পুতুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগুচ্ছে। চমৎকার লাগছে পুতুলের। তারা দু জন বড় রাস্তায় এসে পড়ল। পুতুলকে দাঁড় করিয়ে অন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের সামনে কয়েকটা খালি রিকশা। একটি রিকশার রিকশাওয়ালা পাশেই উবু হয়ে বসে চা খাচ্ছে। পুতুল দেখল অন্তু ভালো মানুষের মতো রিকশাটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যেপথে হাওয়া দেওয়া হয় সেখানে কী যেন করল। শোঁ শোঁ শব্দ হল। রিকশার মালিক লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই অন্তু হাওয়া। সে ছুটছে বিদ্যুৎগতিতে। রিকশাওয়ালা কুৎসিত গালি দিচ্ছে। বাকি সবাই দাঁত বের করে হাসছে। পুতুল এমন অদ্ভুত উত্তেজনার দৃশ্য এর আগে দেখে নি, তার গা ঝিমঝিম করছে। রীতিমতো তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। সে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। অন্তু বসে আছে। অন্তুর মুখভর্তি হাসি। তার পায়ের কাছে ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। পুতুল বলল, রিকশার চাকা নষ্ট করেছ তোমার পাপ হবে।
চাকা নষ্ট হয় নাই, শুধু হাওয়া গেছে।
তবু তোমার পাপ হবে।
অন্তুকে পাপের চিন্তায় খুব বিচলিত মনে হল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ফান্টা খাইবা?
খাব।
অন্তু এমন এক ভঙ্গি করল যেন ফান্টার বোতল ধরে আছে। এক হাতে বোতলের মুখ খুলে নিজেই বিজবিজ করতে লাগল। বোতলের গ্যাস
বেরিয়ে গেলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ।
নেও খাও।
পুতুল হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য বোতলটা নিল। অন্তু বলল, পাইপ আছে, পাইপ দিয়া তারপর খাও। মজা পাইবা।
অদৃশ্য পাইপ দিয়ে অদৃশ্য বোতল থেকে দু জনে ফান্টা খাচ্ছে। পুতুল সত্যি সত্যি খুব মজা পাচ্ছে। অন্তু আবার সত্যিকারের দু’টি ঢেকুর তুলল। বড় মজার ছেলে তো!
অন্তু, তোমার বাসা কোথায়?
বাসা নাই।
বাসা নাই মানে? রাত্রে ঘুমাও কোথায়?
ইস্টিশনে। রেল ইস্টিশন–কমলাপুর।
স্টেশনে ঘুমাও কেন?
ইস্টিশনই ভালো। কেউ কিছু কয় না। সরকারী জায়গা।
স্টেশন সরকারী জায়গা?
হুঁ। এই যে পার্ক–এও সরকারী।
তুমি অনেক কিছু জান, তাই না?
হুঁ জানি।
তোমার আব্বা আম্মাও স্টেশনে থাকেন?
মা মইরা গেছে। বাপ থাকে ময়মনসিং। ইস্টিশনে ভিক্ষা করে।
উনি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করেন?
অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পুতুল বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ।
অন্তু হাই তুলে হাল্কা গলায় বলল, মাঝেমইদ্যে আমিও ভিক্ষা করি।
তুমিও কর?
হ!
কিভাবে কর?
কোনো ভদ্দরলোক দেখলে কই-সারাদিনের না খাওয়া-একখান টাকা দিবেন?
মিথ্যা কথা বল কেন?
কোনটা মিথ্যা?
এই যে বললে, সারাদিন না খাওয়া।
মিথ্যা না। মাঝেমইদ্যে সারাদিন না খাওয়া যায়। খাওয়া-খাদ্য হইল ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে থাকলে হয়, না থাকলে হয় না।
পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী অদ্ভুত কথা বলছে ছেলেটা! খাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার!
ইয়েলো টাইগার আবার ফিরে এসেছে। অন্তুর পায়ের কাছে কুইকুই করছে। অন্তু একটা লাথি বসাল। কুকুরটা ছিটকে পড়ল দূরে। কী অদ্ভুত কাণ্ড। সেখান থেকে আবার এদিকেই আসছে। যে মারছে তার কাছেই আবার আসছে। পুতুল বলল, কুকুরটা বার বার তোমার কাছে আসছে কেন?
অন্তু তার জবাব দিল না। এবার সে ইয়েলো টাইগারকে কোলে তুলে নিল। চিৎ করে শুইয়ে পেটে কাতুকুতু দিতে লাগল। ইয়েলো টাইগার খুব মজা পাচ্ছে। কেমন গা মোচড়াচ্ছে। লেজ নাড়াচ্ছে। আবার একটু যেন হাসার চেষ্টাও করছে। কুকুর আবার মানুষের মতো হাসতেও পারে নাকি!
মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার
মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বললেন, আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।
রহমান সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার একটা ছেলে হারিয়ে গেছে-আমি ভয় পাব না?
এখন এগারোটা বাজে। ছেলেটাকে আপনি দু ঘন্টা আগে হারিয়েছেন। দু ঘন্টা সময় কিছুই না। আশে পাশে কোনো বন্ধুর বাড়িতে খেলতে গিয়েছে।
ও কোথাও যায় না।
কোথাও যায় না বলেই যে কোনো দিনও যাবে না, এমন তো কথা নেই!
রহমান সাহেব খুব চেষ্টা করলেন যাতে তাঁর কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ না পায়। সেই চেষ্টা সফল হল না। বিরক্তি প্রকাশ পেল। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
আপনি কি একটু চা খাবেন? চা দিতে বলি?
যখন তখন চা খাবার অভ্যেস আমার নেই।
রহমান সাহেব ভাবলেন নিজের পরিচয় ভালোভাবে দেবেন। তাহলে এরা হয়তো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। এ রকম আলগা দেখাবে না। দেওয়ার মতো পরিচয় তাঁর আছে। তাঁর বাবা তিন বছরের মতো শিল্পমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন–শিল্পমন্ত্রী। তাঁর দাদা খান বাহাদুর ওয়াদুদ রহমান বৃটিশ সরকারের আমলে গণ পরিষদের সদস্য ছিলেন প্রায় এগারো বছর। এবং তার নিজেরও মন্ত্রী হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। আলাপআলোচনা হচ্ছে। তিনি নিজে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না, কারণ রাজনীতি তাঁর পছন্দের বিষয় নয়।
কমিশনার সাহেব।
জ্বি, বলুন।
আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। যে আমার ছেলের খোঁজ এনে দেবে বা ছেলেটাকে এনে দেবে তার জন্যে পুরস্কার। এই পুরস্কার আপনাদের পুলিশ বাহিনীর জন্যেও প্রযোজ্য।
আপনি মনে হচ্ছে বেশি রকম অস্থির হয়েছেন।
অস্থির হবার কারণ আছে। পুতুল কখনো একা ঘরের বাইরে যায় নি। সে অসুস্থ, হার্টের একটা জটিল ব্যাধিতে ভুগছে। আমি পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই।