তাহলে আর চিন্তা কি? ঐ ডালিম আনতে আজই আমি প্রধান সেনাপতিকে পাঠাচ্ছি।
তাতে কোনো লাভ হবে না মহারাজ। একমাত্র রাজার কুমাররাই ঐ ডালিম আনতে পারে। আর কেউ পারে না।
লাল কমল আর নীল কমলকে পাঠিয়ে দিই।
আহা, ওরা যে দুধের শিশু। তাছাড়া আমি ওদের সৎমা। সৎমার জন্যে কেউ কি আর এত কষ্ট করে?
শুনে লাল কমল আর নীল কমল বলল, আমরা করব। আমরা মা’র জন্যে ডালিম নিয়ে আসব।
রওয়ানা হল দুই রাজকুমার। কত পথ, কত গ্রাম, কত নগর, কত অরণ্য পার করে তারা চলছে তো চলছেই। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। যেতে যেতে যেতে যেতে তারা পৌঁছল মনা রাক্ষুসীর দেশে।
পুতুল মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। রাজপুত্রদের দুঃখে তার চোখ ভিজে উঠছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে। এমন রাগ লাগছে সস্তার ওপর। এত পাজি কেন সত্যটা? ভাগ্যিস তার সম্মা নেই।
সন্ধ্যাবেলা ছোটমামা এলেন। ছোটমামাকে পুতুলের ভালো লাগে। ছোটমামা খুব মজার মানুষ। সারাক্ষণই গল্পগুজব করেন। আজ করছেন না। কেমন যেন বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছেন।
কি রে পুতুল, কি করছিস?
কিছু করছি না মামা।
পিতা এবং মাতার দু’ জনেরই কোনো খোঁজ নেই! ব্যাপারটা কেমন হল বল তো?
পুতুল তাকিয়ে আছে। পুতুলের মামা নাজমুল তার বিরক্তি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আজ সন্ধ্যায় তার এক জায়গায় যাবার কথা। ছোটখাট উৎসবের ব্যাপার আছে। সেখানে যাওয়া যাছে না। পুতুলকে তার খুবই পছন্দ। কিন্তু আজকের দিনটিতে এ বাড়িতে থাকতে না পারলেই ভালো হত?
পুতুল।
জ্বি মামা?
একটা মুশকিল হয়ে গেল রে আমার যে এক জায়গায় যেতে হয়। চলে যাও।
তুই একলা একলা থাকবি?
মা সন্ধ্যাবেলায় এসে পড়বে।
আরে না। তার আসতে আসতে রাত ন’টা। লায়নেস ক্লাবে কি যেন মিটিং।
তুমি চলে যাও।
নাজমুল চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথার চুল টানতে লাগল। মামার চিন্তিত মুখ দেখে পুতুলের মায়া লাগছে আহা, বেচারা তাকে ফেলে যেতে পারছে না, আবার থাকতেও পারছে না।
পুতুল।
জ্বি মামা?
আমার সঙ্গে যাবি? চল তোকে নিয়েই না-হয় যাই। যাবি?
যাব।
পুতুলের চোখ আনন্দে দপ করে জ্বলে উঠল। মুখ হাসি হাসি। নাজমুলের আরো বেশি খারাপ লাগছে। এই অসুস্থ নিঃসঙ্গ ছেলেটাকে সঙ্গে নেওয়া ঠিক হবে না। আপা খুব রাগ করবে। পুতুলকে ঘর থেকে বের করতেই তার আপত্তি। পুতুলের হার্টের ভাল্বে কি জানি সমস্যা আছে সে কোনো রকম উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না। এক তলা থেকে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠা পর্যন্ত নিষেধ। বুয়া কোলে করে তুলে দেয়। ফাইভ পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছে। এখন তাও বন্ধ। দু জন মাস্টার এসে তাকে ঘরে পড়ান। আগামী বছরের জানুয়ারিতে পুতুলের হার্টের ভাল্ব ঠিক করা হবে। আমেরিকার সিয়াটলের সেইন্ট লিউক হাসপাতালে। এখন তারই প্রস্তুতি চলছে।
মামা আমি কোন শার্টটা পরব?
নাজমুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তোর যাওয়াটা ঠিক হবে না রে, তুই থাক। আমিও যাচ্ছি না। আয়, গল্পগুজব করি।
তোমার তো কাজ আছে, তুমি চলে যাও। আমার অসুবিধা হবে না।
সত্যি বলছিস?
হুঁ। গল্পের বই পড়ব–লাল কমল নীল কমল।
স্যার আসবে না আজ?
আজ তো ছুটির দিন।
ও আচ্ছা। মনেই ছিল না। আমি চলে যাব তাহলে?
যাও মামা।
মন খারাপ করবি না তো?
একটু করব। বেশি না। নাজমুল চলে গেল। পুতুল কিছুক্ষণ তার লেগো সেট নিয়ে খেলল। পিস্তল বানাল, এরোপ্লেন বানাল। খানিকক্ষণ টিভি দেখল। ছুটির দিনে টিভি দেখতে কোনো বাধা নেই। খুব বাজে কি একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে টিভিতে। মোটা এক জন মানুষ চোখ বন্ধ করে একঘেয়ে স্বরে বলে যাচ্ছে–
দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নৈরাজ্য চলছে। সুকুমার কলার কিছু নীতিমালা আছে। কোনো কিছুই নিয়ম বহির্ভূত নয়। ভাঙতে হবে বলেই নিয়ম ভাঙা একটা ফ্যাসান। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফ্যাশান আমদানির যৌক্তিকতা আমাদের ভাবতে হবে। …
পুতুল টিভি বন্ধ করে গল্পের বই নিয়ে বসল। লাল কমল নীল কমলের গল্প ভোরবেলা যতটা ভালো লেগেছিলো, এখন ততটা লাগছে না। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে।
রাত ন’টা বাজতেই বুয়া তাকে ভাত খেতে ডাকল। সে নিঃশব্দে ভাত খেল। হাত-মুখ ধুয়ে ঠিক সাড়ে নটায় ঘুমুতে গেল। রমিলা বলল, আমি বারিন্দায় বইস্যা আছি। ভয়ের কিছু নাই।
আমি ভয় পাচ্ছি না তো, তুমি চলে যাও।
বাত্তি জ্বালান থাউক।
না বাতি নিভিয়ে দাও।
পুতুলের ঘুম আসছে না। কান পেতে আছে, কখন গেটে শব্দ হবে। সে বুঝতে পারবে বাবা-মা এসে পড়েছেন। সিঁড়িতে তাঁদের পায়ের শব্দ শোনা যাবে। মা ঘরে ঢুকে মশারি তুলে দেখবেন, পুতুল ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি
অপেক্ষা করতে করতে পুতুল একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। তার বাবা-মা এলেন তারো অনেক পরে।
খুব ভোরে পুতুলের ঘুম ভাঙল
খুব ভোরে পুতুলের ঘুম ভাঙল।
আধার ভালো করে কাটে নি। জানালার পাশে পাখি কিচমিচ করছে। বাগানে হাল্কা কুয়াশা। পুতুল নিঃশব্দে একতলায় নামল। বুয়া টেবিল সাজাচ্ছে রান্নাঘরে বাবুচি নিজের মনে কি সব কথা বলছে, আর ঘটাং ঘটাং শব্দ করছে।
রমিলা পুতুলকে দেখে বলল, খালি পাও ক্যান গো? আম্মা রাগ করব!
পুতুল হাসিমুখে বলল, দরজা খুলে দাও।
ক্যান?
বাগানে যাব। কুয়াশা দেখব।
রমিলা দরজা খুলে দিল। দোতলার জানালা থেকে মনে হচ্ছিল বাগানে কুয়াশা, এখানে এসে তা মনে হচ্ছে না। মালি সবে ঘুম থেকে উঠেছে। কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছে আর কালো রঙের থু থু ফেলছে। পুতুলেরও এ রকম কালো রঙের থু থু ফেলতে ইচ্ছে হল। চাইবে নাকি কয়লার গুড়ো?