অন্তু ইয়েলো টাইগারটাকে ফেলে এসেছে ট্রেনে। এই নিয়ে তার মনে কোনো রকম ক্ষোভ বা দুঃখ লক্ষ করা যাচ্ছে না। কুকুরের কথা এখন সে পুরোপুরি ভুলে গেছে।
পুতুলের শীত করছে। বেশ ভালো শীত। খোলা মাঠের উপর দিয়ে বইছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। পুতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। সে অবশ্যি কিছু বলল না। অন্তুর গা খালি। সে কিছু বলছে না। পুতুল কেন শুধু শুধু বলবে? সে দুটি হাত গুটিয়ে বুকের উপর নিয়ে এসে বাতাসের ঝাঁপটা সামাল দেবার চেষ্টা করছে।
অন্তু অন্ধকারেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। কানে কানে মরিয়মকে কী যেন বলতেই সে তার স্যুয়েটার খুলে দিল। পুতুল বলল, আমার লাগবে না।
মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, শীতে কাঁপছে, আর কয়, আমার লাগবে না। হি হি হি।
পুতুল বলল, তোমাদের শীত লাগে না?
অন্তু বলল, না।
লাগে না কেন?
আমরা হইলাম গিয়া গরিব। গরিব মাইনষের শীত লাগে না।
গরিব মানুষের শীত লাগে না কেন?
অন্তু বিরক্ত হয়ে বলল, জানি না।
মরিয়ম বলল, গরিবের শীত কম লাগে। এইডা হইল গিয়া নিয়ম।
কে বানিয়েছে এই নিয়ম?
আল্লা বানাইছে।
আল্লা দু রকম নিয়ম বানিয়েছেন কেন–ধনী মানুষের জন্যে এক রকম নিয়ম, আবার গরিব মানুষের জন্যে অন্য রকম নিয়ম?
এইডা তুমি আল্লারে জিগাও। হি হি হি। খালি পাগলের লাহান কতা কয়।
তারা ময়মনসিং রেল স্টেশনে এসে উঠেছে। প্রচুর আলো, ভিড়, হৈচৈ। একসঙ্গে দুটি ট্রেন এসে থেমেছে। অনেকেই কুলি কুলি করে চেঁচাচ্ছে। কুলি পাচ্ছে না। এক জন প্রকাণ্ড একটা স্যুটকেস কিছু না বলেই অন্তুর মাথায় তুলে দিয়ে বলল, রিকশায় তুলে দে, এক টাকা পাবি। স্যুটকেস মাথায় নিয়ে অন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পা কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে।
অন্তু বলল, স্যুটেকেস নিমু না। অন্য লোক দেখেন।
চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। কাজ দিলে কাজ করবে না। আছে শুধু চুরির মতলবে। হাঁটা শুরু কর, নয় তো টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব।
লোকটা একটা ধাক্কা দিল অন্তুর পিঠে। অন্তু দুলতে দুলতে এগুচ্ছে। মরিয়ম ছুটে গিয়ে স্যুটকেসের একমাথা ধরল, যাতে ভাইয়ের কিছু সাহায্য হয়। পুতুল ভেবে পেল না মানুষরা এত খারাপ কীভাবে হয়। সে নিজে যে-স্যুটকেস নিয়ে হাঁটতে পারে না, সেই স্যুটকেস একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় কী করে তুলে দেয়!
পুতুল হঠাৎ দেখল অন্তু এবং মরিয়ম ভিড় কাটিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাদের তাড়া করছে। তারা খানিকটা উত্তেজিত, তবে দু জনের মুখই খুব হাসি হাসি। দ্রুত এরা ওভারহেড ব্রীজে উঠে পড়ল। পুতুল ছুটে গেল ওদের দিকে। একটা কোনো মজার কাণ্ড নিশ্চয়ই হয়েছে। কারণ দূর থেকেই অন্তু এবং মরিয়মের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে।
কাণ্ডটা এ রকম–অন্তু এবং মরিয়ম বহু কষ্টে স্যুটকেসটা গেট দিয়ে বের করেছে। গেটের বাইরে বড় নর্দমা। অন্তু হঠাৎ কেউ কিছু বুঝবার আগেই স্যুটকেস ফেলে দিল নর্দমায়। ফেলেই এক দৌড়। স্যুটকেসের মালিক স্যুটকেস ফেলে পেছনে পেছনে আসতে পারছে না।
ঘটনায় মরিয়ম খুব বেশি মজা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই হি হি হি। শেষ পর্যন্ত চিমটি দিয়ে তার হাসি থামাতে হল। তার হাসিরোগটা এমন, যে মাঝে মাঝে চিমটি দিয়ে থামাতে হয়। প্রচণ্ড রকম ব্যথা পেলে তবেই হাসি থামে।
তারা ওভারব্রীজে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। বলা যায় না, লোকটা ফিরে আসতে পারে। ফিরে আসতে দেখলে দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে।
ওভারব্রীজে বসে থাকতে বড় মজা লাগছে পুতুলের। ওপর থেকে ট্রেনগুলোকে কেমন সাপের মতো দেখায়। যখন চলতে শুরু করে মনে হয় সাপটার ঘুম ভেঙেছে। হেলে-দুলে যাচ্ছে খাবারের খোঁজে।
অন্তু পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা মজা দেখবা?
কী মজা?
এইখানে থাইক্যা লাফ দিয়া ট্রেনের ছাদে পরমু।
ইশ।
ইশ না, এই দেখ।
বলতে না-বলতেই অন্তু সত্যি সত্যি লাফিয়ে ট্রেনের ছাদে পড়ে গেল। পুতুল স্তম্ভিত। মরিয়ম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, খালি বাহাদুরি দেখায়। লাফ দিতে সবেই পারে।
তুমিও পার?
হ। দেখবা?
না, আমি দেখতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।
দেখার মইদ্যে আবার ডর ক্যান!
না, তোমাকে দেখাতে হবে না। আমার সত্যি ভয় লাগছে।
মরিয়ম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাজানরে খুইজ্যা বাইর করি। খিদা লাগছে।
পুতুলের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না! সে মুগ্ধ চোখে অন্তুর কাণ্ডকারখানা দেখছে। অন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেনের একটা কামরা থেকে অন্য কামরায় যাচ্ছে। এর মধ্যে গার্ড বাঁশি বাজিয়ে সুবজ বাতি দেখাচ্ছে। ট্রেন হুইসেল দিয়ে চলতেও শুরু করেছে, অথচ অন্তু নির্বিকার। ভয়ে পুতুলের বুক কাঁপছে। সে কাঁপা গলায় বলল, অন্তু আসছে না কেন?
মরিয়ম বলল, আসব।
ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে তো।
ছাড়লেও সে আসব।
মরিয়ম প্রায় জোর করে পুতুলের হাত ধরে তিন নম্বর প্ল্যাটফরমের দিকে এগুচ্ছে। সে তার বাবাকে খুঁজে বের করবে। রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে।
অন্তু এবং মরিয়মের বাবা জ্বরে প্রায় অচেতন। তবু এই অবস্থাতেও মরিয়মকে দেখে হাসল। নিচু গলায় বলল, অন্তু কই?
আইতাছে।
জ্বরে কাবু হইলাম, বুঝছস! বেজায় জ্বর।
খাইছ কিছু?
না।
পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্তুর বাবা তাকে একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। মরিয়ম মুহূর্তের মধ্যে কাজে লেগে পড়ল। তিনটি ইটের উপর একটা এলুমিনিয়ামের ডেকচি বসিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যে চুলায় আগুন ধরাল। কল থেকে পানি আনল।