মরিয়ম পানির জগ হাতে ট্রেন থেকে নিচে নামল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আজ আর পানি বিক্রি হবে না। এক জন ভদ্রলোক প্লাট ফর্মে দাঁড়িয়ে জুতো পালিশ করাচ্ছেন! সে কৌতূহলী হয়ে জুতো পালিশ দেখতে লাগল। এই জিনিসটা দেখলে তার ভালো লাগে। ময়লা জুতো গুলো দেখতে দেখতে কেমন চকচকে হয়ে যায়। এমন কি জুতোর দিকে তাকালে আয়নায় মুখ পর্যন্ত দেখা। যে লোকটা জুতো পালিশ করাচ্ছিল তাকে খুব কৃপণ বলে মনে হল। কারণ দু’টাকার বেশি সে দিল না। জুতো পালিশওয়ালা বখশিশের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করে একটা ধমক খেল। মরিয়ম বলল, সার দিয়ে দেন একটা টেকা, গরিব মানুষ। লোকটি বলল, এই লোক তোর কে হয়? ভাই নাকি?
না, আমার কেউ হয় না।
তুই পানি বিক্রি করিস?
হ।
শীতের দিনে পানি কেউ খায়?
না।
তাহলে পানি বিক্রি করিস কেন?
মরিয়ম কিছু বলল না। লোকটি পালিশওয়ালাকে একটা টাকা বখশিশ দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, দেখি আমাকে এক গ্লাস পানি দে। সে পানি দিল। সেই পানিতে লোকটি একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। এবং তাকে অবাক করে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। এখানেই শেষ নয়, যাবার আগে তার চুলে হাত রেখে একটু আদর করল–নরম গলায় বলল, একটা চিরুনি কিনে নিস। চুল তো একেবারে কাকের বাসা হয়ে আছে।
দশ টাকায় তাদের দু’ জনের খাওয়া ভালোই হবে। ভাত, মাছ ডাল হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সঙ্গে আরেক জনকে যে দেখা যাচ্ছে। মরিয়ম মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অন্তু প্রায়ই এরকম একেক জন সঙ্গে নিয়ে আসে। এসে দু’-একদিন থাকে, রোজগারে ভাগ বসায়-তারপর আবার উধাও হয়ে যায়। একবার নিয়ে এসেছিল এক মহাগুণ্ডাকে, কথায় কথায় মারপিট করে মরিয়মের হাত কামড়ে ধরে রক্ত বের করে দিয়েছিল। এখনো হাতে দাগ আছে। আজকের ছেলেটা সে রকম হবে না। দেখে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা ধরনের ছেলে।
তারা এগুচ্ছে কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের রেস্টুরেন্টগুলোর দিকে। সবার আগে অন্তু, তার পেছেনে পেছনে পুতুল এবং মরিয়ম। মরিয়ম কৌতূহলী চোখে পুতুলকে দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না। পুতুল খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। মেয়েটাকে কেমন পাগলী পাগলী মনে হচ্ছে। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। কেমন ছটফটে চোখ। কিন্তু চেহারাটা খুব মিষ্টি। কেমন পিচুপিচ্ করে থুথু ফেলছে।
মরিয়ম হঠাৎ পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই স্যুয়েটারটা আমারে এক জন দিছে।
কে দিয়েছে।
এক জন হাবিলদার সাব দিছে।
বাহ্, ভালো তো?
খুব ওম আছে। ভাল জিনিস।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, ওম কি? মরিয়ম খিলখিল করে হেসে। ফেলে বলল, ও ভাইজান এ ওম কি জানো না তুমি সত্যি জান না।
না।
হি হি হি। কেমুন কথা!
হাসছ কেন শুধু শুধু!
পুতুল খুব অবাক হল। মেয়েটা এমন কেন।
কেমুন কথা, যে জানে না। ওম হইল গিয়া গরম। নেও, গায়ে দিয়ে দেখ।
মরিয়ম স্যুয়েটার খুলে ফেলল। পুতুল বলল, না না আমি গায়ে দেব না।
আহ্ দেও না। দিলেই বুঝবা ওম কারে কয়।
এটা নোংরা স্যুয়েটার। আমি গায়ে দিব না।
ও ভাইজান, এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়। হি হি হি।
অন্তু ধমক দিল, বেহুদা হাসিস না।
এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়, ভাইজান বড় মজা লাগে।
পুতুল মেয়েটাকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে। গোলগাল আদুরে মুখ। কী সুন্দর করেই না হাসছে।
মরিয়ম বলল, তোমার নাম কি?
ভালো নাম জানতে চাও না ডাকনাম?
ও ভাইজান, এ কেমুন জানি ভদ্রলোকের মতো কথা কয়।
অন্তু বিরক্ত মুখে তাকিয়ে ছোট্ট একটা ধমক দিল। মরিয়ম বহু কষ্টে হাসি থামাল।
.
রেস্টুরেন্টের মালিক অন্তুকে চেনে। ওরা এসে দাঁড়ানমাত্র পরোটা ভাজি চলে এল কিছুই বলতে হল না। এমন কি কুকুরটার জন্যেও খাবার চলে এল। টিনের বাটিতে খানিকটা বাসি ভাত, মাছের কাঁটা, কয়েক টুকরা আলু। সে বোধ হয় আরো ভালো কিছু খেতে চায়। বার বার অন্তুর দিকে তাকাচ্ছে। অন্তু খানিকটা পরোটা ছিঁড়ে দিতেই সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লেজ নাড়তে লাগল নানান ভঙ্গিতে। রেস্টুরেন্টের থলথলে ভুড়িওয়ালা মালিক একটা কালোজাম মরিয়মের প্লেটের কোণায় বসিয়ে দিয়ে গেল। এটা সে প্রায়ই করে। এই মিষ্টির জন্যে পয়সা দিতে হয় না।
মরিয়মের মুখভর্তি হাসি। মিষ্টির একটা কোণা ভেঙে সে মুখে দিল। আনন্দে তার চোখ ছোট-ঘোট হয়ে গেছে। অন্তুর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। দু’টাকা করে মিষ্টি। ইচ্ছে করলে তো খাওয়া যাবে না। দুপুরে আবার খিদে পাবে, তখন কিছু একটা তো খেতে হবে। দু’টাকার বাদাম কিনে ভরপেটে পানি খেলে সারাদিন থাকা যায়। আজ বাদাম কিনতে হবে তিন টাকার। মানুষ এক জন বেশি।
মরিয়ম পুতুলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, মিষ্টি খাইবা?
না।
খাও। নেও অর্ধেকটা খাও।
কারো খাওয়া জিনিস আমি খাই না।
খাও না ক্যান?
খেলে অসুখ হয়।
ও ভাইজান, এ কেমন জানি ভদ্দরলোকের লাহান কথা কয়। হি। হি হি।
তারা খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল। পুতুল বলল, তোমরা এখন কি করবে?অন্তু বলল, ময়মনসিং যামু।
কীভাবে যাবে?
রেলগাড়ি আছে না? যাওয়ার কোনো অসুবিধা নাই, টিকেট লাগে। না।
আবার ঢাকা আসবে?
হঁ।
কবে আসবে?
ঠিক নাই কোনো। আইজ রাইতে আসা যায়, কাইলও আসা যায়।
মরিয়ম হাসিমুখে বলল, সব আল্লাহর ইচ্ছা। হি হি হি হি। অন্তু মরিয়মকে ধমক দিল, তাতে লাভ হল না। হাসি থামেই না। পুতুলের ইচ্ছে করছে ওদের সঙ্গে ময়মনসিং চলে যেতে। এরা যদি আজই ফেরে-তাহলে তো কোনো অসুবিধা নেই। মা-বাবা বাসায় ফেরার আগেই হয়তো সে পৌঁছে যাবে। মা-বাবা বুঝতেই পারবে না সে কোথায় ছিল সারা দিন। আর যদি বুঝতেও পারে, তাহলেও খুব অসুবিধা হবে না। মা-বাবা কেউই তার ওপর রাগ করে না। তার অসুখ তো, তাই। হয়তো খানিকক্ষণ রাগী-রাগী চোখ তাকিয়ে থেকে বলবে, আর এ রকম করবে না, বুঝলে? সে বলবে, আর করবো না মা!