বেশি সে দিল না। জুতো পালিশওয়ালা বখশিশের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করে একটা ধমক খেল। মরিয়ম বলল, সার দিয়ে দেন একটা টেকা, গরিব মানুষ। লোকটি বলল, এই লোক তোর কে হয়? ভাই নাকি?

না, আমার কেউ হয় না।

তুই পানি বিক্রি করিস?

হ।

শীতের দিনে পানি কেউ খায়?

না।

তাহলে পানি বিক্রি করিস কেন?

মরিয়ম কিছু বলল না। লোকটি পালিশওয়ালাকে একটা টাকা বখশিশ দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, দেখি আমাকে এক গ্লাস পানি দে। সে পানি দিল। সেই পানিতে লোকটি একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। এবং তাকে অবাক করে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। এখানেই শেষ নয়, যাবার আগে তার চুলে হাত রেখে একটু আদর করল–নরম গলায় বলল, একটা চিরুনি কিনে নিস। চুল তো একেবারে কাকের বাসা হয়ে আছে।

দশ টাকায় তাদের দু’ জনের খাওয়া ভালোই হবে। ভাত, মাছ ডাল হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সঙ্গে আরেক জনকে যে দেখা যাচ্ছে। মরিয়ম মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অন্তু প্রায়ই এরকম একেক জন সঙ্গে নিয়ে আসে। এসে দু’-একদিন থাকে, রোজগারে ভাগ বসায়-তারপর আবার উধাও হয়ে যায়। একবার নিয়ে এসেছিল এক মহাগুণ্ডাকে, কথায় কথায় মারপিট করে মরিয়মের হাত কামড়ে ধরে রক্ত বের করে দিয়েছিল। এখনো হাতে দাগ আছে। আজকের ছেলেটা সে রকম হবে না। দেখে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা ধরনের ছেলে।

তারা এগুচ্ছে কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের রেস্টুরেন্টগুলোর দিকে। সবার আগে অন্তু, তার পেছেনে পেছনে পুতুল এবং মরিয়ম। মরিয়ম কৌতূহলী চোখে পুতুলকে দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না। পুতুল খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। মেয়েটাকে কেমন পাগলী পাগলী মনে হচ্ছে। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। কেমন ছটফটে চোখ। কিন্তু চেহারাটা খুব মিষ্টি। কেমন পিচুপিচ্ করে থুথু ফেলছে।

মরিয়ম হঠাৎ পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই স্যুয়েটারটা আমারে এক জন দিছে।

কে দিয়েছে।

এক জন হাবিলদার সাব দিছে।

বাহ্, ভালো তো?

খুব ওম আছে। ভাল জিনিস।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, ওম কি? মরিয়ম খিলখিল করে হেসে। ফেলে বলল, ও ভাইজান এ ওম কি জানো না তুমি সত্যি জান না।

না।

হি হি হি। কেমুন কথা!

হাসছ কেন শুধু শুধু!

পুতুল খুব অবাক হল। মেয়েটা এমন কেন।

কেমুন কথা, যে জানে না। ওম হইল গিয়া গরম। নেও, গায়ে দিয়ে দেখ।

মরিয়ম স্যুয়েটার খুলে ফেলল। পুতুল বলল, না না আমি গায়ে দেব না।

আহ্‌ দেও না। দিলেই বুঝবা ওম কারে কয়।

এটা নোংরা স্যুয়েটার। আমি গায়ে দিব না।

ও ভাইজান, এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়। হি হি হি।

অন্তু ধমক দিল, বেহুদা হাসিস না।

এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়, ভাইজান বড় মজা লাগে।

পুতুল মেয়েটাকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে। গোলগাল আদুরে মুখ। কী সুন্দর করেই না হাসছে।

মরিয়ম বলল,  তোমার নাম কি?

ভালো নাম জানতে চাও না ডাকনাম?

ও ভাইজান, এ কেমুন জানি ভদ্রলোকের মতো কথা কয়।

অন্তু বিরক্ত মুখে তাকিয়ে ছোট্ট একটা ধমক দিল। মরিয়ম বহু কষ্টে হাসি থামাল।

.

রেস্টুরেন্টের মালিক অন্তুকে চেনে। ওরা এসে দাঁড়ানমাত্র পরোটা ভাজি চলে এল কিছুই বলতে হল না। এমন কি কুকুরটার জন্যেও খাবার চলে এল। টিনের বাটিতে খানিকটা বাসি ভাত, মাছের কাঁটা, কয়েক টুকরা আলু। সে বোধ হয় আরো ভালো কিছু খেতে চায়। বার বার অন্তুর দিকে তাকাচ্ছে। অন্তু খানিকটা পরোটা ছিঁড়ে দিতেই সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লেজ নাড়তে লাগল নানান ভঙ্গিতে। রেস্টুরেন্টের থলথলে ভুড়িওয়ালা মালিক একটা কালোজাম মরিয়মের প্লেটের কোণায় বসিয়ে দিয়ে গেল। এটা সে প্রায়ই করে। এই মিষ্টির জন্যে পয়সা দিতে হয় না।

মরিয়মের মুখভর্তি হাসি। মিষ্টির একটা কোণা ভেঙে সে মুখে দিল। আনন্দে তার চোখ ছোট-ঘোট হয়ে গেছে। অন্তুর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। দু’টাকা করে মিষ্টি। ইচ্ছে করলে তো খাওয়া যাবে না। দুপুরে আবার খিদে পাবে, তখন কিছু একটা তো খেতে হবে। দু’টাকার বাদাম কিনে ভরপেটে পানি খেলে সারাদিন থাকা যায়। আজ বাদাম কিনতে হবে তিন টাকার। মানুষ এক জন বেশি।

মরিয়ম পুতুলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, মিষ্টি খাইবা?

না।

খাও। নেও অর্ধেকটা খাও।

কারো খাওয়া জিনিস আমি খাই না।

খাও না ক্যান?

খেলে অসুখ হয়।

ও ভাইজান, এ কেমন জানি ভদ্দরলোকের লাহান কথা কয়। হি। হি হি।

তারা খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল। পুতুল বলল, তোমরা এখন কি করবে?অন্তু বলল, ময়মনসিং যামু।

কীভাবে যাবে?

রেলগাড়ি আছে না? যাওয়ার কোনো অসুবিধা নাই, টিকেট লাগে। না।

আবার ঢাকা আসবে?

হঁ।

কবে আসবে?

ঠিক নাই কোনো। আইজ রাইতে আসা যায়, কাইলও আসা যায়।

মরিয়ম হাসিমুখে বলল, সব আল্লাহর ইচ্ছা। হি হি হি হি। অন্তু মরিয়মকে ধমক দিল, তাতে লাভ হল না। হাসি থামেই না। পুতুলের ইচ্ছে করছে ওদের সঙ্গে ময়মনসিং চলে যেতে। এরা যদি আজই ফেরে-তাহলে তো কোনো অসুবিধা নেই। মা-বাবা বাসায় ফেরার আগেই হয়তো সে পৌঁছে যাবে। মা-বাবা বুঝতেই পারবে না সে কোথায় ছিল সারা দিন। আর যদি বুঝতেও পারে, তাহলেও খুব অসুবিধা হবে না। মা-বাবা কেউই তার ওপর রাগ করে না। তার অসুখ তো, তাই। হয়তো খানিকক্ষণ রাগী-রাগী চোখ তাকিয়ে থেকে বলবে, আর এ রকম করবে না, বুঝলে? সে বলবে, আর করবো না মা!

রাস্তার বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না।

আচ্ছা।

আজেবাজে খাবার খাবে না।

আচ্ছা।

লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।

হু।

হুঁ আবার কেমন শব্দ। বল-লক্ষ্মী হয়ে থাকব।

লক্ষ্মী হয়ে থাকব।

বাড়ির জন্যে পুতুলের একটু যেন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। কী হচ্ছে বাসায় এখন কে জানে। গাছগুলো হয়তো কাটা হয়ে গেছে। এ বারের বর্ষায় সে আর কদমফুল দেখবে না। কে জানে কোনো দিনই হয়তো দেখবে না।

তারা স্টেশনে পা দেওয়ামাত্র

তারা স্টেশনে পা দেওয়ামাত্র চিটাগাং মেল ছাড়ার ঘন্টা পড়ল। মরিয়ম বলল, চল, চিটাগাং যাই গিয়া। অন্তুকেও বেশ আগ্রহী মনে হচ্ছে। সে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, চিটাগাং যাইবা?

কবে ফিরবে?

চিটাগাং গেলে দুই-তিন দিনের আগে ফিরা মুশকিল।

তাহলে যাব না। আজ না ফিরলে মা বকবে।

তারা পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে চলে এল। ঢাকা ময়মনসিং লোকাল লাইনে। দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীতে বোঝাই। এর ভেতর ঢোকা মুশকিল। মরিয়ম বলল,চল, ছাদে উঠি।

অন্তু রাজি হল না। তার গায়ে শার্ট নেই। ছাদের বাতাসে ঠাণ্ডা লেগে অসুখ-বিসুখ হলে বড় কষ্ট হবে। জ্বর হলেই গায়ে কাঁথা দিতে ইচ্ছে করে। তারা কাঁথা পাবে কোথা?

ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বহু কষ্টে তারা একটা কামরায় উঠে পড়ল। ট্রেন দুলছে, দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। পুতুল তার পাশে দাঁড়ান লোকটির হাত ধরে টাল সামলানর চেষ্টা করতেই লোকটি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, গায়ে হাত দিস না, খবর্দার এক চড় দেব।

লোকটা সত্যি সত্যি চড় দেবার জন্যে হাত ওঠাল। পুতুলের একবার ইচ্ছে হল বলে–বাচ্চাদের সঙ্গে কেউ এ রকম করে?

সে অবশ্যি কিছু বলল না। লোকটার কেমন রাগী রাগী চেহারা, হয়তো সত্যি চড় কষিয়ে দেবে। মরিয়ম পুতুলের পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, দেখ, দেখ ম্যাজিক দেহায় ওমা কেমুন সুন্দর!

সত্যি সত্যি এই প্রচণ্ড ভিড়েও একটা লোক ম্যাজিক দেখাচ্ছে। তার হাতে চারটা তাস। সবাইকে তাস দেখাতে দেখাতে অদ্ভুত মেয়েলি গলায় বলছে—

চলন্ত পথের ভাই ব্রাদার, আসোলামু আলাইকুম। আমার হাতে আপনারা কি দেখতেছেন? নজর দিয়া দেখবেন। এর নাম হাতসাফাই। চোখের ধান্ধা। এক রাজার তিন রানী। ভাল কইরা লক্ষ করবেন। পরে বলবেন না যে রানী ছিল চাইরটা। পরে বললে, কাম হবে না। কেউ হাতে নিয়া দেখতে চাইলে আওয়াজ দিবেন। হাতে নিয়ে দেখতে দিব। আছেন কোনো ভাই-হাতে নিতে চান? আছেন কেউ? লজ্জা করবেন না। লজ্জা নারীর ভূষণ পুরুষের শত্রু। আছেন কোনো ভাই? থাকলে আওয়াজ দেন। টাইম কিন্তুক শেষ–এক দুই তিন। কী দেখতাছেন? এক রাজার এক রানী। দুই রানী গায়েব। এর নাম ম্যাজিক হাতসাফাই। চাইর শ বিশের খেলা।

পুতুল মুগ্ধ। চারটা তাস ছিল, এখন আছে মাত্র দু’টি। বাকি দুটি গেল কোথায়? সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য কাণ্ড! মরিয়ম ফিস ফিস করে বলল, এখন হে দাঁতের পাউডার বেচব। নিম পাউডার। সত্যিই তাই। লোকটি তার কাঁধের ঝোলা থেকে চার-পাঁচটা কৌটা বের করেছে। ঠিক আগের মতো মেয়েলি গলায় বলছে–

চলন্ত পথের ভাই ও ব্রাদার। এইবার আপনাদের জন্যে আছে, অত্যাশ্চর্য নিম টুথ পাউডার। আবদুল জলিলের বাঘ মার্কা ৫১১ নং নিম টুথ পাউডার মুখের দুর্গন্ধ দূর, দাঁতের পোকা দূর। এক ঘষায় দাঁত সাফ। দোষ-ত্রুটি সব সাফ…

মরিয়ম ফিস ফিস করে বলল, এর পাউডার বিক্রি হয় না!

তাই নাকি?

হ। বেহুদা চিল্লায়। কেউ কিনে না।

কেনে না কেন?

বেচাকিনা হইল গিয়া ভাইগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে না থাকলে, হয় না।

সত্যি সত্যি লোকটির নিম টুথ পাউডার একটিও বিক্রি হল না। পুতুল লক্ষ করছে লোকটির মুখ কত দ্রুত বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবু সে হাল ছাড়ছে না। ক্রমাগত বলছে, দোকানে কিনতে গেলে দুই টাকা, কিন্তু পাবলিসিটির জন্য সুবর্ণ সুযোগ–এক টাকা, এক টাকা, এক টাকা।

মরিয়ম বলল, অখন এই লোক গান গাইব।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, এ গানও জানে?

জানে। গান জানে, পাখির ডাক জানে। দুই বিড়ালের ঝগড়া জানে। জানলে কি হইব জিনিস বিক্রি হয় না।

বড় মায়া লাগছে পুতুলের। তার কাছে টাকা থাকলে সে সব কটা কৌটা কিনে ফেলত। লোকটি এখন গান ধরেছে–

মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়
ও ও ও
যাব মদী-না—য়।

সুন্দর গান। গাড়ির অনেকেই তাল দিচ্ছে। লোকটি বিষণ্ণ মুখে গাইছে। মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি মদীনায় যেতে চায়। পুতুলের ইচ্ছে করছে লোকটির সঙ্গে মদীনায় যেতে। মদীনা দেশটা কেমন? লোকটা এত সুন্দর করে গাইছে। মনে হচ্ছে ভারি সুন্দর দেশ মদীনা।

গান শেষ করতেই বেশ কয়েক জন বলল, আরেকটা হউক। দেহতত্ত্বের গান ধরেন। লোকটি হাসি মুখে শুরু করল–

হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ
পাখিটি ছাড়িল কে?

লোকটির অসীম ধৈর্য। গান করে সে আবার তার ঝুলি থেকে ছোট ছোট কৌটা বের করছে। মরিয়ম পুতুলের কানে কানে বলল–

এখন বেচব কানপাকা অষুধ। এই গুলাও বিক্রি হয় না।

হয় না কেন?

বিক্রিবাটা হইল ভাগ্যের ব্যাপার।

তাই নাকি?

হুঁ।

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

পুতুল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এরা কত কিছু জানে। সেই তুলনায় সে প্রায় কিছুই জানে না। লোকটি কানপাকা ওষুধের ওপর বক্তৃতা শুরু করেছে। সবাই আগ্রহ করে শুনছে–

চলন্ত পথের যাত্রিগণ। এইবার দেখুন অত্যাশ্চর্য কানপাকার মলম কর্ণ-সুন্দর! এই মলমের ফর্মুলা রূপনগরের এক কামেল ফকির স্বপ্নে পান। এই সম্পর্কে বলার কিছুই নাই। রূপনগরের কর্ণ-সুন্দর বললেই লোকে চিনে। কোনো ভাইয়ের দরকার আছে? দরকার থাকলে আওয়াজ দিবেন। প্রতি কৌটা দু’টাকা, দু’টাকা, দু’টাকা। তবে। পাবলিসিটির জন্য মুল্য হ্রাস–এক টাকা, এক টাকা, এক টাকা। আছেন কোনো ভাই? থাকলে আওযাজ দেন।

কেউ কোনো আওয়াজ দিল না। লোকটির জন্যে পুতুলের বড় মায়া লাগছে। তার কাছে টাকা থাকলে সে দুটো কর্ণ–সুন্দর’ কিনত।

মরিয়ম বলল, এই লোক যদি গান গাইয়া ভিক্ষা করত, তাইলে মেলা পয়সা কামাইত।

ভিক্ষা করে না কেন?

একেক জন থাকে একেক কিসিমের।

পুতুল ফিস ফিস করে বলল, লোকটার জন্যে খুব মায়া হচ্ছে। এই কথায় মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলল যেন পুতুল খুব অদ্ভুত কথা বলছে।

রহমান সাহেব পত্রিকা অফিসে

রহমান সাহেব পত্রিকা অফিসে এসেছেন।

সব ক’টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। পুতুলের ছবিসহ বিজ্ঞাপন। ছবি এবং বিজ্ঞাপনের কপি তৈরি করেই এসেছেন।

নগদ এক লক্ষ টাকা
পুরস্কার

পুতুল নামের এই ছেলেটির কোনো সন্ধান দিতে পারলে এই পুরস্কারের ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ করা হবে। পুতুল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বাড়ির নাম ঠিকানা জানে। বাংলা এবং ইংরেজি দু’টি ভাষাতেই কথা বলতে পারে। তার কপালে একটি কাটা দাগ আছে। সন্ধানপ্রার্থী।

এক লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা সম্পর্কে রহমান সাহেবের খানিকটা দ্বিধা ছিল। টাকার পরিমাণ বেশি–দ্বিধা সেই কারণে নয়। তিনি ভেবেছেন পুরস্কারের লোভে অন্য কোনো ঝামেলা হয় কি না। তবু পুরস্কারের ঘোষণা দিতে হয়েছে তাঁর স্ত্রীর জন্যে।

পুতুলের মা’র ধারণা গুণ্ডাপাণ্ডা ধরনের লোকজন পুতুলকে চুরি করে নিয়ে গেছে। বড় রকমের পুরস্কারের ঘোষণা দেখলে গুণ্ডাদের দলেরই লোক হয়তো-বা খবর দিয়ে যাবে। টাকার লোভে মানুষ অনেক কিছুই করে।

পুলিশ খুব খোঁজখবর শুরু করেছে। পুলিশের আই জি নিজে ব্যাপারটায় অতিরিক্ত রকমের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কারণ হোম মিনিস্ট্রি থেকে তাকৈ পুতুলের কথা বলা হয়েছে।

ঢাকা শহরের সন্দেহজনক জায়গা সব কটিই দেখা হয়েছে। এখন আবার হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকাগুলো। কোথাও পুতুল নেই।

নিমতলির পীরসাহেবকে আবার ডেকে আনা হয়েছে। পীরসাহেব পুতুলের শার্ট,বই-খাতা এবং ফুটবল একের পর এক নাকের সামনে ধরছেন। জেসমিন তার সামনে বসে আছেন। অনবরত তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি এক ফোঁটা পানি মুখে দেন নি।

জেসমিন পীরসাহেবের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, কিছু বুঝতে পারছেন?

হ!

কী বুঝতে পারছেন বলুন।

ফরিদপুর শহরে যায় নাই। তার আগেই বাস থাইক্যা নাইম্যা পড়ছে। সাথে আছে ঐ বুড়া কিসিমের লোক।

কোথায় আছে এখন?

একটা ভোলা টেরাকের উপরে আছে।

সেকি! ওর তো শরীর খুব খারাপ। ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো। ও কী করছে?

ঝিমাইতাছে। মনে হয় জ্বর আইছে।

জেসমিন হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন।

ট্রেন গফরগাঁও স্টেশনে

ট্রেন গফরগাঁও স্টেশনে থেমে আছে।

দুপুর একটা।

ঢাকার দিকে যাবার মেল ট্রেনটিও থেমে আছে। কোথাও কিছু ঝামেলা হয়েছে। কোনো ট্রেনই নড়ছে না। কড়া রোদ। বাতাস নেই। মরিয়ম খুব ব্যস্ত। যাত্রীদের পানির পিপাসা পাচ্ছে। ঘন ঘন মরিয়মের ডাক পড়ছে।

অন্তু খুব খুশি, কারণ বেশ কিছু বাদামওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। সে মনে মনে বলছে–খাও, খুব বেশি করে বাদাম খাও। বাদাম যত বিক্রি হবে, পানিও তত বিক্রি হবে। বাদাম খেলেই গলা যাবে শুকিয়ে, পানি ছাড়া গতি নেই।

মরিয়ম ছাড়াও আরো দু জনে পানি বিক্রি করছে। এক জন বুড়ো লোক। সে ভেজা গামছা জড়ানো কলসী নিয়ে এসেছে। সুর করে বলছে, কলসির ঠাণ্ডা পানি। বরফের লাহান ঠাণ্ডা। তার ব্যবসাই জোরেসোরে চলছে। যাত্রীরা তাকেই বেশি ডাকছে। অন্য জন অন্তুর বয়সী। তার ব্যবসা সবচেয়ে খারাপ। বলতে গেলে কেউই তাকে ডাকছে না। তাকে না ডাকার কারণ হচ্ছে সে অসম্ভব নোংরা। এক নাকে সর্দি উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।

বুড়ো পানিওয়ালাকে কোনো রকমে সরিয়ে দিতে পারলেই এক চেটিয়া ব্যবসা করবে মরিয়ম। অন্তু মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল। উকার গতিতে ছুটে এসে বুড়োর ঘাড়ে পড়ে গেল। কলসি ছিটকে পড়ল। বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, এইটা কি করলা? দশ টেকা দামের নয়া কলসি।

অন্তু ভেবেছিল বুড়ো তাকে ধরে মারধোর করবে। বুড়ো সে রকম কিছু করল না। দুঃখী ভঙ্গিতে ভাঙা কলসির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তুর মন খারাপ হয়ে গেল। না ভাঙলেই হত বেচারার কলসিটা।

মরিয়ম একা-একা সামলাতে পারছে না। পুতুল তাকে সাহায্য করছে। পানি ভরে গ্লাস এগিয়ে দেয়া ও পয়সা নেয়া। খালি জগ পানিতে ভর্তি করে আনা। অনেক কাজ। শুরুতে পুতুলের একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল। এখন লাগছে না। সে প্রবল উৎসাহে ছোটাছুটি করছে। সুর করে চেঁচাচ্ছে-পানি, ঠাণ্ডা পানি, কলের পানি। সে কল্পনাও করে নি,পানি বিক্রির ব্যাপারটায় যে এত আনন্দ আছে। এর মধ্যে অন্ত খবর এনেছে– ঢাকা মেইল আরো এক ঘন্টা থাকবে। লাইনে নাকি গণ্ডগোল হয়েছে। খুব ভালো খবর। এক ঘন্টা না থেমে দশ ঘন্টা থেমে থাকলে আরো ভালো।

ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে একটি মেয়ে হাতের ইশারায় পুতুলকে ডাকছে। পুতুলের বুক ধ্বক করে উঠল। চেনা কেউ নাকি? না, চেনা কেউ নয়। মেয়েটি বলল, এই, তুমি আমার ফ্লাস্ক ভর্তি করে পানি এনে দিতে পারবে?

পুতুল মাথা কাৎ করে জানাল, পারবে।

আগে ভালো করে ধুয়ে নিও, কেমন?

আচ্ছা।

মেয়েটির স্বামী ইংরেজিতে বলল, এত দামি ফ্লাস্ক ওর হাতে দিচ্ছ। কেন? নিয়ে ভেগে যাবে।

মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, ভাগলে ভাগবে। আমার তো একে চোর বলে মনে হচ্ছে না।

লোকটি বলল, এইসব বিচ্ছুরা সবাই চোর। ছোটবেলায় করে চুরি, বড় হলে করে গুণ্ডামি।

কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছে। পুতুল সবই বুঝতে পারে। এ্যাংলো এক মেম সাহেব তাকে ইংরেজি পড়ায়। সে বুঝবে না কেন? এদের চেয়ে ভালো ইংরেজি সে নিজেও বলতে পারে।

মেয়েটি বিরক্ত মুখে ফ্লাস্ক এগিয়ে দিল। ফ্লাস্ক হাতে নিতে নিতে পুতুল চমৎকার ইংরেজিতে বলল, বাচ্চাদের চোর বলতে নেই। চোর বললে আল্লাহ্ তোমাদের পাপ দেবেন।

মেয়েটি এবং তার স্বামী কী যে অবাক হয়েছে! চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি বলল, এই ছেলে, এই শোন শোন। ততক্ষণে পুতুল চলে গিয়েছে। ফ্লাস্ক ভর্তি করে সে নিজে নিয়ে এল না। অন্তুকে দিয়ে পাঠাল।

মেয়েটি বলল, ঐ ছেলেটা কে?

অন্তু উদাস গলায় বলল, কেউ না।

কেউ না মানে? তোমার কে হয়?

ভাই হয়।

তোমরা কী কর?

পানি বিক্রি করি। ভিক্ষা করি।

ঐ ছেলেটাকে ডেকে আনতে পারবে? ডেকে আনতে পারলে দশটা টাকা দেব। যাও তাড়াতাড়ি কর, গাড়ি ছেড়ে দেবে।

অন্তুর কোনো রকম তাড়া দেখা গেল না। সে তার ইয়েলো টাইগারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুতুলকে ডেকে আনলেই টাকা দেবে– এই কথা তার এক বিন্দু বিশ্বাস হল না। টাকা এত সস্তা নয়।

ঢাকা মেইল এক ঘন্টা থাকবে, এই গুজব সত্যি হল না আধ ঘন্টার মাথায় গার্ড সবুজ নিশান উড়িয়ে দিল। পুতুলদের রোজগার মন্দ নয়। এগারো টাকা আট আনা। এর মধ্যে একটা টাকা চালান যাবে না বলে মনে হচ্ছে। ছেঁড়া টাকা। তবু দশ টাকা আট আনাই-বা মন্দ কি? টাকা সব অন্তুর পকেটে। খরচ সে-ই করবে। পুতুল মৃদু গলায় বলল, আমাকে একটা টাকা দেবে?

ক্যান?

এক কৌটা কর্ণ সুন্দর কিনব।

কর্ণ-সুন্দর দিয়া কী করবা?

ঐ লোকটা কিছু বিক্রি করতে পারে নি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বেচারা।

অন্তুর টাকা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। মরিয়মের পীড়াপীড়িতে রাজি হল।

এক টাকায় এক কৌটা কর্ণ-সুন্দর পাওয়ার কথা। লোকটি দু’টি কৌটা দিয়ে দরাজ গলায় বলল, পাইকারি দরে দিলাম। তুমি পুলাপান। মানুষ, এই জইন্যে খাতির করলাম। কোম্পানির লোকসান হইল। বেজায় লোকসান।

পুতুল বলল, কোম্পানির লোকসান হলে একটাই দিন। দুটি দিতে হবে না।

না-না, অসুবিধা নাই। তোমারে খুশি হইয়া দিলাম।

পুতুল কর্ণ-সুন্দর হাতে নিয়ে একটু দূরে সরে এল। আড়েআড়ে সে লোকটিকে দেখছে। লোকটি তৎক্ষণাৎ এক টাকার বাদাম কিনছে। কী আগ্রহ করেই না সে বাদাম খাচ্ছে। বেচারা সারাদিন হয়তো কিছু খায় নি। দ্রুত তার বাদাম ফুরিয়ে যাচ্ছে।

মরিয়ম এসে দাঁড়িয়েছে পুতুলের পাশে। সে চোখ বড় বড় করে বলল, কী দেখ?।

ঐ লোকটাকে দেখি।

দুই বিলাইয়ের ঝগড়া শুনবা? আও যাই।

লোকটি ওদের দু’ জনকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। উদাস গলায় বলল, বাদাম খাইবা?

বাদাম খেতে বলা অর্থহীন। কারণ বাদাম নেই। চারদিকে শুধু বাদামের খোসা পড়ে আছে। মরিয়ম বলল, দুই বিলাইয়ের ঝগড়া দেখমু।

লোকটি মনে হল সঙ্গে সঙ্গে রাজি। একটা হাত মুখের উপর রেখে বেড়ালের ঝগড়া শুরু করল। মাও মাও ফ্যা ফ্যাচু–ভয়াবহ ঝগড়া। পুতুল মুগ্ধ। তার কাছে মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি দুটি বেড়াল ঝগড়া করছে। একটা পারছে না, কিছুক্ষণ পরপরই মিউ মিউ করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পুতুল বলল, আপনি আর কী জানেন?

মেলা জিনিস জানি। জানলে কি হইব, পেটে ভাত জুটে না।

ভাত জোটে না কেন?

হেইডাই তো বুঝি না। কপালে লেখা নাই।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, ভাতের কথা কপালে লেখা থাকতে হয়!

মরিয়ম হেসে ফেলল। এই ছেলেটার অদ্ভুত অদ্ভুত কথায় তার খুব হাসি পায়। ভাতের কথা যে কপালে লেখা থাকতে হয়, কপালে না থাকলে যে ভাত জোটে না–এই অতি সাধারণ কথাও এই ছেলেটার জানা নেই। কি অবাক কাণ্ড!

লোকটি বাদামের খোসাগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখছে। সে একটা আস্ত বাদাম পেয়ে গেছে। বাদামটা ভাঙতে গিয়েও ভাঙল না। এগিয়ে দিল পুতুলের দিকে। নরম গলায় বলল, নেও, খাও।

পুতুল হাত বাড়িয়ে নিল। লোকটি কী সুন্দর করেই না হাসছে।

.

ট্রেন ময়মনসিংহ এসে পৌঁছল সন্ধ্যা মেলাবার পর।

ঠিক ময়মনসিংহ স্টেশনে নয়। একটু দূরে, আউটার সিগন্যালে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ বাতি না জ্বলায় স্টেশনে ঢুকতে পরছে না। পুতুল সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল। ফিসফিস করে বলল, লাফ দিয়ে নামুন লাগব।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, কেন?

ইস্টিশনে মবিল কোর্ট আছে।

সেটা আবার কি?

পুলিশ! বিনা টিকেটে গেলে পুলিশে ধরে।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এত ব্যাখ্যা করার সময় নেই। অন্তু খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়েছে। অন্তুর পেছনে পেছনে মরিয়ম। পুতুলের ভয় করছে। বাইরে অন্ধকার। ঝোঁপঝাড়ের মতো দেখাচ্ছে। ট্রেনেও গতি চলে এসেছে। সে চোখ বন্ধ করেই লাফিয়ে পড়ল। বড় রকমের একটা ধাক্কা লাগল গায়ে, তারপর গড়িয়ে নিচে নেমে যেতে লাগল। কোথায় নেমে যাচ্ছে কে জানে। চোখ মেলতে সাহসে কুলুচ্ছে না। সে প্রাণপণে ডাকল, অন্তু, এই অন্তু।

না, তার তেমন কিছু হয় নি। দুই হাঁটুর অনেকখানি শুধু ছিলে গেছে। ব্যথা করছে, রক্ত বেরুচ্ছে, তবু পুতুলের মনে হচ্ছে–এটা খুবই সামান্য ব্যাপার। তারা হাঁটছে রেল লাইনের স্লীপারে পা ফেলে ফেলে। পুতুল ভয়ে। মরছে, যদি কোনো ট্রেন এসে পড়ে। অন্তু এবং মরিয়ম নির্বিকার। মরিয়ম সুর করে এক্কা-দোক্কা খেলার মতো করে স্লীপারে পা দিচ্ছে। যেন লাইন ধরে হাঁটাও একটা খেলা। অন্তু আবার স্লীপার ছেড়ে উঠে এসেছে লাইনে। একটা মাত্র লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু সে দ্রুত এগুচ্ছে। যেন এইভাবে হাঁটতেই সে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে শিস্ দেবার চেষ্টা করছে। শিটা ঠিক হচ্ছে না। ফুঁ দেয়ার মতো শব্দ হচ্ছে।

অন্তু ইয়েলো টাইগারটাকে ফেলে এসেছে ট্রেনে। এই নিয়ে তার মনে কোনো রকম ক্ষোভ বা দুঃখ লক্ষ করা যাচ্ছে না। কুকুরের কথা এখন সে পুরোপুরি ভুলে গেছে।

পুতুলের শীত করছে। বেশ ভালো শীত। খোলা মাঠের উপর দিয়ে বইছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। পুতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। সে অবশ্যি কিছু বলল না। অন্তুর গা খালি। সে কিছু বলছে না। পুতুল কেন শুধু শুধু বলবে? সে দুটি হাত গুটিয়ে বুকের উপর নিয়ে এসে বাতাসের ঝাঁপটা সামাল দেবার চেষ্টা করছে।

অন্তু অন্ধকারেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। কানে কানে মরিয়মকে কী যেন বলতেই সে তার স্যুয়েটার খুলে দিল। পুতুল বলল, আমার লাগবে না।

মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, শীতে কাঁপছে, আর কয়, আমার লাগবে না। হি হি হি।

পুতুল বলল, তোমাদের শীত লাগে না?

অন্তু বলল, না।

লাগে না কেন?

আমরা হইলাম গিয়া গরিব। গরিব মাইনষের শীত লাগে না।

গরিব মানুষের শীত লাগে না কেন?

অন্তু বিরক্ত হয়ে বলল, জানি না।

মরিয়ম বলল, গরিবের শীত কম লাগে। এইডা হইল গিয়া নিয়ম।

কে বানিয়েছে এই নিয়ম?

আল্লা বানাইছে।

আল্লা দু রকম নিয়ম বানিয়েছেন কেন–ধনী মানুষের জন্যে এক রকম নিয়ম, আবার গরিব মানুষের জন্যে অন্য রকম নিয়ম?

এইডা তুমি আল্লারে জিগাও। হি হি হি। খালি পাগলের লাহান কতা কয়।

তারা ময়মনসিং রেল স্টেশনে এসে উঠেছে। প্রচুর আলো, ভিড়, হৈচৈ। একসঙ্গে দুটি ট্রেন এসে থেমেছে। অনেকেই কুলি কুলি করে চেঁচাচ্ছে। কুলি পাচ্ছে না। এক জন প্রকাণ্ড একটা স্যুটকেস কিছু না বলেই অন্তুর মাথায় তুলে দিয়ে বলল, রিকশায় তুলে দে, এক টাকা পাবি। স্যুটকেস মাথায় নিয়ে অন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পা কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে।

অন্তু বলল, স্যুটেকেস নিমু না। অন্য লোক দেখেন।

চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। কাজ দিলে কাজ করবে না। আছে শুধু চুরির মতলবে। হাঁটা শুরু কর, নয় তো টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব।

লোকটা একটা ধাক্কা দিল অন্তুর পিঠে। অন্তু দুলতে দুলতে এগুচ্ছে। মরিয়ম ছুটে গিয়ে স্যুটকেসের একমাথা ধরল, যাতে ভাইয়ের কিছু সাহায্য হয়। পুতুল ভেবে পেল না মানুষরা এত খারাপ কীভাবে হয়। সে নিজে যে-স্যুটকেস নিয়ে হাঁটতে পারে না, সেই স্যুটকেস একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় কী করে তুলে দেয়!

পুতুল হঠাৎ দেখল অন্তু এবং মরিয়ম ভিড় কাটিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাদের তাড়া করছে। তারা খানিকটা উত্তেজিত, তবে দু জনের মুখই খুব হাসি হাসি। দ্রুত এরা ওভারহেড ব্রীজে উঠে পড়ল। পুতুল ছুটে গেল ওদের দিকে। একটা কোনো মজার কাণ্ড নিশ্চয়ই হয়েছে। কারণ দূর থেকেই অন্তু এবং মরিয়মের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে।

কাণ্ডটা এ রকম–অন্তু এবং মরিয়ম বহু কষ্টে স্যুটকেসটা গেট দিয়ে বের করেছে। গেটের বাইরে বড় নর্দমা। অন্তু হঠাৎ কেউ কিছু বুঝবার আগেই স্যুটকেস ফেলে দিল নর্দমায়। ফেলেই এক দৌড়। স্যুটকেসের মালিক স্যুটকেস ফেলে পেছনে পেছনে আসতে পারছে না।

ঘটনায় মরিয়ম খুব বেশি মজা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই হি হি হি। শেষ পর্যন্ত চিমটি দিয়ে তার হাসি থামাতে হল। তার হাসিরোগটা এমন, যে মাঝে মাঝে চিমটি দিয়ে থামাতে হয়। প্রচণ্ড রকম ব্যথা পেলে তবেই হাসি থামে।

তারা ওভারব্রীজে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। বলা যায় না, লোকটা ফিরে আসতে পারে। ফিরে আসতে দেখলে দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে।

ওভারব্রীজে বসে থাকতে বড় মজা লাগছে পুতুলের। ওপর থেকে ট্রেনগুলোকে কেমন সাপের মতো দেখায়। যখন চলতে শুরু করে মনে হয় সাপটার ঘুম ভেঙেছে। হেলে-দুলে যাচ্ছে খাবারের খোঁজে।

অন্তু পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা মজা দেখবা?

কী মজা?

এইখানে থাইক্যা লাফ দিয়া ট্রেনের ছাদে পরমু।

ইশ।

ইশ না, এই দেখ।

বলতে না-বলতেই অন্তু সত্যি সত্যি লাফিয়ে ট্রেনের ছাদে পড়ে গেল। পুতুল স্তম্ভিত। মরিয়ম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, খালি বাহাদুরি দেখায়। লাফ দিতে সবেই পারে।

তুমিও পার?

হ। দেখবা?

না, আমি দেখতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।

দেখার মইদ্যে আবার ডর ক্যান!

না, তোমাকে দেখাতে হবে না। আমার সত্যি ভয় লাগছে।

মরিয়ম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাজানরে খুইজ্যা বাইর করি। খিদা লাগছে।

পুতুলের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না! সে মুগ্ধ চোখে অন্তুর কাণ্ডকারখানা দেখছে। অন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেনের একটা কামরা থেকে অন্য কামরায় যাচ্ছে। এর মধ্যে গার্ড বাঁশি বাজিয়ে সুবজ বাতি দেখাচ্ছে। ট্রেন হুইসেল দিয়ে চলতেও শুরু করেছে, অথচ অন্তু নির্বিকার। ভয়ে পুতুলের বুক কাঁপছে। সে কাঁপা গলায় বলল, অন্তু আসছে না কেন?

মরিয়ম বলল, আসব।

ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে তো।

ছাড়লেও সে আসব।

মরিয়ম প্রায় জোর করে পুতুলের হাত ধরে তিন নম্বর প্ল্যাটফরমের দিকে এগুচ্ছে। সে তার বাবাকে খুঁজে বের করবে। রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে।

অন্তু এবং মরিয়মের বাবা জ্বরে প্রায় অচেতন। তবু এই অবস্থাতেও মরিয়মকে দেখে হাসল। নিচু গলায় বলল, অন্তু কই?

আইতাছে।

জ্বরে কাবু হইলাম, বুঝছস! বেজায় জ্বর।

খাইছ কিছু?

না।

পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্তুর বাবা তাকে একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। মরিয়ম মুহূর্তের মধ্যে কাজে লেগে পড়ল। তিনটি ইটের উপর একটা এলুমিনিয়ামের ডেকচি বসিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যে চুলায় আগুন ধরাল। কল থেকে পানি আনল।

অন্তুর বাবা মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখছে, আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রান্না সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছে। যেমন একবার বলল, লবণ নাই, বুঝছস? অন্তুরে দিয়া এক ছটাক লবণ আনাইস।

পুতুল বসেছে মরিয়মের পাশে। মরিয়মের দেখাদেখি হাত মেলে দিয়েছে আগুনের ওপর। আগুনের আঁচ বড় ভালো লাগছে! পুতুল বলল, কী রান্না হচ্ছে?

তিন মিশাল।

তিন মিশাল আবার কি?

ভাত ডাইল আর তরকারি। তিনটা একত্রে! খাইতে খুব মজা।

তাদের পাশেও আরেকটি পরিবার রান্না চাপিয়েছে। চার পাঁচটা ছোট ছোট শিশু হাঁড়ির চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। তাদের মা খুন্তি দিয়ে হাঁড়ি নাড়ছে এবং গল্প করছে। খুব মজার কোনো গল্প নিশ্চয়ই, কারণ মরিয়মও কান পেতে আছে সেই গল্পের দিকে।

পুতুল কিছু জিজ্ঞেস করলে এখন আর সে জবাব দিচ্ছে না। পুতুলও গল্প শুনছে। তবে কিছু বুঝতে পারছে না। গ্রাম্য ভাষায় গল্প বলা হচ্ছে, উচ্চারণও কেমন অদ্ভুত! মেয়েটি কেমন টেনে টেনে বলছে। মাঝে মাঝে গানের মতো আছে–সুর করে গাইছে।

তুলারাশি রাইজ কইন্যা তখন আর কী করে? উত্তরে চায়, দক্ষিণে চায়, পুব আর পশ্চিমে চায়। কোনো দিশা পায় না।

চউক্ষের পানিতে কইন্যার
বদন ভাইস্যা যায়
কইন্যা বলে ভাই গো আমার
কি হইবে উপায়?

তখন রাইজ কইন্যার ভাই কইল, ও আমার সোনা ভইন। চউখ মুছ। আমি থাকতে তোমার কোনো বিপদ নাই। দেখি আমি থাকতে কে তোমারে কি কয়। এই কথা বইল্যা হে তলোয়ার হাতে নিল।

তলোয়ার হাতে লইয়া ভাইয়ে
ভইনের দিকে চায়।
ভইনের দুঃখ দেইখ্যা তাহার
কইলজা পুইড়া যায়।

ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও পুতুলের শুনতে চমৎকার লাগছে। গানের সুরে তুলারাশি কন্যার দুঃখের কথা বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলল। পুতুলেরও চোখ ভিজে গেল। গলা ভার ভার হল। এত কষ্ট কেন তুলারশি কন্যার?

তিন মিশাল হাঁড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তু এসে উপস্থিত। হাত ধুয়ে সে সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেল! অন্তুর বাবা খাবে না। তার জ্বর বোধ হয় আরো বেড়েছে।

একেবারেই লবণবিহীন রান্না। পাশের মেয়েটির কাছ থেকে লবণ এনে মরিয়ম প্লেটে ছিটিয়ে দিল। তরল এক ধরনের জিনিস তৈরি হয়েছে। পুতুলের কাছে মনে হচ্ছে–এত চমৎকার খাবার সে বহুদিন খায় নি। দু’বার সে চেয়ে নিল। আরো একবার নিত, কিন্তু তার লজ্জা করছে। হাঁড়িতে অল্প কিছু খাবার এখনো রয়েছে। অন্তুর বাবার জন্যে রয়েছে। জ্বর কমলে খাবে।

অন্তু এবং মরিয়ম থালা বাসন ধুতে গেল। পুতুল বসে রইল অন্তুর বাবার কাছে। অন্তুর বাবা বলল, ঘুম ধরলে ঘুমাও। জায়গা আছে।

পুতুল বলল, আমার ঘুম ধরে নি। আর ধরলেও এত নোংরা বিছানায় আমি ঘুমূব না। অন্তুর বাবা অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসল।

তোমার নাম কি?

আমার নাম পুতুল। আপনার কি হয়েছে?

আমার কি হইছে, হেইডা কোনো কথা না। তুমি কেডা ঠিক কইর্যা কও।

বলছি তো আপনাকে। আমার নাম পুতুল।

বুঝছি তুমি বাড়ি থাইক্যা পালাইছ।

পালাই নি তো। কাউকে না বলে চলে এসেছি।

কী সব্বনাশের কথা!

এখন চলে যাব। রাতে ঢাকায় যাবার ট্রেন আছে। অন্তু আমাকে দিয়ে আসবে।

তুমি যে ধনী মাইনষের পুলা এইডা বুঝি নাই। তোমার কথা শুইন্যা বুঝলাম।

অন্তুর বাবা আবার শুয়ে পড়ল। জ্বরের ঘোরে সে বসে থাকতে পারছে না। বড় মায়া লাগছে পুতুলের। এই লোকটি এত অসুস্থ, অথচ ডাক্তারের কথা কেউ বলছে না।

অন্তু এবং মরিয়ম ফিরে এসে টাকা গণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ সারা দিনে যে ক’টাকা পাওয়া গেছে সেগুলো গুণল। একটা বালিশের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আরো কিছু টাকা বের করল। সব মিলিয়ে তিন শ’ ছ’ টাকা আছে। মরিয়ম হাসিমুখে বলল, ট্যাকা জমাইতাছি।

কেন?

কেনর জবাব দিল অন্তু। তারা সবাই মিলে টাকা জমাচ্ছে, যখন পাঁচ শ’ টাকা হবে, তখন জমান শেষ হবে। সবাই মিলে তারা দেশের বাড়িতে চলে যাবে। তাদের বাবা এ টাকায় একটা ছোট্ট দোকান দেবে। ঐ দোকানের টাকায় তাদের সংসার চলবে। দুই ভাই-বোন ভর্তি হবে স্কুলে। তারপর তারা ছোট্ট এক টুকরা জমি কিনবে। সেই জমিতে তাদের বাড়ি হবে। একটা নৌকাও কিনবে। নৌকা নিয়ে বিলে মাছ মারতে যাবে।

মুগ্ধ কণ্ঠে বলছে অন্তু। মাঝে মাঝে কিছু বাদ পড়ে গেলে মরিয়ম তা ধরিয়ে দিচ্ছে। যেমন গাই কেনার কথা বলতে অন্তু ভুলে গিয়েছিল। মরিয়ম মনে করিয়ে দিল।

পুতুল বলল, তখন তোমাদের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাব। আমরা খুব আনন্দ করব।

তোমাদের আম-কাঁঠালের বাগান আছে?

গেরামে আছে। বেত ফলের বন আছে। ডেফলের গাছ আছে। ডেফল চিন?

না।

তিনটা কইরা কোয়া থাকে। মিষ্টি।

অন্তুর বাবার জ্বর খুব বেড়েছে। সে বিড়বিড় করে কী সব বলছে। মরিয়ম বা অন্তু কেউ সে-দিকে তেমন নজর দিচ্ছে না। রাত এগারোটায় ঢাকা মেইল আসবার ঘন্টা পড়তেই সে অন্তুকে বলল, পুলাডারে তার বাসাত দিয়ে আয়। কার না কার পুলা–বাপ মায় কানতাছে।

অন্তু এবং মরিয়ম দু জনই উঠে দাঁড়াল। তারা পুতুলকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। পুতুলের হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এখান থেকে সে চলে যাবে। আর কোনো দিনও হয়তো এদের সঙ্গে তার দেখা হবে না।

.

রাত একটা।

ঢাকার সব ক’টি খবরের কাগজে এই মুহূর্তে হারানো বিজ্ঞপ্তিতে পুতুলের ছবি ছাপা হচ্ছে। বড় বড় করে পুরস্কারের কথা লেখা আছে। যে কেউ পুতুলের সন্ধান দিতে পারলেই এক লক্ষ টাকা পুরস্কার।

পুতুলের মাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পুতুলের বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিজেও আর সহ্য করতে পারছেন না। তিনি বসে আছেন টেলিফোনের সামনে। টেলিফোন বাজতেই তিনি রিসিভার তুলে বলছেন, কোনো খবর আছে?

কোনো খবর নেই।

.

এরা কেউ জানে না, পুতুল ঢাকা ফিরে আসছে। সে রেলের তৃতীয় শ্রেণীর একটি কামারায় মেঝেতে বসে আছে। তার পিঠে মাথা রেখে মরিয়ম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

ট্রেন দ্রুত ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। কামরার গাড়ি-ভরা ঘুম।

কমলাপুর রেল স্টেশনে তারা পৌঁছুল শেষ রাতে। অন্ধকার কাটে নি। তবে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। তারা ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন তাদের সব কথা ফুরিয়ে গেছে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে অন্তু এবং মরিয়ম থমকে গেল। কী বিশাল বাড়ি! কী প্রকাণ্ড গেট! অন্তু বলল, এই বাড়ি?

হ্যাঁ।

তোমার বাড়ি!

হ্যাঁ।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

মরিয়ম ফিসফিস্ করে বলল, তোমরা কি দেশের রাজা?

পুতুল হা বা না কিছুই বলল না। তার চোখে পানি এসে গেছে। এই পানি সে তার বন্ধুদের দেখাতে চায় না। চোখের জল গোপন করবার জন্যেই সে ছুটে বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল।

.

মরিয়ম এবং অন্তু হাত ধরাধরি করে ফিরে চলল স্টেশনের দিকে। শীতে দু জনই কাতর। একেবারেই খালি গা বলে অন্তুর শীতটা বেশি লাগছে। সে কাঁপছে থরথর করে। মরিয়ম বলল, শীত লাগে ভাইজান?

না, লাগে না।

এক বুড়ো ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা জড় করে আগুন করেছে। হাত মেলে বুড়ো চুপচাপ বসে আছে। দু’ ভাই-বোন এগিয়ে গেল আগুনের পাশে। তাদের কচি কচি হাত মেলে ধরল আগুনের ওপর।

বুড়ো বলল, শীতে বড় কষ্ট হয়, না রে?

তারা দু জন এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কারণ এই মুহূর্তে শীতের জন্যে তাদের কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে অন্য কোনো কারণে। সেই কারণটা কী তারা পুরোপুরি জানে না। জানার কথাও নয়। যখন বড় হবে তখন হয়তো জানবে। কিংবা কে জানে হয়তো কোনো দিনই জানবে না।

Exit mobile version