পুতুল মাথা নাড়ল। সে বলতে চায়। রহমান সাহেব বললেন, কী বলতে চাও বাবা?
গাছগুলো কেন কাটবে?
গাছ কাটা তোমার পছন্দ নয়?
না।
ছোটরা অনেক কাজ করে, যেগুলো বড়োরা পছন্দ করে না। আবার ঠিক তেমনি বড়োরা অনেক কাজ করে যা ঘোটরা পছন্দ করে না। গাছগুলোতে শুয়োপোকা হয়, তোমার মা এই পোকাটা সহ্য করতে পারেন না।
পুতুল চুপ করে রইল। রহমান সাহেব বললেন, তাছাড়া আরেকটা কারণও আছে। গাছগুলোর জন্যে ঘরে আলো-হাওয়া তেমন ঢুকতে পারে না। এখন দেখবে প্রচুর রোদ আসবে। এখন যাও, যা করছিলে কর।
পুতুল তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। বাবা তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলেন নি, এজন্যে তার খুব ভালো লাগছে। অবশ্যি কেউ তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলে না। তার শরীর ভালো নয়, এই জন্যে। এ বাড়িতে যে আসে সেই বলে, তোমার শরীর কেমন পুতুল? বলেই খুব করুণ করে তাকায়। পুতুলের বিশ্রী লাগে। করুণ করে কেন তাকাবে? সে কি কাউকে বলেছে। করুণ করে তাকাতে?
পুতুল দেখল চায়ের কাপ হাতে মা বাগানে আসছেন। মা’র মুখ গম্ভীর। হয়তো বাবার সঙ্গে ঝগড়া করবেন। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করার সময় বা ঝগড়ার ঠিক আগে মা’র মুখ এমন গম্ভীর থাকে। গম্ভীর থাকলেও মা’কে খুব সুন্দর লাগে পুতুলের। মা হচ্ছেন পরীর মতো সুন্দর। এখন তিনি পরেছেন একটা নীল শাড়ি। সকালবেলার রোদে নীল শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে তাঁকে! মনে হচ্ছে সত্যি একটা নীল পরী। পুতুলদের বাগানে বেড়াতে এসেছে। কিছুক্ষণ বেড়াবে, নাচবে, গান গাইবে, তারপর আকাশে উড়ে চলে যাবে।
জেসমিনের আজ খুব মেজাজ খারাপ। কাজের মেয়েটা একটা কুকাণ্ড করেছে। বেলজিয়াম থেকে আনা কুকি জার’টা ভেঙে ফেলেছে। তাঁর খুব সখের জিনিস। টাকা খরচ করলেই এসব জিনিস পাওয়া যায় না।
বাগানে এসে তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। তিনি দেখলেন পুতুল মাটিতে কী সব আঁকাআঁকি করছে। পায়ে জুতো স্যান্ডেল কিছু নেই। গায়ে পাতলা একটা শার্ট। কে জানে হয়তো শার্টের নিচে গেঞ্জিও নেই।
পুতুল।
জ্বি মা?
মাটি ছানছ কেন? মাটি দিয়ে এটা কী ধরনের খেলা?
পুতুল চুপ করে রইল। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কেউ কড়া কোনো কথা বললে তার কান্না পেয়ে যায়।
পা খালি কেন? এগারো বছর বয়স হয়েছে, এখনো সব শিখিয়ে দিতে হবে? সকালে নাশতা খেয়েছ?
হ্যাঁ।
কী খেয়েছ?
পরিজ, ডিম, কলা, একটা রুটি-মাখন।
দুধ খাও নি?
না।
কেন খাও নি জানতে পারি?
পরিজ দুধ দিয়ে খেয়েছি তাই …
পরিজ তো দুধ দিয়েই খায়। পরিজ কি কেউ পানি দিয়ে খায়? তোমাকে কি বলা হয় নি সমস্ত দিনে দু’গ্লাস দুধ খেতে হবে? সকালে এক গ্লাস, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় এক গ্লাস।
পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন বিরক্ত মুখে বললেন, যাও, সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধোও। দুধ খাও আর একটা সোয়েটার গায়ে দাও। আমি যা যা অপছন্দ করি তুমি বেছে বেছে সেই সব কর। খুব অন্যায়।
পুতুল চলে যেতেই জেসমিন রহমান সাহেবের দিকে তাকালেন। খুব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি মাটিতে বসে আছে কেন?
এমনি বসলাম।
তোমাকে দেখে তোমার ছেলে এইসব শিখছে। কাউকে বললেই তো বাগানে একটা চেয়ার এনে দিত। এমন তো না যে ঘরে লোকজনের অভাব।
রহমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জেসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এই তো পাজামায় দাগ লাগিয়ে ফেলেছ।
একটু-আধটু দাগ লাগলে কিছু হয় না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে মেজাজ খারাপ না করাই ভালো। আমার সঙ্গে ঝগড়া যদি করতেই হয়, বড়ো কোনো ব্যাপার নিয়ে কর।
তার মানে?
রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। বারান্দায় ইয়াসিন এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি হাতের ইশারায় ইয়াসিনকে দুটি চেয়ার দিয়ে যেতে বললেন। ইয়াসিন সঙ্গে সঙ্গে দুটি বেতের চেয়ার দিয়ে গেল। রহমান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, বস জেসমিন একটা জরুরী ব্যাপার নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করি।
কী জরুরী ব্যাপার?
আগে বস, তারপর বলছি।
বসতে-টসতে পারব না। যা বলার বল।
তোমার কি মনে হয় না পুতুল খুব একা একা থাকে?
একা একা থাকবে কেন? বাড়িতে প্রচুর লোকজন আছে। তা আছে, তবু আমার মনে হয় ও একটু একা। আমি তাকে সময় দিতে পারি না। তুমি ব্যস্ত থাক তোমার কাজকর্ম নিয়ে।
তুমি কি চাও আমি সব ছেড়েছুঁড়ে ছেলে কোলে নিয়ে সারাদিন বাসায় থাকি?
না-না, তা চাইব কেন? আমাদের সবারই তো নিজের কাজ আছে। তবুও অসুস্থ ছেলে, ঠিকমতো যদি …
তুমি কি বলতে চাও আমি ঠিকমতো ওর যত্ন নিই না?
পুতুল দুধ খেতে খেতে শুনল মা-বাবা দু জনই খুব উঁচু গলায় কথা বলছেন। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনের এমন চমৎকার সকালে কেউ এ-রকম করে কথা বলে?
দুধ খেতে তার বিশ্রী লাগছে। প্রায় বমি চলে আসছে। উপায় নেই, খেতে হবে। খাওয়া জিনিসটা যদি পৃথিবী থেকে উঠে যেত কি চমৎকার হত। এ রকম একটা দেশ যদি থাকত, যেখানে কাউকে কিছু খেতে হয় না–বিশেষ করে দুধ।
রমিলা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। পুতুল করুণ গলায় বলল, খেতে পারছি বুয়া। রমিলা বলল, না খাইলে আম্মা রাগ হইব। কষ্ট কইরা খাইয়া ফেল গো সোনাচান।
বমি চলে আসছে। বেসিনে ফেলে দিই?
আম্মা জানতি পারলে সর্বনাশ।
মা জানবে না।
বলতে বলতে পুতুল দুধের গ্লাস বেসিনে উল্টো করে দিল। ঠিক তখন জেসমিন ঢুকলেন। ব্যাপারটা তিনি লক্ষ করলেন। পুতুলের বুক ধুকধুক করছে। হাত-পা ঘামছে। কে জানে হয়তো মা বুঝে ফেলেছেন।