তুমি তাহলে আমার শ্বশুরবাড়ি দেখে মুগ্ধ?
মুগ হব না কেন?
চা-নাসতা খেলে?
হু। পাপড় ভাজা, সেমাই, নিমকপাড়া…
থাক, মেনু শুনতে চাচ্ছি না। যথেষ্ট শুনেছি।
তোমার শ্বশুরের একটা গাড়ি আছে। ওল্ড মডেলের টয়োটা, নতুন একটা কিনবেন। বাজেটের জন্যে অপেক্ষা করছেন। বাজেটে গাড়ির দাম কমার কথা।
সব দেখেশুনে তোমার কি মনে হচ্ছে আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত?
অবশ্যই।
তুমি যখন বলছ, করে ফেলব।
আজকাল ভাল ছেলে পাওয়া আসমানের চাঁদ পাওয়ার মত। একজন যখন পাওয়া গেছে।
পারুল শীতল গলায় বলল, তার উপর ওদের চায়নীজ রেস্টুরেন্ট আছে। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। যখন-তখন চাননীজ খাওয়া যাবে। ধর, তুমি বিকেলে বেড়াতে এলে, ঘরে কোন খাবার নেই, একটা স্লীপ লিখে তোমাকে চাইনীজ রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দিলাম। আচ্ছা, এদের রেস্টুরেন্টের নাম কি?
নিউ সিচুয়ান। খুব চলি রেস্টুকেন্ট।
চল, ওদের রেস্টুরেন্ট থেকে একটু স্যুপ খেয়ে আসি।
তাহের হকচকিয়ে গেল। পারুলের কথাবার্তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কাজকর্মেরও ঠিক-ঠিকানা নেই। হয়তো সত্যি সত্যি স্যুপ খেতে চাচ্ছে।
পারুল বলল, তোমার কাছে কি এক বাটি স্যুপ কেনার টাকা আছে? এক বাটি স্যুপের দাম একশ টাকার বেশি হবে না। একশ টাকা সুপ, পাঁচ টাকা টিপস। যেতে আসতে রিকশাভাড়া পনের–একশ কুড়ি টাকা হলেই আমাদের চলে। আছে তোমার কাছে, একশ কুড়ি টাকা?
তাহেরের কাছে তেত্রিশ টাকা ছিল। একশ কুড়ি টাকা থাকলেও যে সে পারুলকে নিয়ে যেত তা না। অকারণে টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তাছাড়া যে মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে সেই মেয়েকে নিয়ে চায়নীজ রেস্টুরেন্টে ঘোরাঘুরি করা যায় না। কখন কে দেখে ফেলবে!
কি, কথা বলছ না কেন? আছে এক কুড়ি টাকা?
না, তেত্রিশ টাকা আছে।
তাহলে তো বিরাট সমস্যা হয়ে গেল। চল না বাকিতে খেয়ে আসি। খাওয়া দাওয়ার পর তুমি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বলবে–এই যে মেয়েটি খাওয়া-দাওয়া করল তার সঙ্গেই আপনাদের মালিকের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। এখন বিবেচনা করুন, তার কাছ থেকে কি স্যুপের দাম রাখা ঠিক হবে?
তাহের বিরক্ত মুখে বলল, তোমার ব্রেইনে কোন সমস্যা আছে। তুমি সবসময়। আজেবাজে কথা বল। একজন স্বাভাবিক মানুষ তো আর সারাক্ষণ ঠাট্টা করে না। তোমাকে বোঝা খুবই মুসকিল।
পারুল উদাস গলায় বলল, মেয়েদের বোঝা এত সহজ না। তুমি যদি আমাকে বুঝতে তাহলে চিন্তায় তোমার ব্রহ্মতালু শুকিয়ে যেত।
কেন?
কারণ আমি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। এবং বিয়েটা হবে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে।
সত্যি সত্যি দুশ্চিন্তায় তাহেরের গলা-টলা শুকিয়ে গেল। বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। তার নিজের রাতে শোবার জায়গা নেই। জসিমের মেসে এতদিন থাকত। খাটে ডাবলিং করত। গত সপ্তাহেই জসিম বলেছে, অন্য কোথাও একটু থাকার ব্যবস্থা কর দোস্ত। গরমের মধ্যে এক খাটে দুজন–চাপাচাপি হয়–। তারপরও তাহের জসিমের সঙ্গেই আছে, যাবে কোথায়?
বিয়ে করে সে বউকে কোথায় নিয়ে তুলবে? জসিমের মেসে?
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাদের বিয়ে হবে গেল। কাজী অফিসে নাম সই করতে গিয়ে তাহেরের হাত কাঁপতে লাগল। অথচ পারুল কি স্বাভাবিক–যেন কিছুই হয়নি। সে রুমালে মুখ মুছে বলল, খুব গরম এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। কোথায় পাওয়া যায় বল তো?
এই প্রশ্নের জবাবে তাহের বলল–এখন তোমাকে নিয়ে আমি কী করব? কোথায় যাব?
পারুল বলল, আমাকে নিয়ে তোমাকে কিছু করতে হবে না, কোথাও যেতে হবে। তুমি যেমন আছি তেমন খাক। চাকরির চেষ্টা করতে থাক।
চাকরি পাব কোথায়?
এখন হয়ত পাবে। স্ত্রী-ভাগ্যে কিছু নিশ্চয়ই জুটে যাবে।
তোমার কোন টেনশন হচ্ছে না, পারল?
বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত হচ্ছিল–এখন হচ্ছে না।
চাকরি-বাকরি কিছুই যদি না পাই তখন কি হবে?
পাবে। অবশ্যই পাবে। আমি খুব ভাগ্যবতী মেয়ে।
তুমি ভাগ্যবতী মেয়ে?
অবশ্যই–যাকে বিয়ে করতে চেয়েছি তাকে বিয়ে করতে পেরেছি। কটা মেয়ের এরকম সৌভাগ্য হয়? টাকাপয়সার ভাগ্য হল ছোট ধরনের ভাগ্য। ভালবাসার ভাগ্য অনেক বড়। অনেক দিন ধরেই আমি রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। আজ রাতে আমার খুব ভাল ঘুম হবে।
সেই রাতে তাহেরের একেবারেই ঘুম হয়নি। কি যন্ত্রণায় পড়া গেল। গোদের উপর মানুষের হয় বিষ ফোড়া, তার হয়েছে ক্যানসার। বিয়ে করা বৌ থাকে এক জায়গায়, সে থাকে আরেক জায়গায়। বন্ধুর খাটের অর্ধেকটা শেয়ার করে। পারুলকে নিয়ে কোনদিন সংসার করা যাবে তা মনে হয় না।
বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর পারুলকে তার বড় চাচা বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। মধুর গলায় বললেন–যাও, স্বামীর সঙ্গে সুখে ঘর-সংসার কর। ভুলেও এদিকে আসবে না। যদি কোনদিন তোমাকে কিংবা তোমার গুণবান স্বামীকে এ বাড়িতে দখি তাহলে স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে পিটাব। আল্লাহর কসম।
স্যান্ডেলের পিটা খাবার জন্যে না–চাচীর সঙ্গে তার কিছু গয়না ছিল, গয়নাগুলির জন্যে পারুল একাই একদিন গিয়েছিল। তার মায়ের গয়না–চাচীর কাছে গচ্ছিত। মেয়ের বিয়ের সময় যেন দেয়া হয় এরকম কথা। পারুলের চাচী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললেন, গয়না! কিসের গয়না?
পারুল বাল, মার মায়া চাচী।
তোমার মা তো রাজরাণী ছিলেন, গাদা গাদা গয়না বানিয়ে মেয়ের জন্যে রেখে গেছেন!