লোকটি বলল, এইসব বিচ্ছুরা সবাই চোর। ছোটবেলায় করে চুরি, বড় হলে করে গুণ্ডামি।
কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছে। পুতুল সবই বুঝতে পারে। এ্যাংলো এক মেম সাহেব তাকে ইংরেজি পড়ায়। সে বুঝবে না কেন? এদের চেয়ে ভালো ইংরেজি সে নিজেও বলতে পারে।
মেয়েটি বিরক্ত মুখে ফ্লাস্ক এগিয়ে দিল। ফ্লাস্ক হাতে নিতে নিতে পুতুল চমৎকার ইংরেজিতে বলল, বাচ্চাদের চোর বলতে নেই। চোর বললে আল্লাহ্ তোমাদের পাপ দেবেন।
মেয়েটি এবং তার স্বামী কী যে অবাক হয়েছে! চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি বলল, এই ছেলে, এই শোন শোন। ততক্ষণে পুতুল চলে গিয়েছে। ফ্লাস্ক ভর্তি করে সে নিজে নিয়ে এল না। অন্তুকে দিয়ে পাঠাল।
মেয়েটি বলল, ঐ ছেলেটা কে?
অন্তু উদাস গলায় বলল, কেউ না।
কেউ না মানে? তোমার কে হয়?
ভাই হয়।
তোমরা কী কর?
পানি বিক্রি করি। ভিক্ষা করি।
ঐ ছেলেটাকে ডেকে আনতে পারবে? ডেকে আনতে পারলে দশটা টাকা দেব। যাও তাড়াতাড়ি কর, গাড়ি ছেড়ে দেবে।
অন্তুর কোনো রকম তাড়া দেখা গেল না। সে তার ইয়েলো টাইগারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুতুলকে ডেকে আনলেই টাকা দেবে– এই কথা তার এক বিন্দু বিশ্বাস হল না। টাকা এত সস্তা নয়।
ঢাকা মেইল এক ঘন্টা থাকবে, এই গুজব সত্যি হল না আধ ঘন্টার মাথায় গার্ড সবুজ নিশান উড়িয়ে দিল। পুতুলদের রোজগার মন্দ নয়। এগারো টাকা আট আনা। এর মধ্যে একটা টাকা চালান যাবে না বলে মনে হচ্ছে। ছেঁড়া টাকা। তবু দশ টাকা আট আনাই-বা মন্দ কি? টাকা সব অন্তুর পকেটে। খরচ সে-ই করবে। পুতুল মৃদু গলায় বলল, আমাকে একটা টাকা দেবে?
ক্যান?
এক কৌটা কর্ণ সুন্দর কিনব।
কর্ণ-সুন্দর দিয়া কী করবা?
ঐ লোকটা কিছু বিক্রি করতে পারে নি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বেচারা।
অন্তুর টাকা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। মরিয়মের পীড়াপীড়িতে রাজি হল।
এক টাকায় এক কৌটা কর্ণ-সুন্দর পাওয়ার কথা। লোকটি দু’টি কৌটা দিয়ে দরাজ গলায় বলল, পাইকারি দরে দিলাম। তুমি পুলাপান। মানুষ, এই জইন্যে খাতির করলাম। কোম্পানির লোকসান হইল। বেজায় লোকসান।
পুতুল বলল, কোম্পানির লোকসান হলে একটাই দিন। দুটি দিতে হবে না।
না-না, অসুবিধা নাই। তোমারে খুশি হইয়া দিলাম।
পুতুল কর্ণ-সুন্দর হাতে নিয়ে একটু দূরে সরে এল। আড়েআড়ে সে লোকটিকে দেখছে। লোকটি তৎক্ষণাৎ এক টাকার বাদাম কিনছে। কী আগ্রহ করেই না সে বাদাম খাচ্ছে। বেচারা সারাদিন হয়তো কিছু খায় নি। দ্রুত তার বাদাম ফুরিয়ে যাচ্ছে।
মরিয়ম এসে দাঁড়িয়েছে পুতুলের পাশে। সে চোখ বড় বড় করে বলল, কী দেখ?।
ঐ লোকটাকে দেখি।
দুই বিলাইয়ের ঝগড়া শুনবা? আও যাই।
লোকটি ওদের দু’ জনকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। উদাস গলায় বলল, বাদাম খাইবা?
বাদাম খেতে বলা অর্থহীন। কারণ বাদাম নেই। চারদিকে শুধু বাদামের খোসা পড়ে আছে। মরিয়ম বলল, দুই বিলাইয়ের ঝগড়া দেখমু।
লোকটি মনে হল সঙ্গে সঙ্গে রাজি। একটা হাত মুখের উপর রেখে বেড়ালের ঝগড়া শুরু করল। মাও মাও ফ্যা ফ্যাচু–ভয়াবহ ঝগড়া। পুতুল মুগ্ধ। তার কাছে মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি দুটি বেড়াল ঝগড়া করছে। একটা পারছে না, কিছুক্ষণ পরপরই মিউ মিউ করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পুতুল বলল, আপনি আর কী জানেন?
মেলা জিনিস জানি। জানলে কি হইব, পেটে ভাত জুটে না।
ভাত জোটে না কেন?
হেইডাই তো বুঝি না। কপালে লেখা নাই।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, ভাতের কথা কপালে লেখা থাকতে হয়!
মরিয়ম হেসে ফেলল। এই ছেলেটার অদ্ভুত অদ্ভুত কথায় তার খুব হাসি পায়। ভাতের কথা যে কপালে লেখা থাকতে হয়, কপালে না থাকলে যে ভাত জোটে না–এই অতি সাধারণ কথাও এই ছেলেটার জানা নেই। কি অবাক কাণ্ড!
লোকটি বাদামের খোসাগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখছে। সে একটা আস্ত বাদাম পেয়ে গেছে। বাদামটা ভাঙতে গিয়েও ভাঙল না। এগিয়ে দিল পুতুলের দিকে। নরম গলায় বলল, নেও, খাও।
পুতুল হাত বাড়িয়ে নিল। লোকটি কী সুন্দর করেই না হাসছে।
.
ট্রেন ময়মনসিংহ এসে পৌঁছল সন্ধ্যা মেলাবার পর।
ঠিক ময়মনসিংহ স্টেশনে নয়। একটু দূরে, আউটার সিগন্যালে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ বাতি না জ্বলায় স্টেশনে ঢুকতে পরছে না। পুতুল সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল। ফিসফিস করে বলল, লাফ দিয়ে নামুন লাগব।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, কেন?
ইস্টিশনে মবিল কোর্ট আছে।
সেটা আবার কি?
পুলিশ! বিনা টিকেটে গেলে পুলিশে ধরে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এত ব্যাখ্যা করার সময় নেই। অন্তু খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়েছে। অন্তুর পেছনে পেছনে মরিয়ম। পুতুলের ভয় করছে। বাইরে অন্ধকার। ঝোঁপঝাড়ের মতো দেখাচ্ছে। ট্রেনেও গতি চলে এসেছে। সে চোখ বন্ধ করেই লাফিয়ে পড়ল। বড় রকমের একটা ধাক্কা লাগল গায়ে, তারপর গড়িয়ে নিচে নেমে যেতে লাগল। কোথায় নেমে যাচ্ছে কে জানে। চোখ মেলতে সাহসে কুলুচ্ছে না। সে প্রাণপণে ডাকল, অন্তু, এই অন্তু।
না, তার তেমন কিছু হয় নি। দুই হাঁটুর অনেকখানি শুধু ছিলে গেছে। ব্যথা করছে, রক্ত বেরুচ্ছে, তবু পুতুলের মনে হচ্ছে–এটা খুবই সামান্য ব্যাপার। তারা হাঁটছে রেল লাইনের স্লীপারে পা ফেলে ফেলে। পুতুল ভয়ে। মরছে, যদি কোনো ট্রেন এসে পড়ে। অন্তু এবং মরিয়ম নির্বিকার। মরিয়ম সুর করে এক্কা-দোক্কা খেলার মতো করে স্লীপারে পা দিচ্ছে। যেন লাইন ধরে হাঁটাও একটা খেলা। অন্তু আবার স্লীপার ছেড়ে উঠে এসেছে লাইনে। একটা মাত্র লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু সে দ্রুত এগুচ্ছে। যেন এইভাবে হাঁটতেই সে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে শিস্ দেবার চেষ্টা করছে। শিটা ঠিক হচ্ছে না। ফুঁ দেয়ার মতো শব্দ হচ্ছে।