তোষকের ভেতর তুলার বদলে পানি ভরা।
সে কি?
বিছানায় শোয়ামাত্র চোখে ঘুম চলে আসবে। মনে হবে পানির উপর ভাসছ।
পারুল উঠে বসে আগ্রহের সঙ্গে বলল–চল ঐখানে শুয়ে থাকি। করাত ধরেই আমার ঘুম আসছে না। ঐ ঘরে আরাম করে ঘুমাই।
বললাম না ঐ ঘর তালাবন্ধ। তাছাড়া তালা না থাকলেও এখানে শোব কেন?
বাড়িটাই যখন আমাদের, সব কিছুই আমাদের।
বাড়িটা আমাদের তোমাকে বলল কে?
তুমি তো বললে। তুমি বললে না ওদের অনুপস্থিতিতে আমরাই বাড়ির মালিক।
কখন বললাম এরকম কথা?
বলেছ, এখন ভুলে গেছ। চল যাই।
তুমি কি যে বিরক্ত কর!
আচ্ছা যাও। শুধু ঘরটা দেখে চলে আসি। ঘরটা দেখব আর সোনার বাখরুমে গোসল করব। আমার গা কুটকুট করছে।
সোনার বাথরুম তো না। বাথরুমের ফিটিংসগুলি সোনার। আঠারো ক্যারেট।
পারুল অন্ধকারেই হাসল। তাহেরের রাগ জলে ভেসে গেছে। সে মনের কথা আনন্দে বলে যাচ্ছে। তাহেরকে আবারো রাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। এমন কিছু বলতে ইচ্ছা করছে যাতে তাহের রেগে আগুন হয়ে যায়–। রেগে যাবে, সে আবার রাগ ভাঙাবে।
পারুল নিচু গলায় বলল, এই, একটা কথা শোন।
শুনছি তো।
কাছে এসে শোন। গোপন কথা। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়।
কি কাজ? চল আমরা বাথরুমের ফিটিংসগুলি খুলে নিয়ে পালিয়ে যাই। সব জড় করলে দুই-তিন সে সোনা তো নিশ্চয়ই হবে। হবে না? সোনার ভরি এখন ছ হাজার টাকা। তিন সের সোনা বিক্রি করলে আমরা পাব–আচ্ছা, কত ভরিতে এক সের হয় তুমি জান?
তাহের গম্ভীর গলায় বলল–শোন পারুল, এক কথা কতবার বলব? আজেবাজে। তুমি একেবারেই পছন্দ করি না।
ঠাট্টা করছি না তো। সোনার বাথরুম এই খবরটা জানার পর থেকে আমার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা ঘুরছে। আমরা কি করব শোন…
কিচ্ছু শুনব না। আর একটা কথা না। ঘুমাও।
তোমার বাথরুম পাচ্ছে না? বড়টা?
তাহের রাগী গলায় বলল–বাথরুম পাবে কেন?
পচা গোসতের কাবাব কপ কপ করে সবটা খেয়ে ফেললে এই জন্যে। স্ট্রং ডাইরিয়া তো ইতিমধ্যে শুরু হবার কথা…।
পারুল খিলখিল করে হসিছে। তাহেরের রাগ করা উচিত। রাগ করতে পারছে না। মায়া লাগছে। হাসি শুনতে ভাল লাগছে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে। হাসি শুনলে মনে হয় এই মেয়ের জীবনে কোন দুঃখ কষ্ট নেই। শুধুই সুখ। অথচ তাহে জানে পারুল কত দুঃখী মেয়ে। মাত্র সাত মাস পর তার কোলে শিশু আসবে–অথচ কোন আয়োজন নেই। পারুলকে ক্লিনিকে ভর্তি করাবার টাকাও নেই। ক্লিনিক তো দূরের ব্যাপার–এখন পর্যন্ত সে তাকে ডাক্তারের কাছেও নিতে পারেনি।
গর্ভবতী মেয়েদের ভাল ভাল খাবার খেতে হয়। দুধ, ডিম, ফল-মূল কত কি! কিছুই করা যাচ্ছে না। তাহের অবশ্যি পকেটে করে প্রায়ই পেয়ারা, কলা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে কলা কেনাও অস্বস্তির ব্যাপার। মানুষ কলা কেনে ডজন হিসেবে, সে কেনে একটা। একটামাত্র কলা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে ফিরলে পারুলও খুব হাসাহাসি করে। উল্টা-পাল্টা কথা বলে।
আচ্ছা শোন, এই যে এত কলা খাচ্ছি সমস্যা হবে না তো?
কি সমস্যা?
বাচ্চা হলে দেখা যাবে বাচ্চার আধ হাত লম্বা লেজ। অতিরিক্ত কলা খাওয়ায় পেটের বাচ্চা বানর হয়ে গেছে।
উদ্ভট কথা তুমি কেন যে বল!
তুমি উদ্ভট কাজ কর এই জন্যে আমি উদ্ভট কথা বলি।।
উদ্ভট কাজ কি করলাম?
এই যে পকেটে একটা করে কলা নিয়ে আস। প্লীজ আর কখনো আনবে না। এক সঙ্গে বেশি করে নিয়ে এসো। রোজ একটা করে খাব।
এক সঙ্গে বেশি করে আনবে কোত্থেকে? মাঝে মধ্যে একটা দুটা আনছে তাই অনেক বেশি। তাহেরকে বিয়ে করে পারুল যে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে পড়েছে তার জন্যে তাহের নিজেকে অপরাধী মনে করছে না। কারণ এই বিপদ পারুল নিজে ডেকে এনেছে। তাহের তাকে কখনো বলেনি আমাকে বিয়ে কর। বিয়ের চিন্তাই তার মাথায় ছিল না। নিজে খেতে পায় না–তার আবার বিয়ে কি? পারুলের বিয়ে যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল তখন সে বরং হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক, দুঃশ্চিন্তা দূর হল। খুব ভাল সম্বন্ধ। মেয়েটা সুখে থাকবে। মাঝে মধ্যে সে পারুলের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে টা-টা খেয়ে আসবে। সেটাও তো কম না। সম্বন্ধও খুব ভাল। ছেলের বাবা ডাক্তার। মুগদাপাড়ায়। চারতলা বাড়ি। তিনি নিজে একতলা দুতলা নিয়ে থাকেন। দুই ছেলের জন্যে ওপরের তিনতলা আর চারতলা।
তাহের নিজেই একদিন বাড়িঘর দেখে এল। সে মুগ্ধ। বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা। সেখানে বাগান করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে অনেক জায়গা। আম গাছ, কাঠাল গাছ। ছেলের সঙ্গে কথা বলেও সে খুশি। ছেলে বিজনেস করছে। শাড়ির দোকান আছে, চায়নীজ রেস্টুরেন্টে শেয়ার আছে। পারুলকে সে উৎসাহের সঙ্গেই খবরাখবর দিল। পারুল বিরক্ত হয়ে বলল, আশ্চর্য কাণ্ড! তুমি ঐ বাড়িতে কি পরিচয় দিয়ে উঠলে?
বললাম, আমি পারুলের দূর সম্পর্কের মামা।
মামা? মামা বললে কেন?
প্রথমে ভেবেছিলাম দূর সম্পর্কের ভাই বলব–এতে সন্দেহ করতে পারে। কি দরকার, এরচে মামাই ভাল।
তোমাকে খুব খাতির-যত্ন করেছে?
হ্যাঁ, করেছে। ছেলের বাবা বাড়িঘর ঘুরে ঘুরে দেখালেন। তাদের একটা গাছে এবার ছিয়াত্তরটা নারকেল হয়েছে।
তুমি গাছে উঠে নাকেল গুনলে?
না, উনিই বললেন। নিতাই ভদ্রলোক। ছেলের সঙ্গেও কথা হয়েছে। বেশিক্ষণ কথা হয়নি। অল্প কিছুক্ষণ কথা হয়েছে, তার আবার একটা চায়নীজ রেস্টুরেন্টে। শেয়ার আছে–সন্ধ্যাবেলা খানিক বসতে হয়।