ঠেলাগাড়িতে এদের দুজনকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত। দু’ জনের মাঝখানে ইয়েলো টাইগার’ কু কু করছে। তার নজর পুতুলের হাতের দিকে, সেখানে দুটি মরা মাছ এখনো আছে। ইয়েলো টাইগার সুযোগের সন্ধানে আছে! কখন মাছ দু’টি নিয়ে নিতে পারবে। পুতুল এই মতলব টের পেয়েছে। সে আছে খুব সাবধানে। মতিঝিল পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে এল। মতিঝিল পার হবার পরই ঠেলাওয়ালা ওদের নামিয়ে দিল। মুখ বিকৃত করে বলল, যা যা নাম। মাগনা গাড়ি বহুত চাপছস।
পুতুল বলল, আপনি আমাদের তুই তুই করে বলছেন কেন? ভালোভাবে বললেই তো আমরা নেমে যাই।
চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কয় আবার। এক চড় খাবি। নাম।
পুতুল নেমে গেল। অন্তুকে একটু বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। পুতুল বলল, এখন কী করবে?
হাঁটুম।
যাবে কোথায়?
ইস্টিশনে। ইস্টিশনে আমার ভইন থাকে।
ভইন বলছ কেন? বল বোন।
ওই একই কথা। যার নাম ভইন তারই নাম বোন।
তা ঠিক।
পুতুল তুমি যাইবা আমার সাথে?
না, আমি এখন বাসায় চলে যাব। এখন না গেলে মা রাগ করবে।
ইস্টিশনে আমার ভইনরে দেখবা না?
হ্যাঁ দেখব। তার কী নাম?
তার নাম হইল গিয়া মরিয়ম।
মরিয়ম?
হঁ।
হঁ বলতে নেই। বলতে হয় হ্যাঁ।
ওই একই কথা।
দু’ জন ছোট ঘোট পা ফেলে এগুচ্ছে। পুতুল লক্ষ করল অন্তু গভীর মনোযোগর সঙ্গে রাস্তা থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে।
ওইগুলো দিয়ে তুমি কী করবে?
খেলুম।
কী খেলা?
চাড়া খেলা। সিগারেটের প্যাকেট হইল টেকা। ফাইভ ফাইভের প্যাকেট হইল পাঁচ শ’ টেকা, স্টার হইল দশ টেকা, আর বেনসন হইল হাজার টেকা।
সত্যি!
বলতে বলতেই পুতুল একটা ফাইভ ফাইভের প্যাকেট পেয়ে গেল। কী অদ্ভুত উত্তেজনা! দশ মিনিটের মধ্যে দুটো গোল্ড ফ্লেক এবং একটা স্টারের প্যাকেট পাওয়া গেল। এক-একটা খালি প্যাকেট দেখা যায় আর দু’ জন একসঙ্গে ছুটে যায়। এমন আনন্দ পুতুল এর আগে কখনো পায় নি।
প্যাকেট সংগ্রহের খেলা বেশিক্ষণ চলল না। রাখার জায়গা নেই। ইয়েলো টাইগারকেও সামলাতে হচ্ছে। অন্তু এক সময় বলল, ফালাইয়া দেই, কেমন?
কেন, ফেলবে কেন?
টেকা রাখনের জায়গা নাই, করমু কি?
এত কষ্ট করে জোগাড় করা টাকা নর্দমায় ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। উপায় নেই, টাকার পাহাড় হয়ে গেছে। ফেলতেই হবে। অন্তু অবশ্যি টাকা ফেলার ব্যাপারটাতেও একটা মজা নিয়ে এল। প্রথমে কুচি কুচি করে ছেঁড়া হয়, তারপরই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। কে কত দূর নিতে পারে। দারুণ আনন্দের একটা খেলা।
ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। যদিও তার কু কু করার কোনো কারণ নেই। সে বেশ আরামেই আছে। সে আছে অন্তুর প্যান্টের পকেটে, মাথাটা শুধু বের হয়েছে। অন্তু ইয়েলো টাইগারের দিকে তাকিয়ে একটা নরম গলায় বলল, কি রে ব্যাটা, ক্ষিধা লাগছে?
ইয়েলো টাইগার অবিকল মানুষের মতো মাথা নাড়ল।
বেশি ক্ষিধা?
কুঁ কুঁ কুঁ।
অন্তু গম্ভীর গলায় বলল, জন্তু-জানোয়ার যখন ছোট থাকে তখন মানুষের কথা বুঝে। বড় হইলে বুঝে না।
পুতুল বলল, কে বলল তোমাকে?
আমি জানি।
কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?
আমি জানি।
কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?
অন্তু সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পুতুল আসছে তার পেছনে পেছনে। তার খিদে পেয়েছে। বেশ ভালো খিদে। এটা বেশ মজার ব্যাপার। বাসায় থাকার সময় একেবারেই খিদে লাগত না। এখন শুধু নানান ধরনের খাবারের কথা মনে হচ্ছে।
বাড়ি ফিরলে খিদের সমস্যাটি মেটে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। পুতুলের শুধুই মনে হচ্ছে, বাড়ি ফিরে কাউকে পাওয়া যাবে না। বাবা গেছেন কাজে। মাও নিশ্চয়ই বাইরে। এ সময় তিনি কখনো ঘরে থাকেন না।
অন্তু বলল, তোমার ক্ষিধা লাগছে?
হঁ লেগেছে।
আমারও লাগছে। জব্বর ক্ষিধা।
অন্তুর বোন বয়সে অন্তুর দু’বছরের ছোট। তাকে তার বয়সের চেয়েও ছোট দেখায়! ওদের দেখতে পেয়েই সে ছুটে এল। পুতুলের মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা যেন সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে, এক্ষণি আছাড় খেয়ে পড়বে।
মরিয়মের গায়ে একটা হলুদ রঙের ফ্রক। ফ্রকের উপর মোটা একটা খাকী রঙের স্যুয়েটার। স্যুয়েটারটা সে আজ সকাল বেলা পেয়েছে। রেলপুলিশের এক হাবিলদার দিয়েছে। এই হাবিলদারটা খুব ভালো। প্রায়ই এটা-ওটা দেয়! গত শীতে মোটা একটা কাঁথা দিয়েছিল। সেই কাঁথা বেশি দিন রাখা গেল না। এক রাতে কাঁথা গায়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছিল, সকাল বেলা জেগে দেখে-কাঁথা নেই, কে টান দিয়ে নিয়ে গেছে। তার পাশে এক বুড়ি ঘুমুচ্ছিল। নির্ঘাৎ বুড়ির কাণ্ড!
কাঁথাটা থাকলে এই শীতটা আরাম করে পার করে দেয়া যেত। এ বছর বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবে মরিয়মের মুখে কষ্টের কোনো ছাপ নেই। সে আনন্দে ঝলমল করছে,কারণ আজ তার খুব ভালো রোজগার হয়েছে। সে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে পানি বিক্রি করে। এলুমিনিয়ামের একটা জগভর্তি পানি নিয়ে মিষ্টি সুরেলা গলায় চেঁচায়– পানি পানি। ঠাণ্ডা কলের পানি। গরমের দিনে তার রোজগার ভালো হয়। শীতের সময় পানি কেউ খেতে চায় না।
অন্তু বলল, বিক্রি হইছে কিছু?
মরিয়ম হেসে ফেলল। ফ্রকের পকেট থেকে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। আজ পানি কেউ কেনে নি। কিন্তু এক ভদ্রলোক হঠাৎ টাকাটা দিয়েছেন। মরিয়ম এক কামরা থেকে আরেক কামরায় পানির জগ নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কিনছেনা। তার এত মন খারাপ হল। পানি না কিনলে আজ তাদের দুই ভাইবোনের কিছু খাওয়া হবে না। গতরাতেও তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। একটা পাউরুটি কিনে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। পাউরুটিগুলো এমন জিনিস যে, খাওয়ার পরপরই খিদে লাগে। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাদাম অনেক ভালো জিনিস অনেকক্ষণ পেটে থাকে।