ছেলেটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, আমার ইচ্ছা।
আরেকটু হলে আমার পায়ে পড়ত।
না, পড়ত না। নিশানা আছে, এই দেখ।
বলেই অন্তু পরপর তিনবার থুথু ফেলল। প্রতিবারই সেই থুথু পুতুলের পায়ের আশেপাশেই পড়ল, কিন্তু পায়ে লাগল না। ছেলেটির এই ক্ষমতায় পুতুল অভিভূত হয়ে পড়ল। সে বলল, তোমার কি নাম?
অন্তু মিয়া।
এটা তোমার কুকুর?
হুঁ।
কুকুরটার কি নাম?
অখনও ঠিক করি নাই।
আমাদের একটা বিড়াল ছিল, তার নাম ছিল লিলিয়ান। ট্রাকের নিচে পড়ে লিলিয়ান মারা গিয়েছিল।
অন্তু বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটির পাশে এসে বসতে–ঠিক সাহসে কুলোচ্ছেনা। এইসব বড়লোকদের ছেলেপুলে বদের হাডিড হয়। এক্ষণি হয়তো তার বাবাকে ডেকে মার খাওয়াবে। এরা নিজেরা মারামারি করতে পারে না, অন্যকে দিয়ে মার খাওয়ায়। অন্তু বলল, তোর হাতে কি?
গুড। তুমি আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন? তুই তুই করে বলা ।
খুব খারাপ। বললে তুই কি করবি? মারবি আমাকে? আয় না দেখি কত শক্তি। আয় দেখি?
পুতুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু আমি মারামারি করব কেন?
তুই বদের হাড্ডি।
আমি কেন বদের হাড়ি হব? এসব তুমি কী বলছ!
তুই শয়তানের ঘোড়া।
তুমি এরকম করে আমাকে বকা দিচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?
তুই শিয়ালের গু।
ছিঃ। এসব নোংরা কথা কেন বলছ?
অন্তু মিয়া খুব সাবধানে অনেকখানি দূরত্ব রেখে বেঞ্চিতে বসল। কুকুরটাকে লেজে ধরে খানিকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখল। বেচারি কুইকুই করছে। এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে অন্তুকে খামচি দিতে। দিতে পারছে না। অন্তু খুব মজা পাচ্ছে। পৃভুল বলল, ওকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?
আমার ইচ্ছা।
পশু পাখিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না।
কষ্ট দিলে কী হয়?
আল্লা পাপ দেন। কুকুরটাকে ছেড়ে দাও।
অন্তু মাথার উপর একটা পাক দিয়ে কুকুরটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। পুতুলের মনে হল কুকুরটা বোধ হয় মরেই গেছে। কিন্তু না, মরে নি। সে আবার পায়ে পায়ে অন্তুর দিকেই এগিয়ে আসছে। অন্তুর পায়ের কাছে এসে কুঁই কুঁই করছে। কুকুরের ভাষা পুতুল বোঝে না, কিন্তু পুতুলের মনে হল কুকুরটা বলছে, আমাকে কোলে নাও। আমাকে কোলে নাও! অন্তু এখন আর কুকুরটার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল নিচু হয়ে কুকুরটাকে নিজের কোলে তুলে নিল। কুকুরটাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাই তুলে গা-টা এলিয়ে শুয়ে পড়ল, যেন পুতুলের কোলে শুয়ে ঘুমানোই তার অভ্যাস। পুতুল মনে মনে কুকুরটার জন্যে একটা নামও ঠিক করে ফেল–ইয়েলো টাইগার। সে অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এর জন্যে নাম ঠিক করেছি। নামটা রাখবে?
কী নাম?
ইয়েলো টাইগার।
এইটা আবার কেমন নাম?
ইয়েলো টাইগার মানে–হলুদ বাঘ।
ও বুঝছি-অইলদা বাঘ।
পুতুল হেসে ফেলল। অন্তু মিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল না। সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আধ-খাওয়া বিড়ি বের করল। আগুন না ধরিয়েই মুখে দিল। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করার ভঙ্গি করতে লাগল। পুতুল অবাক হয়ে দেখছে। অন্তু বলল, বিড়ি খাইবা?
না, সিগারেট খেলে পাপ হয়।
সিগারেট না, বিড়ি।
বিড়ি খেলেও পাপ হয়।
বিনা আগুনে খাইলে কিছু হয় না!
কে বলেছে তোমাকে?
আমি জানি।
তুমি আর কি জান?
মেলা জিনিস জানি। কেমনে রিকশার পাম ছাড়া লাগে হেও জানি।
পুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অন্তু মিয়া বিড়ির টুকরা পকেটে ঢুকিয়ে খুব দ্রুত মুখ নাড়ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা চিবুচ্ছে।
কি খাচ্ছ তুমি।
পান খাই। খাওয়া-খাওয়া খেলা।
অন্তু মিয়া আঙুলে চুন নিয়ে পানের সঙ্গে চুন মেশানর ভঙ্গি করে পানের পিক ফেলারও সুন্দর অনুকরণ করল। পুতুল এ রকম অদ্ভুত খেলা। আগে আর দেখে নি। বড় মজা তো! অন্তু বলল, রিকশার পাম কেমনে ছাড়ে তুমি জান?
না।
খুব সোজা। একটা পিন লাগে। দিয়াশলাইয়ের কাটি দিয়াও হয়।
রিকশার পাম ছাড়লে কী হয়?
হাওয়া যায় গিয়া। রিকশা চলে না।
পুতুল তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। অন্তু বলল, হরতালের সময় রিকশা বন করন লাগে- জান না?
না তো।
রিকশা সাইকেল সব বন করন লাগে। তখন হাওয়া ছাড়তে হয়।
তাই নাকি?
হ। হরতাল হইল গিয়া গরিবের জইন্যে। হরতাল করলে গরিবের ভালো হয়। দ্যাশ স্বাধীন হয়।
দেশ তো স্বাধীন হয়েছে।
আরো ভালো মতো হয়। গরিবের পেটে খানা-খাইদ্য আয়।
তুমি গরিব?
না। আমি গরিব না।
অন্তু প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দু’টি চকচকে টাকা বের করে দেখায়। যার পকেটে এ রকম চকচকে দু’টি নোট, তাকে গরিব বলার কোনো কারণ নেই। পুতুলের পকেটে তো টাকা নাই। মনে মনে পুতুল ছেলেটাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। অবশ্যি তারও টাকা আছে। ঈদের দিনে সালাম করে পাওয়া টাকা! কত টাকা যে সেদিন পায়! মা সব টাকা দিয়ে প্রাইজ বণ্ড কিনে রেখে দেন। সে যখন বড় হবে তখন পাবে। পুতুল বলল, আমারো টাকা আছে। অনেক টাকা।
কই দেহি?
এখন নেই।
অন্তু অদ্ভুতভাবে হাসল। পুতুলের মনে হল অন্তু তার কথা মোটেই বিশ্বাস করছে না। তার একটু মন খারাপ হল। ইস, অন্তুকে যদি তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রাইজ বণ্ডগুলো দেখান যেত।
অন্তু বলল, রিকশার পাম ক্যামতে ছাড়তে হয় দেখবা?
এই প্রথম সে তুমি তুমি করে বলছে। পুতুলের বড়ো ভালো লাগল। সে আগ্রহ করে বলল, দেখব। অন্তু বলল, আও আমার সাথে।