মালি বলল, ফুল নিবা সোনাবাবু?
হ্যাঁ, নেব।
ফুল ছিড়া ঠিক না। গাছের জিনিস গাছে থাকন লাগে।
মালিটা কি অদ্ভুত! নিজেই বলছে ফুল নেবে কি না, আবার নিজেই বলছে, ফুল তোলা ঠিক নয়। আর কী অদ্ভুত একটা নামে সে পুতুলকে ডাকে–সোনাবাবু। সোনাবাবু আবার কেমন নাম!
পুতুল বলল,আজ কি সোমবার?
মালি দাঁত বের করে বলল, হ সোনাবাবু, আইজ সোমবার।
আজ গাছ কাটার লোক আসবে, তাই না?
হ। আম্মা আমারে কইলে আমি কাইট্টা দিতাম, এর জইন্যে আবার বাইরের লোক লাগে–কন দেহি সোনাবাবু?
পুতুল চুপ করে রইল। মালি বলল, ও সোনাবাবু।
কি?
শীত লাগে না?
না।
খালি গেঞ্জি গায়ে শীত লাগব। একটা শার্ট পর। আর জুতা।
সে ছোট ছোট পা ফেলে গেটের কাছে চলে এল। গেট তালাবন্ধ, তবে গেটের ভেতরেও একটা ছোট্ট গেট ছিল। সেটা ভোলা। দারোয়ান আশেপাশে নেই। বোধ হয় ঘুমুচ্ছে। সারারাত জেগে থাকে বলে সে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। পুতুল কি মনে করে যেন গেটের বাইরে চলে এল। কেউ তাকে দেখল না। সে ঝাঁঝরি থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে দিচ্ছে।
পুতুল কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। রোদ উঠেছে কী সুন্দর রোদ। দেখে মনে হচ্ছে এই রোদ চুমুক দিয়ে খাওয়া যায়। পুতুল রাস্তা পার হয়ে ও মাথায় গেল। তার পরপরই হঠাৎ কি মনে করে দ্রুত পা ফেলতে লাগল। একবার শুধু পেছন ফিরে তাদের বাড়িটা দেখল। কী সুন্দর, কী প্রকাণ্ড একটা বাড়ি! বাগানবিলাস লতিয়ে উঠেছে দোতলার ছাদ পর্যন্ত। দু’রকমের পাতা ছেড়েছে–হালকা লাল এবং ঘন নীল। দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আঙুলে লাল এবং নীল রঙ মাখিয়ে কেউ এক জন বাড়িটার গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।
পুতুল এগুচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কোথায় যাচ্ছে। আসলে কিছুই জানে না। হাঁটতে ভালো লাগছে, হাঁটছে। কোনো দিন সে একা একা এত দুর আসে নি।
একটা বুড়ো লোক কাঁধে একটা ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পুতুলের মনে হল লোকটা সাপুড়ে, অবিকল এ রকম একটা সাপুড়ে এক বার সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। সে গাড়ির ভেতর থেকে দেখতে পেয়ে অনেক অনুরোধ করে গাড়ি থামিয়েছিল। জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলেছেন, সাপের খেলা একটা নোংরা ব্যাপার। এর মধ্যে দেখার কী আছে?
অল্প একটু দেখব মা–এক মিনিট।
যা দেখার গাড়ির ভেতর থেকে দেখ।
এখান থেকে তো মা দেখা যাচ্ছে না।
যা দেখা যাচ্ছে তাই দেখ। ওকি, আবার কাঁচ নামাচ্ছ কেন? ধুলো ঢুকবে।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখল পুতুল। লোকটা কী অসম্ভব সাহসী! একটা বিরাটি সাপ গলায় পেঁচিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলছে–
খা খা খা
বক্কিলারে খা
কিরপিনেরে খা
ননদীরে খা
কিরপিনেরে খা
খা খা খা
বক্কিলারে খা।
এই লোকটাও বোধ হয় সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে গলায় সাপ জড়াবে। ‘বক্কিলারে খা’ গান ধরবে। পুতুল গভীর আগ্রহ নিয়ে দাড়িওয়ালা লোকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছে।
লোকটি এক সময় অবাক হয়ে বলল, ও বাবা কি চাও তুমি?
পুতুল লজ্জিত গলায় বলল, কিছু চাই না। আপনার ঝুড়িটার ভেতরে কি সাপ আছে?
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, পুলা কেমুন কথা কয়! সাপ থাকবে ক্যান?
কি আছে?
পাটালি গুড়।
লোকটি ঝাঁকা নামিয়ে গুড় দেখাল। সুন্দর চাকা চাকা গুড়। মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
খাইবা?
জি না। লোকটা একটা গুড়ের টুকরা বাড়িয়ে দিল।
নেও বাপধন, নেও। শরমের কিছু নাই। আদর কইরা দিলাম। কী। অদ্ভুত কথা! ঝুড়ির মইধ্যে সাপ! সাপ দিয়া আমি কি করুম গো বাপধন?
লোকটি খুব হাসতে লাগল। সাপের ব্যাপারটায় সে খুব মজা পেয়েছে। লোকটির হাসি দেখে পুতুলের হাসি লাগছে।
নাম কি তোমার?
পুতুল।
পুতুল আবার কেমুন নাম?
লোকটি আবার হাসতে লাগল। এই লোকের মনে হয় হাসির রোগ আছে–যা দেখে তাতেই তার হাসি আসে।
বাড়ি কোনটে?
এটা আবার কোন ধরনের কথা, বাড়ি কোনটে। পুতুল কিছু বলল না। হাতের মুঠোয় রাখা গুড়ের দলায় ছোট্ট কামড় দিল। সুন্দর গন্ধ। খেতেও কী চমৎকার! আগে জানলে সে রোজ গুড় খেত। ভালো ভালো খাবারগুলো তাদের বাসায় কখনো আনা হয় না। এবার সে মা’কে গুড় কেনার কথা বলবে।
.
পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না এই খবরটা জেসমিনকে দেওয়া যাচ্ছে না। রমিলা খবর দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। জেসমিন ঘুম ঘুম চোখে চেঁচিয়েছেন, দরজা নাড়ছে কে? রমিলা ক্ষীণ স্বরে বলল, আম্মা আমি।
বিরক্ত করবে না।
রমিলা নিচে নেমে এল। মালি এবং দারোয়ানকে আবার পাঠাল, বাড়ির আশেপাশে খুঁজে আসবে। সে নিজে গেল ছাদে। যদিও ছাদ এর আগে একবার সে নিজেই দেখে এসেছে।
জেসমিন খবর পেলেন, সকাল নটায়।
সাড়ে ন’টার মধ্যে ঢাকা শহরের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনরা জানল, পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না।
.
পুলিশকে জানান হল বেলা দশটায়।
.
সকাল দশটা।
পুতুলকে সোহরাওয়ারদী উদ্যানে দেখা যাচ্ছে। সে বেশ আয়েশ করে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে এবং কৌতূহলী চোখে ঠিক তার বয়সী একটি ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখছে।
ছেলেটি রোগা ট্যাঙটেঙা। পরনে একটা নীল প্যান্ট। এ ছাড়া গায়ে দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই। গোলগাল মুখ। ছেলেটা একটু পরপর বয়স্ক মানুষের মতো বিরক্তিতে মুখ কোঁচকাচ্ছে। তার এক হাতে একটা কুকুরছানা। কুকুরছানাটা ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করছে। তখনই ছেলেটি মুখ বিকৃত করছে। ছেলেটির নাম অন্তু মিয়া। সেও বেশ কিছু সময় ধরে পুতুলকে লক্ষ্য করছে। এ রকম সুন্দর একটা গেঞ্জি গায়ে তার বয়েসী একটা ছেলে একা একা এখানে কী করছে সে ভেবে পাচ্ছে না। অন্তু মিয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটার সঙ্গে আলাপ জমানোর, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সে পিচ করে থুথু ফেলল। এমন ভাবে ফেলল যেন থুথু পুতুলের পায়ের কাছাকাছি পড়ে! অন্তুর নিশানা খুব ভালো। ঠিক পায়ের কাছেই পড়ল। পুতুল অবাক হয়ে বলল, থুথু দিচ্ছ কেন?