করতে চাইলে নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু আমার ধারণা, ছেলেটি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। শতকরা নবৃই ভাগ ক্ষেত্রে তাই ঘটে। রাগ করে বা নিছক এ্যাডভেঞ্চারের লোভে ছেলে ঘর থেকে বের হয়, খানিকক্ষণ হাঁটিহাঁটি করে ফিরে আসে।
আমার স্ত্রী খুব অস্থির হয়েছেন। তার ধারণা, ছেলেধরার হাতে পড়েছে।
ছেলেধরা বলে কিছু নেই। বিদেশে ছেলেমেয়ে পাচার হয় বলে যে শুনি।
ভুল শোনেন। বিদেশীরা এত ঝামেলা করে ছেলেমেয়ে নেবে না। আইনের ভেতর দিয়েই তারা বাচ্চাদের দত্তক নিতে পারে। এতিমখানা আছে, সেবা সংস্থা আছে।
রহমান সাহেব তাকিয়ে আছেন। পুলিশ কমিশনারের কোনো কথা তাঁর মাথায় ঢুকছে বলে মনে হল না। কমিশনার সাহেব সহজ গলায় বললেন, আরেকটা জিনিস দেখুন। ঢাকা শহরে বাচ্চা ছেলেমেয়ের কোনো অভাব নেই। হাজার হাজার ছেলেপুলে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ফুটপাত বা রেলস্টেশনে রাত কাটায়। ছেলেধরা বলে যদি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তারা এইসব ঠিকানাবিহীন বাচ্চাদের ধরবে। আপনার বাচ্চাকে ধরে ঝামেলায় পড়তে চাইবে না।
রহমান সাহেব বললেন, আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। আপনার কথা সবই শুনলাম। পুরস্কারের ব্যাপারে আমি মনস্থির করছি।
কত টাকা পুরস্কার?
বেশ বড় এ্যামাউন্ট। এক লক্ষ টাকা!
কী বলছেন আপনি!
আমার ছেলেটা অসুস্থ। ওর দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার।
এই পুরস্কার ঘোষণা করার ফলে একটা ঝামেলা হতে পারে ছেলেটা দুষ্ট লোকের হাতে পড়তে পারে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত আমাকে সময় দিন। রাত দশটার ভেতর ফিরে না এলে পুরস্কার ঘোষণা করবেন।
ইতিমধ্যে আপনারা কী করবেন জানতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন। আমরা ঢাকা শহরের যতগুলো পুলিশ ফাঁড়ি আছে সবাইকে জানাব। ওয়্যারলেসে বাইরের থানাগুলোতেও জানান হবে। শহর থেকে বেরুবার যে-সব পথ আছে–যেমন ধরুন রেলস্টেশন, বাস লঞ্চ টার্মিনাল-সেখানকার পুলিশদের সতর্ক করে দেয়া হবে। হাসপাতাল গুলোতে খোঁজ নেব।
হাসপাতালে খোঁজ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে।
তাহলে তো কাজ আপনারা অনেক দূর এগিয়েই রেখেছেন। মাইকে আপনারা বাড়ির আশে পাশে একটা ঘোষণা দিতে পারেন। মাইকের ঘোষণায় বেশ কাজ দেয়।
দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে রাস্তায় মাইক বের হল। ছেলে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার হতে লাগল।
ভাইসব, বিশেষ ঘোষণা। একটি ছেলে হারানো গিয়াছে। তাহার বয়স এগারো। পরনে হাফ প্যান্ট এবং শার্ট। নাম পুতুল। রোগা, ফর্সা। কপালে কাটা দাগ আছে। শার্টের রঙ মেরুন। খালি পা। ভাইসব, অনুরোধ করা যাচ্ছে কেহ যদি ছেলেটির কোন সন্ধান পান…
.
জেসমিন সকাল থেকেই বারান্দায় একটি মোড়া পেতে বসে আছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর কোনো বোধশক্তি নেই।
আত্মীয়-স্বজনরা সকাল থেকেই এ বাড়িতে আসছেন। তাঁদের কারো সঙ্গেই জেসমিন কোনো কথা বলছেন না। দু’-এক জন কিছু সান্ত্বনার কথা। বলতে চেয়েছিলেন, তাঁদের জেসমিন খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছেন, দয়া করে। আমাকে বিরক্ত করবেন না।
গাছকাটার জন্যে বজলু মিয়া দু’ জন লোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তাকেও ধমক দিয়ে বিদেয় করা হয়েছে।
দুপুরের কিছু আগে নিমতলির পীর সাহেব বলে এক চ্যাংড়া ছেলেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এ নাকি হারানো লোক খুঁজে পাবার ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। যে হারিয়ে গেছে তার কিছু কাপড়চোপড় শুকলেই সে নাকি অনেক কিছু বলতে পারে।
রহমান সাহেব লোকটিকে পুতুলের শার্ট দিতে বললেন। সে অনেকক্ষণ নানানভাবে শার্ট শুকল, তারপর চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে রইল–যেন ধ্যান করছে। ধ্যান ভাঙবার পর সে গম্ভীর গলায় বলল, তারে আমি দেখতেছি একটা বাসে। জানালার পাশে বসছে। তার সাথে দাড়িওয়ালা একটা বুড়া কিসিমের লোক। ছেলেটার হাতে আছে একটা কমলা। বাসটা যাইতেছে ফরিদপুরে।
রহমান সাহেব লোকটির কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করলেন না। তবু ফরিদপুরের ডিসিকে টেলিফোন করলেন। এক জন লোক পাঠালেন ফরিদপুরে।
নিমতলির পীর সাহেবকে পাঁচ শ’ টাকা দেয়া হল এবং বলা হল সত্যি সত্যি যদি পুতুলকে ফরিদপুরে পাওয়া যায় তাহলে তিনি পীর সাহেবের জন্যে নিমতলিতে একটা ছোটখাট বাড়ি বানিয়ে দেবেন।
.
পুতুল এবং অন্তু মিয়াকে একটা ঠেলাগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। পুতুলের গায়ে গেঞ্জি নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরে গেঞ্জিটার সলিল সমাধি ঘটেছে। মাছ মারার জন্যে গেঞ্জি ব্যবহার করা হয়েছিল। দু জন দু’দিক থেকে ধরে জালের মতো টেনেছে। দুটো দারফিনা মাছ ধরা পড়েছে। পুতুল সেই মাছ ধরা পড়ায় উত্তেজনায় এতই উত্তেজিত ছিল যে গেঞ্জি যে তলিয়ে যাচ্ছে সেটা লক্ষ করে নি। মাছ দু’টি দু’ জন ভাগ করে নিল। অন্তু মিয়া ভাগাভাগির পরপরই হঠাৎ উদার গলায় বলল, আমার লাগবে না, তুমি নিয়া যাও।
পুতুল গভীর আগ্রহে মাছ দু’টি মুঠোর মধ্যে পুরল। তখনি ধরা পড়ল, গেঞ্জি নেই। সেই গেঞ্জি খুঁজতে কত কাণ্ড! পুতুলই একবার ডুবে যায় যায় অবস্থা। মোটামতো এক মহিলা টেনে তুলেই এক চড়।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, আপনি আমাকে মারলেন কেন?
মহিলাটি ঠোঁট উল্টে বলল, ও মা! পুলায় আবার শুদ্ধ ভাষা কয়। উঠ শুকনায়। আবার চড় খাইবি।
পুতুল উঠে পড়ল। নোংরা পানিতে দাপাদাপি করার ফল হয়েছে চমৎকার। পুতুলকে এখন আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সমস্ত শরীরে কাদার আস্তরণ জলছাপের মতো ফুটে উঠেছে চুল হয়েছে এলোমেলো।