পুতুল।
জি মা?
আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।
আচ্ছা।
তোমার একা একা লাগবে না তো?
উঁহু।
উঁহু আবার কেমন শব্দ? বল–না।
না।
লক্ষ্মী হয়ে থাকবে সারাদিন।
আচ্ছা।
খেলবে, গল্পের বই পড়বে। বিকেলে তোমার ছোটমামা এসে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে।
আচ্ছা।
গল্পের বই আছে তো তোমার? মানে নতুন গল্পের বই-পড়া হয় নি এমন।
আছে, লাল কমল নীল কমল।
খুব ভালো। বসে বসে লাল কমল নীল কমল পড়। আজ আরো কিছু নতুন বই কিনে দেব। খিদে পেলে বুয়াকে বলবে, সে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দেবে।
আচ্ছা।
মা লাল রঙের গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বেরুলেন বাবা। মা তার গাড়ি নিজেই চালান। বাবা কখনো নিজে চালান না। বাবার সাদা ডাটসান ড্রাইভার চাচা চালায়। যাবার আগে বাবা সব সময় তাকে আদর করেন। অদ্ভুত আদর। দু আঙুলে পুতুলের নাক চেপে বলেন–
কুটু কুটু পুটু পুটু ইট পুট
পুতুল সোনা খুটখুট।
ঔ ঔ হৈ চৈ
পুতুল সোনা কৈ কৈ?
তিনি এমন শক্ত করে নাক চেপে ধরেন যে পুতুলের রীতিমতো ব্যথা করে, তবু বাবার আদর এত ভালো লাগে! তার ইচ্ছে করে বাবা সারাক্ষণ তার নাক চেপে ধরে, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলুক। মা’র আদরও তার খুব ভালো লাগে। মা আদর করেন ঘুমুতে যাবার আগে। কিছুক্ষণ মাথায়
বিলি কেটে বলেন, এত সুন্দর চুল কেন তোমার বল তো? শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। এই বলে তিনি তার কপালে চুমু খেয়ে গল্প বলা শুরু করেন। কী যে সুন্দর সে সব গল্প। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। মা অবশ্যি একটার বেশি গল্প কখনো বলেন না। গল্প শেষ হওয়া মাত্র নীল বাতি জ্বালিয়ে মশারি ঠিকঠাক করে বলেন, গুড নাইট পুতুল সোনা।
গুড নাইট মা মনি।
সুইট ড্রিমস।
সুইট ড্রিমস মা মনি।
আজ বাবা চলে যাবার সময় পুতুলকে আদর করেন নি। হয়তো মনে ছিল না। সব সময় কি আর আমাদের সব কিছু মনে থাকে? পুতুল লাল কমল নীল কমল বই নিয়ে রেনট্রি গাছের নিচে গিয়ে বসল। ঠিক তখন দেখল, বাবার গাড়ি ফিরে আসছে। এত তাড়াতাড়ি বাবা চলে এলেন! এক মিনিটও তো হয় নি বাবা গিয়েছেন।
রহমান সাহেব ফিরে এসেছেন ছেলেকে আদর করবার জন্যে। তাঁর গাড়ি যখন বড়ো রাস্তায় পড়েছে, তখনি মনে হয়েছে একটা ছোট্ট ভুল করা হল। বাচ্চারা এইসব জিনিস খুব মনে রাখে। ছোটবেলায় তাঁকে ঠিক একই ভাবে আদর করতেন মতি চাচা। দু আঙুলে নাক চেপে গ্রাম্য একটা ছড়া বলতেন–
নিমের পাতা তিতা রে
জামের পাতা নীল।
গাঙের পারে বইয়া বইয়া
গাঙের পানি গিল।
বলতেন অতি দ্রুত। কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যেত না, কিন্তু শুনতে এত সুন্দর লাগতো। যতবার মতি চাচা তাদের বাড়িতে আসতেন, তত বারই এই ঘটনা ঘটত। শুধু একবার ঘটল না। মতি চাচা ভুলে গিয়েছিলেন। হয়তো। তার কী যে কষ্ট হয়েছিল। মনে আছে কষ্টের তীব্রতায় খাটের নিচে বসে তিনি খানিকক্ষণ কেঁদেও ছিলেন। শিশুরা খুব অভিমানী হয়। পুতুলও আজ হয়তো মন খারাপ করে আছে। কে জানে হয়তো-বা কাঁদছে।
তাছাড়া গাছ কাটার ব্যাপারে তার মনে একটা খটকা লেগেছে। হয়তো এটা নিয়ে সে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। ভালোমতো আলোচনা করে এই কষ্টটাও দূর করা উচিত। দরকার হলে গাছ কাটা পিছিয়ে দিতে হবে। অবশ্যি জেসমিন তাতে রাজি হবে না।
.
তিনি লক্ষ্য করছেন পুতুল রেনট্রি গাছের নিচে বই হাতে বসে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পুতুল।
জ্বি বাবা।
কাছে আস।
পুতুল সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। ঠিক তখনই টেলিফোন বাজল। রহমান। সাহেব টেলিফোন ধরতে ভেতরে চলে গেলেন। টেলিফোন এসেছে জয়দেবপুর থেকে। তার মোল্ডিং কারখানায় কী সব ঝামেলা হচ্ছে। শ্রমিকরা ওভারটাইম চেয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছে, এক্ষণি যাওয়া দরকার। তিনি মুখ অন্ধকার করে বেরিয়ে গেলেন। যার জন্যে এসেছিলেন, তা-ই করা হল না। পুতুলকে আদর করতে আবার ভুলে গেলেন।
রোদ বেশ কড়া। পুতুলের গরম লাগছে। শার্ট খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করলেও খোলা যাবে না। খালি গায়ে থাকা খুব অভদ্রতা। মা জানলে খুব রাগ করবেন। পুতুল বই খুলে পড়তে শুরু করল–
অনেক কাল অনেক কাল আগে বনের ধারে বাস করতেন এক রাজা। সেই রাজার দুই পুত্র–নীল কমল, লাল কমল। এই দু জন রাজার দু চোখের মণি। এরা চোখের আড়াল হলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। যখন সিংহাসনে বসেন, তার দু পুত্রকে দু পাশে বসান। যখন খেতে বসেন তখনো দু ভাই দু’ পাশে। রানী সোনার থালা থেকে মাছের মুড়ো তুলে দেন রাজার পাতে। রাজা সেই মুড়ো দু’ ভাগ করে তুলে দেন দুই ছেলের থালায়। এইসব দেখে রানী ছটফট করেন হিংসায়। কারণ তিনি আসল মা– নন। তিনি লাল কমল আর নীল কমলের সত্য। এই দু জন তাঁর চোখের বালি, গলার কাঁটা। দিন-রাত ফন্দি করেন কী করে এই দু’ জনকে দূর কোনো দেশে নির্বাসন দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একদিন তাঁর মাথায় বুদ্ধি এল। খাটে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলেন। রাজা ছুটে এসে। বললেন–
কী হয়েছে রানী?
রানী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি আর বাঁচব না গো, আমার হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম হয়েছে।
সে আবার কী!
এই ব্যারামে শুধু হাড় মুড়মুড় করে–ওগো, আমি আর বাঁচব না গো।
এর কি কোনো অষুধ নেই?
অষুধ থাকবে না কেন? এক শ’ বার আছে। সতেরো নদী যে দেশে এক জায়গায় মিলেছে সেই দেশের রাজবাড়ির বাগানে আছে এক ডালিম গাছ। সেই ডালিম গাছে বছরে একটি মাত্র ডালিম হয়। ভয়ঙ্কর এক কালকেউটে সেই ডালিম পাহারা দেয়। ঐ ডালিম খেলেই আমার অসুখ সারবে।