অন্তুর বাবা মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখছে, আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রান্না সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছে। যেমন একবার বলল, লবণ নাই, বুঝছস? অন্তুরে দিয়া এক ছটাক লবণ আনাইস।
পুতুল বসেছে মরিয়মের পাশে। মরিয়মের দেখাদেখি হাত মেলে দিয়েছে আগুনের ওপর। আগুনের আঁচ বড় ভালো লাগছে! পুতুল বলল, কী রান্না হচ্ছে?
তিন মিশাল।
তিন মিশাল আবার কি?
ভাত ডাইল আর তরকারি। তিনটা একত্রে! খাইতে খুব মজা।
তাদের পাশেও আরেকটি পরিবার রান্না চাপিয়েছে। চার পাঁচটা ছোট ছোট শিশু হাঁড়ির চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। তাদের মা খুন্তি দিয়ে হাঁড়ি নাড়ছে এবং গল্প করছে। খুব মজার কোনো গল্প নিশ্চয়ই, কারণ মরিয়মও কান পেতে আছে সেই গল্পের দিকে।
পুতুল কিছু জিজ্ঞেস করলে এখন আর সে জবাব দিচ্ছে না। পুতুলও গল্প শুনছে। তবে কিছু বুঝতে পারছে না। গ্রাম্য ভাষায় গল্প বলা হচ্ছে, উচ্চারণও কেমন অদ্ভুত! মেয়েটি কেমন টেনে টেনে বলছে। মাঝে মাঝে গানের মতো আছে–সুর করে গাইছে।
তুলারাশি রাইজ কইন্যা তখন আর কী করে? উত্তরে চায়, দক্ষিণে চায়, পুব আর পশ্চিমে চায়। কোনো দিশা পায় না।
চউক্ষের পানিতে কইন্যার
বদন ভাইস্যা যায়
কইন্যা বলে ভাই গো আমার
কি হইবে উপায়?
তখন রাইজ কইন্যার ভাই কইল, ও আমার সোনা ভইন। চউখ মুছ। আমি থাকতে তোমার কোনো বিপদ নাই। দেখি আমি থাকতে কে তোমারে কি কয়। এই কথা বইল্যা হে তলোয়ার হাতে নিল।
তলোয়ার হাতে লইয়া ভাইয়ে
ভইনের দিকে চায়।
ভইনের দুঃখ দেইখ্যা তাহার
কইলজা পুইড়া যায়।
ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও পুতুলের শুনতে চমৎকার লাগছে। গানের সুরে তুলারাশি কন্যার দুঃখের কথা বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলল। পুতুলেরও চোখ ভিজে গেল। গলা ভার ভার হল। এত কষ্ট কেন তুলারশি কন্যার?
তিন মিশাল হাঁড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তু এসে উপস্থিত। হাত ধুয়ে সে সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেল! অন্তুর বাবা খাবে না। তার জ্বর বোধ হয় আরো বেড়েছে।
একেবারেই লবণবিহীন রান্না। পাশের মেয়েটির কাছ থেকে লবণ এনে মরিয়ম প্লেটে ছিটিয়ে দিল। তরল এক ধরনের জিনিস তৈরি হয়েছে। পুতুলের কাছে মনে হচ্ছে–এত চমৎকার খাবার সে বহুদিন খায় নি। দু’বার সে চেয়ে নিল। আরো একবার নিত, কিন্তু তার লজ্জা করছে। হাঁড়িতে অল্প কিছু খাবার এখনো রয়েছে। অন্তুর বাবার জন্যে রয়েছে। জ্বর কমলে খাবে।
অন্তু এবং মরিয়ম থালা বাসন ধুতে গেল। পুতুল বসে রইল অন্তুর বাবার কাছে। অন্তুর বাবা বলল, ঘুম ধরলে ঘুমাও। জায়গা আছে।
পুতুল বলল, আমার ঘুম ধরে নি। আর ধরলেও এত নোংরা বিছানায় আমি ঘুমূব না। অন্তুর বাবা অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসল।
তোমার নাম কি?
আমার নাম পুতুল। আপনার কি হয়েছে?
আমার কি হইছে, হেইডা কোনো কথা না। তুমি কেডা ঠিক কইর্যা কও।
বলছি তো আপনাকে। আমার নাম পুতুল।
বুঝছি তুমি বাড়ি থাইক্যা পালাইছ।
পালাই নি তো। কাউকে না বলে চলে এসেছি।
কী সব্বনাশের কথা!
এখন চলে যাব। রাতে ঢাকায় যাবার ট্রেন আছে। অন্তু আমাকে দিয়ে আসবে।
তুমি যে ধনী মাইনষের পুলা এইডা বুঝি নাই। তোমার কথা শুইন্যা বুঝলাম।
অন্তুর বাবা আবার শুয়ে পড়ল। জ্বরের ঘোরে সে বসে থাকতে পারছে না। বড় মায়া লাগছে পুতুলের। এই লোকটি এত অসুস্থ, অথচ ডাক্তারের কথা কেউ বলছে না।
অন্তু এবং মরিয়ম ফিরে এসে টাকা গণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ সারা দিনে যে ক’টাকা পাওয়া গেছে সেগুলো গুণল। একটা বালিশের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আরো কিছু টাকা বের করল। সব মিলিয়ে তিন শ’ ছ’ টাকা আছে। মরিয়ম হাসিমুখে বলল, ট্যাকা জমাইতাছি।
কেন?
কেনর জবাব দিল অন্তু। তারা সবাই মিলে টাকা জমাচ্ছে, যখন পাঁচ শ’ টাকা হবে, তখন জমান শেষ হবে। সবাই মিলে তারা দেশের বাড়িতে চলে যাবে। তাদের বাবা এ টাকায় একটা ছোট্ট দোকান দেবে। ঐ দোকানের টাকায় তাদের সংসার চলবে। দুই ভাই-বোন ভর্তি হবে স্কুলে। তারপর তারা ছোট্ট এক টুকরা জমি কিনবে। সেই জমিতে তাদের বাড়ি হবে। একটা নৌকাও কিনবে। নৌকা নিয়ে বিলে মাছ মারতে যাবে।
মুগ্ধ কণ্ঠে বলছে অন্তু। মাঝে মাঝে কিছু বাদ পড়ে গেলে মরিয়ম তা ধরিয়ে দিচ্ছে। যেমন গাই কেনার কথা বলতে অন্তু ভুলে গিয়েছিল। মরিয়ম মনে করিয়ে দিল।
পুতুল বলল, তখন তোমাদের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাব। আমরা খুব আনন্দ করব।
তোমাদের আম-কাঁঠালের বাগান আছে?
গেরামে আছে। বেত ফলের বন আছে। ডেফলের গাছ আছে। ডেফল চিন?
না।
তিনটা কইরা কোয়া থাকে। মিষ্টি।
অন্তুর বাবার জ্বর খুব বেড়েছে। সে বিড়বিড় করে কী সব বলছে। মরিয়ম বা অন্তু কেউ সে-দিকে তেমন নজর দিচ্ছে না। রাত এগারোটায় ঢাকা মেইল আসবার ঘন্টা পড়তেই সে অন্তুকে বলল, পুলাডারে তার বাসাত দিয়ে আয়। কার না কার পুলা–বাপ মায় কানতাছে।
অন্তু এবং মরিয়ম দু জনই উঠে দাঁড়াল। তারা পুতুলকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। পুতুলের হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এখান থেকে সে চলে যাবে। আর কোনো দিনও হয়তো এদের সঙ্গে তার দেখা হবে না।
.
রাত একটা।
ঢাকার সব ক’টি খবরের কাগজে এই মুহূর্তে হারানো বিজ্ঞপ্তিতে পুতুলের ছবি ছাপা হচ্ছে। বড় বড় করে পুরস্কারের কথা লেখা আছে। যে কেউ পুতুলের সন্ধান দিতে পারলেই এক লক্ষ টাকা পুরস্কার।