কেউ কোনো আওয়াজ দিল না। লোকটির জন্যে পুতুলের বড় মায়া লাগছে। তার কাছে টাকা থাকলে সে দুটো কর্ণ–সুন্দর’ কিনত।
মরিয়ম বলল, এই লোক যদি গান গাইয়া ভিক্ষা করত, তাইলে মেলা পয়সা কামাইত।
ভিক্ষা করে না কেন?
একেক জন থাকে একেক কিসিমের।
পুতুল ফিস ফিস করে বলল, লোকটার জন্যে খুব মায়া হচ্ছে। এই কথায় মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলল যেন পুতুল খুব অদ্ভুত কথা বলছে।
রহমান সাহেব পত্রিকা অফিসে
রহমান সাহেব পত্রিকা অফিসে এসেছেন।
সব ক’টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। পুতুলের ছবিসহ বিজ্ঞাপন। ছবি এবং বিজ্ঞাপনের কপি তৈরি করেই এসেছেন।
নগদ এক লক্ষ টাকা
পুরস্কার
পুতুল নামের এই ছেলেটির কোনো সন্ধান দিতে পারলে এই পুরস্কারের ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ করা হবে। পুতুল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বাড়ির নাম ঠিকানা জানে। বাংলা এবং ইংরেজি দু’টি ভাষাতেই কথা বলতে পারে। তার কপালে একটি কাটা দাগ আছে। সন্ধানপ্রার্থী।
এক লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা সম্পর্কে রহমান সাহেবের খানিকটা দ্বিধা ছিল। টাকার পরিমাণ বেশি–দ্বিধা সেই কারণে নয়। তিনি ভেবেছেন পুরস্কারের লোভে অন্য কোনো ঝামেলা হয় কি না। তবু পুরস্কারের ঘোষণা দিতে হয়েছে তাঁর স্ত্রীর জন্যে।
পুতুলের মা’র ধারণা গুণ্ডাপাণ্ডা ধরনের লোকজন পুতুলকে চুরি করে নিয়ে গেছে। বড় রকমের পুরস্কারের ঘোষণা দেখলে গুণ্ডাদের দলেরই লোক হয়তো-বা খবর দিয়ে যাবে। টাকার লোভে মানুষ অনেক কিছুই করে।
পুলিশ খুব খোঁজখবর শুরু করেছে। পুলিশের আই জি নিজে ব্যাপারটায় অতিরিক্ত রকমের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কারণ হোম মিনিস্ট্রি থেকে তাকৈ পুতুলের কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা শহরের সন্দেহজনক জায়গা সব কটিই দেখা হয়েছে। এখন আবার হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকাগুলো। কোথাও পুতুল নেই।
নিমতলির পীরসাহেবকে আবার ডেকে আনা হয়েছে। পীরসাহেব পুতুলের শার্ট,বই-খাতা এবং ফুটবল একের পর এক নাকের সামনে ধরছেন। জেসমিন তার সামনে বসে আছেন। অনবরত তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি এক ফোঁটা পানি মুখে দেন নি।
জেসমিন পীরসাহেবের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, কিছু বুঝতে পারছেন?
হ!
কী বুঝতে পারছেন বলুন।
ফরিদপুর শহরে যায় নাই। তার আগেই বাস থাইক্যা নাইম্যা পড়ছে। সাথে আছে ঐ বুড়া কিসিমের লোক।
কোথায় আছে এখন?
একটা ভোলা টেরাকের উপরে আছে।
সেকি! ওর তো শরীর খুব খারাপ। ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো। ও কী করছে?
ঝিমাইতাছে। মনে হয় জ্বর আইছে।
জেসমিন হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন।
ট্রেন গফরগাঁও স্টেশনে
ট্রেন গফরগাঁও স্টেশনে থেমে আছে।
দুপুর একটা।
ঢাকার দিকে যাবার মেল ট্রেনটিও থেমে আছে। কোথাও কিছু ঝামেলা হয়েছে। কোনো ট্রেনই নড়ছে না। কড়া রোদ। বাতাস নেই। মরিয়ম খুব ব্যস্ত। যাত্রীদের পানির পিপাসা পাচ্ছে। ঘন ঘন মরিয়মের ডাক পড়ছে।
অন্তু খুব খুশি, কারণ বেশ কিছু বাদামওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। সে মনে মনে বলছে–খাও, খুব বেশি করে বাদাম খাও। বাদাম যত বিক্রি হবে, পানিও তত বিক্রি হবে। বাদাম খেলেই গলা যাবে শুকিয়ে, পানি ছাড়া গতি নেই।
মরিয়ম ছাড়াও আরো দু জনে পানি বিক্রি করছে। এক জন বুড়ো লোক। সে ভেজা গামছা জড়ানো কলসী নিয়ে এসেছে। সুর করে বলছে, কলসির ঠাণ্ডা পানি। বরফের লাহান ঠাণ্ডা। তার ব্যবসাই জোরেসোরে চলছে। যাত্রীরা তাকেই বেশি ডাকছে। অন্য জন অন্তুর বয়সী। তার ব্যবসা সবচেয়ে খারাপ। বলতে গেলে কেউই তাকে ডাকছে না। তাকে না ডাকার কারণ হচ্ছে সে অসম্ভব নোংরা। এক নাকে সর্দি উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।
বুড়ো পানিওয়ালাকে কোনো রকমে সরিয়ে দিতে পারলেই এক চেটিয়া ব্যবসা করবে মরিয়ম। অন্তু মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল। উকার গতিতে ছুটে এসে বুড়োর ঘাড়ে পড়ে গেল। কলসি ছিটকে পড়ল। বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, এইটা কি করলা? দশ টেকা দামের নয়া কলসি।
অন্তু ভেবেছিল বুড়ো তাকে ধরে মারধোর করবে। বুড়ো সে রকম কিছু করল না। দুঃখী ভঙ্গিতে ভাঙা কলসির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তুর মন খারাপ হয়ে গেল। না ভাঙলেই হত বেচারার কলসিটা।
মরিয়ম একা-একা সামলাতে পারছে না। পুতুল তাকে সাহায্য করছে। পানি ভরে গ্লাস এগিয়ে দেয়া ও পয়সা নেয়া। খালি জগ পানিতে ভর্তি করে আনা। অনেক কাজ। শুরুতে পুতুলের একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল। এখন লাগছে না। সে প্রবল উৎসাহে ছোটাছুটি করছে। সুর করে চেঁচাচ্ছে-পানি, ঠাণ্ডা পানি, কলের পানি। সে কল্পনাও করে নি,পানি বিক্রির ব্যাপারটায় যে এত আনন্দ আছে। এর মধ্যে অন্ত খবর এনেছে– ঢাকা মেইল আরো এক ঘন্টা থাকবে। লাইনে নাকি গণ্ডগোল হয়েছে। খুব ভালো খবর। এক ঘন্টা না থেমে দশ ঘন্টা থেমে থাকলে আরো ভালো।
ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে একটি মেয়ে হাতের ইশারায় পুতুলকে ডাকছে। পুতুলের বুক ধ্বক করে উঠল। চেনা কেউ নাকি? না, চেনা কেউ নয়। মেয়েটি বলল, এই, তুমি আমার ফ্লাস্ক ভর্তি করে পানি এনে দিতে পারবে?
পুতুল মাথা কাৎ করে জানাল, পারবে।
আগে ভালো করে ধুয়ে নিও, কেমন?
আচ্ছা।
মেয়েটির স্বামী ইংরেজিতে বলল, এত দামি ফ্লাস্ক ওর হাতে দিচ্ছ। কেন? নিয়ে ভেগে যাবে।
মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, ভাগলে ভাগবে। আমার তো একে চোর বলে মনে হচ্ছে না।