পারুল হাসি মুখে বলল, গাছে পানি দেয়ার মত জটিল কাজে বুঝি তোমার মত জ্ঞানী মানুষ দরকার?
তাহের আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। অর্থাৎ সে রাগ করেছে। পারুলকে বলতে হল–সে ঠাট্টা করছে। বলার পর তাহের স্বাভাবিক হল। তার মুখে কোমল ভাব ফিরে এল। পারুলের ধারণা, এই পথিবীর শ্রেষ্ঠ দশজন মানুষের মধ্যে তাহের একজন। তাহেরের সমস্যা একটাই–সে ঠাট্টা বুঝতে পারে না। রাগ করলে এখনও শিশুদের মত খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
প্রথম দিন এ বাড়িতে এসে পারুলকে কোন রান্নাবান্না করতে হয়নি। তাহের প্যাকেটে করে খাবার নিয়েয়ে এসেছিল। শিক কাবাব—তন্দুর রুটি। শিক কাবাব কতদিনের বাসি কে জানে–শুকিয়ে চিমসা হয়ে গেছে। টক টক স্বাদ। পারুল বলল, মাংসটা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। টক লাগছে।
তাহে বলল, মোটেও নষ্ট হয়নি। এরা কাবাবের উপর লেবুর রস চিপে দেয়, এজন্য টক টক লাগে। আরাম করে খাও তে।
পারুল খেতে পারেনি, তবে তাহের মহানন্দে বাসি মাংস চিবিয়েছে। আনন্দে এক একবার তার চোখ বুজে যাচ্ছে। তাহের বলল–এত বড় বাড়িটার বলতে গেলে আমরাই এখন মালিক, তাই না? দারুণ লাগছে না? পারুলের মোটেই দারুণ লাগছে না। তবু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তাহের বলল, মেয়েরা এবং শিশুরা হল বাড়ির শোভা। একটা বাড়িতে যদি কোন মহিলা বা কোন শিশু না থাকে তাহলে সেটা আর বাড়ি থাকে না–হোটেল হয়ে যায়। তুমি আসার আগ পর্যন্ত এই বাড়ি হোটেল ছিল–এখন বাড়ি হয়েছে।
পারুল অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আরও সাত মাস এ বাড়িতে থাকতে পারলে শিশুও চলে আসবে। তখন এটা হবে পুরোপুরি বাড়ি–তাই না?
তাহের তাকাচ্ছে, কিছু বলছে না–পারুল ঠাট্টা করছে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। পারুল কখন ঠাট্টা করে, কখন করে না সে বুঝতে পারে না বলে পারুল কিছু বললেই সে কিছু সময়ের জন্যে হলেও অস্বস্তির মধ্যে থাকে।
পারুল বলল, এ বাড়ির যিনি মালিক তিনি কি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকেন?
না। এটা বাগানবাড়ি।
পারুল কৌতূহলী গলায় বলল, তার বান্ধবীদের নিয়ে মজা করতে আসেন? এজন্যই এতো নিরিবিলিতে বাড়ি?
তাহের বিরক্ত মুখে বলল, মানুষকে এত ছোট ভেবো না তো। সুখী মানুষ বলতে যা বোঝায় করিম সাহেব তাই। এ বাড়িতে একটা নামাজ-ঘর আছে, সেটা জান?
তিনি এখানে তাহলে নামাজ পড়বার জন্য আসেন?
বিশ্রাম করার জন্যে আসেন। একনাগাড়ে কয়েকদিন থেকে চলে যান। একা আসেন, একা চলে যান।
একা আসেন কেন? স্ত্রীকে আনতে অসুবিধা কি?
তার স্ত্রীর প্যারালাইসিস। আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারেন না। নার্সিং হোমে আছেন গত ছয় বছর ধরে।
এদের বাচ্চাকাচ্চা কি?
কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই।
পারল বিস্মিত গলায় বলল, কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই, তাহলে টাকাপয়সা কে উড়াবে? ধনী বাবার সম্পদ নষ্ট করার জন্যে পুত্র-কন্যা দরকার।
একবার একটা ছেলেকে পালক নিয়েছিলেন। বার তের বছর বয়স হবার পর ঘাড় ধরে সেই ছেলেক বের করে দিলেন।
কেন?
জানি না কেন। পছন্দ হয়নি আর কি। যতই হোক পরের ছেলে–পরের ছেলের উপর কি আর মায়া হয়?
হবে না কেন? তুমি তো পরের ছেলে, তোমার উপর আমার মায়া হচ্ছে না?
সব সময় কেন ঠাট্টা কর?
ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি।
সত্যি কথা বলা দরকার নেই।
পারুল হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঐ ভদ্রলোক পালক ছেলে হিসেবে তোমাকে নিয়ে নিলে খুব ভাল করতেন। এক সঙ্গে ছেলে, ছেলের বউ দুটাই পেয়ে যেতেন। কিছুদিন পরই নাতি বা নাতনী। এক ঢিলে তিন পাখি।
তাহের বিরক্ত মুখে বলল, তুমি সব সময় বাঁকা বাঁকা কথা বল তার কি মানে সেটাই বুঝি না।
পারুল গম্ভীর গলায় বলল, তুমি একটা কাজ করো না, ভদ্রলোক এলে তাঁর কাছে পালকপুত্র হবার জন্যে একটা দরখাস্ত দাও। দরখাস্তের শেষে বায়োডাটা।
পারুল। একটু আগে কি বললাম? আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না। আমার অসহ্য বোধ হয়।
আমি তো কখনো ঠাট্টা করি না। সিরিয়াস কথাগুলি হালকাভাবে বলি বলে ঠাট্টা মনে হয়।
হালকাভাবে কথা তাহলে বলো না।
আচ্ছা যাও, এখন থেকে খুব ভারি ভারি কথা বলব। হে স্বামী, রাত্রি গাভীর হইয়াছে–আপনি কি এখন শয্যা গ্রহণ করিবেন, না গল্প করিয়া কালক্ষেপণ করিবেন?
পারুল হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তাহের রাগ করে উঠে গেল। মনে হচ্ছে এই রাগ অনেকক্ষণ থাকবে। রাগ ভাঙানোর জন্যে সাধ্যসাধনা করতে হবে। রাগ ভাঙানোর সাধ্যসাধনা করতে পারুলের খারাপ লাগে না, ভালই লাগে। তবে এই মুহূর্তে রাগ ভাঙানোর দরকার নেই। থাকুক মুখ ভোতা করে। রাতে রাগ ভাঙ্গানো যাবে। পারুল একা একা বাড়ি দেখে বেড়াতে লাগল। এত বড় বাড়ি, মনে হচ্ছে সারাদিন হাঁটলেও দেখা হবে না। তবে বেশির ভাগ ঘরই তালাবন্ধ। চাবি থাকলে ঘরগুলি দেখা যেত।
রাতে ঘুমূবার সময় তাহের অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে রইল। রাগ দেখানো হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কপট ঘুমের ভানও করা হবে। পারুল বলল, এই, ঘুমিয়ে পড়েছ না কি?
তাহের জবাব দিল না। জবাব দেবে না জানা কথা। পারুলকে কথাবার্তা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেন নিজের অজান্তেই তাহের অংশ গ্রহণ করে ফেলে। পারুল বলল, কি শক্ত খটখটে বিছানা। মনে হচ্ছে ইটের উপর শুয়ে আছি। এদের শোবার ঘরের বিছানাও কি এমন না কি?
তাহের বলল–কি পাগলের মত কথা! এদের শোবার ঘরের বিছানা এরকম হবে কেন? ওয়াটার বেড।
সেটা কি রকম?