পারুল প্রথম দিনে বাড়ি দেখে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল–কারণ তার চোখে পড়ল তিনটা কুকুর। লাইন বেঁধে বসার মত এরা বসে আছে। গানের কালো পশম চিকচিক করে জ্বলছে। কুকুরের চোখ সাধারণত অন্ধকারে জ্বলে–এদের দিনেও জ্বলছে। তাহের বলল–কোন ভয় নেই।
পারুল প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ভয় নেই কেন? এরা কি অতি ভদ্র কুকুর?
এরা মোটেই ভদ্ৰ না। ভয়ংকর কুকুর গ্রে হাউন্ড। নিমিষের মধ্যে তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
করছে না কেন?
বিচার-বিবেচনা করছে।
তাহের স্ত্রীর কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে ডাকল, কামরুল, এই কামরুল।
বাড়ির পেছন থেকে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের একটা লোক বের হয়ে এল। তার নাম কামরুল। কুকুর তিনটার দেখাশোনার দায়িত্ব তার। পারুল বিস্মিত হয়ে দেখল কামরুল নামের এই লোকটাও কুকুরগুলির মতই ছিপছিপে। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটার চোখও কুকুরের চোখের মতই জ্বল জ্বল করছে। পারুলের মনে হল–এই মানুষটা যদি হামাগুড়ি দিয়ে মার্টিতে হাঁটে, তাকে গ্রে হাউন্ডদের মতই দেখাবে।
তাহের হড়বড় করে বলল, শোন কামরুল, এ হল পারুল, আমার স্ত্রী, ও কয়েকদিন আমার সঙ্গে থাকবে। কুকুরগুলির সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দাও।
কামরুল নামের লোকটা হুম করে শব্দ করতেই একসঙ্গে তিনটা কুকুর জুটে এল। পারুল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি কুকুরই তার গা শুকছে। তাদের গরম নিঃশ্বাস এসে গায়ে লাগছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। পারুলের শরীর শিরশির করছে।
তাহের হাসিমুখে কলল, এরা তোমার গায়ের গন্ধ জেনে গেল। তোমাকে এরা আর কখনোই কিছু বলবে না।
ভুলে যদি কিছু বলে ফেলে? মানুষেরই ভুল হয় আর কুকুবের হবে না?
কুকুরের কখনো ভুল হবে না। ভয়ে শক্ত হয়ে যাবার কোন দরকার নেই। গায়ে হাত দাও–কিছু বলবে না।
পারুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই শয়তানগুলির গায়ে হাত দেবার আমার কোন ইচ্ছা নেই। এরা যে গা শোঁকাশুঁকি করছে তাও আমার অসহ্য লাগছে। লোকটাকে বল কুকুর সরিয়ে নিয়ে যাক।
গন্ধ নেয়া হয়ে গেলে এরা আপনাতেই চলে যাবে এদের কিছু বলতে হবে না।
তাহেরের কথা শেষ হবার আগেই কুকুররা সরে গেল। ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে মূর্তির মত বসে রইল। পারুল বলল, মরে গেলেও কুকুরগুলির সঙ্গে এই বাড়িতে আমি থাকতে পারব না।
তোমার কোন ভয় নেই। এরা হাইলি ট্রেইন্ড কুকুর। কখনো বাড়িতে ঢুকবে না। দরজা খোলা থাকলেও ঢুকবে না। এদের দায়িত্ব হচ্ছে বাড়ির চারপাশে ঘোরা। বাড়িতে ঢোকা নয়।
কই, এখন তো ঘুরছে না।
রাত নটার পর থেকে ঘোরা শুরু করে। খুব ইন্টারেস্টিং।
পারুল ব্যাপারটায় ইন্টারেস্টিং কিছু দেখল না। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কুকুর খুবই ভয় পায়। ছেলেবেলায় তাকে কুকুর কামড়ে ছিল। চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছে নাভিতে। ইনজেকশনের পর নাভি ফুলে গেল। সেই ফোলা এখনো আছে। এখনকার মেয়েরা কত কায়দা করে নাভির নিচে শাড়ি পরে। সে তার ফোলা নাভির জন্যে পরতে পারে না। কুকুরের কামড় খাবার পর থেকে তার কুকুর-ভীতি তাও একটা কুকুর হলে কথা ছিল–তিন তিনটা কুকুর। লোকটাও প্রায় কুকুরের মতই। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। শুধু তাহের যখন বলেছে–আমার স্ত্রীকে কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও–তখন ঘেউ জাতীয় একটা শব্দ করেছে–যে শব্দ শুনে কুকুর তার গা শোঁকার জন্যে ছুটে এসেছে। লোকটা নিশ্চই কুকুরদের ভাষাতেই কথা বলেছে নয়ত কুকুরগুলি বুঝল কি করে?
পারুল নীলা হাউসে ঢুকল মন খারাপ করে। যত সুন্দর বাড়িই হোক, পরের বাড়ি। পরের বাড়ি পাহারা দেবার মধ্যে অনিন্দজনক কিছু নেই। পারুল লক্ষ্য করল–তাহের আনন্দিত। বাড়ির খুঁটিনাটি বলে সে খুব আরাম পায়।
পারুল, দেখো–পুরো বাড়ি মার্বেলের। ইটালীয়ান মার্কেল, তাজমহল ইন্ডিয়ান মার্বেলের তৈরি। ইন্ডিয়ান মার্বেলের চেয়ে ইটালীয়ান মার্বেল দশগুণ দামী।
তোমার ধারণা–নীলা হাউস তাজমহলের চেয়েও দশগুণ দামী?
তা বলছি না। মার্বেলের কথা বলছি। এ বাড়ির মাস্টার বেডরুমে যে বাথরুম ফিটিংস আছে সব আঠারো ক্যারেট গোল্ডের।
আমরা তাহলে আঠারো ক্যারেট গোলেডর কমোডে বসে বাথরুম করতে পারব?
না–তা পারবে না। সব তালা দেয়া। বাড়িটা কেমন বল।
আছে মন্দ না।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, মন্দ না বলছ কেন? তোমার বাড়ি পছন্দ হয়নি?
পছন্দ হলে কি করবে? কিনে দেবে?
তাহের বিরক্ত হয়ে বলল, এটা কি রকম কথা? পছন্দ হলেই কি কিনে দিতে হবে? আমাদের কত কিছুই তো পছন্দ হয়। পছন্দ হলেই কি আমরা কিনে ফেলি?
তাহের অতক্ষণ বিরক্ত থাকে ততক্ষণই তাহেরের কপালের চামড়া কুঁচকে থাকে। চোখ জাপানিদের মত ছোট ছোট হয়ে যায়। এরকম মুখ বেশিক্ষণ দেখতে ভাল লাগে না। কাজেই পারুল তাহেরকে খুশি করার চেষ্টা করল। অকারণ উচ্ছ্বাসের বন্যা বইয়ে দিল। বারান্দায় টবের সারির দিকে তাকিয়ে বলল, ও আল্লা, বারান্দায় এত ফুলের গাছ? মনে হচ্ছে কয়েক লক্ষ গাছ।
তাহের হৃষ্ট গলায় বলল, কয়েক লক্ষ না, মোট দুশি তেতত্রিশটা চারা গাছ আছে।
তুমি বসে বসে নেছ না কি?
এটাই তো আমার কাজ।
গাছ গোনা তোমার কাজ?
গাছে পানি দেয়া। স্যার বাইরে যথন যান তখন আমাকে রেখে যান গাছে পানি দেয়ার জন্যে।
কেন, কামরুল যে সে পানি দিতে পারে না?
এক এক জনের এক এক কাজ। কামরুলের কাজ হচ্ছে করে দেখা–সব কাজ তো আর সবকে দিয়ে হয় না?