আমি আরেক কাপ চা খাব। এই জন্যে স্টোভ জ্বালিয়ে রেখেছি।
তাহের হতাশ ভঙ্গিতে বসল। পারুল কেতলি আবার স্টোভে বসাতে বসাতে বয়ল, ঐ জ্যোতিষ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ায় হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিল। কেন বল তো?
আমি কি করে বলব কেন?
গায়ে কাঁটা দিল, কারণ উনি বলেছিলেন–অন্যের অর্থ আমার হাতে চলে সিলে। আমি ধনী হব পরের ধনে।
এতে গায়ে কাঁটা দেবার কি আছে?
গায়ে কাঁটা দেবার অনেক কিছুই আছে। পরের ধনে ধনী হবে কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল–আচ্ছা, এই মেসবাউল করিম সাহেবের ধনে আমরা ধনী হব না তো?
এইসব কি নাই, আজেবাজে কথা?
আমার যা মনে হল বললাম। রেগে যাচ্ছ কেন?
পাগলের মত কথাবার্তা বললে রাগব না?
পাগলের মত কথা তো বলছি না। এটা কি খুব অসম্ভব ব্যাপার?
তুমি নিজে খুব ভাল করেই জান এটা কত অসম্ভব।
মোটেই অসম্ভব না। ধর, ভদ্রলোক ঠিক করলেন–তিনি আরো এক বছর সুইজারল্যান্ড থাকবেন। কাজেই আমরা এক বছর থাকলাম এ বাড়িতে। এক বছর পর ভদ্রলোক মারা গেলেন। আমরা তখন…
তাহের রাগী গলায় বলল, এইসব আজেবাজে জিনিস কখনো ভাববে না। উনি মারা গেলে সব কিছু আমাদের হয়ে যাবে–এটা কেন মনে করছ? আমরা কে?
পারুল চায়ের কাপে চা ঢালছে। তাহের লক্ষ করল, পারুল চায়ে চার চামচ চিনি দিল। এম্নিতে সে দুচামচ চিনি খায়। আজ চার চামচ চিনি কেন নিচ্ছে? জ্যোতিষের কথা মনে করে? সেই বেটা চার চামচ চিনি স্মেত বলে পারুলকেও খেতে হবে?
তাহের বলল, ঐ জ্যোতিষ ভদ্রলোকের নাম কি?
উনার নাম অরবিন্দ দাস।
হিন্দু না কি?
হুঁ। চিরকুমার।
রেগুলার আসত তোমাদের বাসায়?
হুঁ। এসেই আমার হাত দেখতেন। আমার নাকি খুব ইন্টারেস্টিং হাত। হাতে। সোলেমানস রিংও আছে।
তাহের বিরক্ত গলায় বলল, সোলেমানস রিং-ফিং কিছু কিছু না। তোমার হাত ধরার লোভে আসত। এক ধরনের লোকই থাকে যারা মেয়েদের হাত ধরতে ওস্তাদ। ও নির্ঘাৎ এই কারণে আসত।
পারুল হাসতে হাসতে বলল, শেষের দিকে আমারও সেই রকম মনে হত। কারণ একদিন কি হল জান … একদিন হঠাৎ ভরদুপুরে তিনি এসে উপস্থিত। বড়চাচী ঘুমে, বাচ্চারা সব স্কুলে, শুধু আমি মেট্রিকের পড়া পড়ছি। আমি উনাকে এনে বসালাম। উনি বললেন–ঘরে খুব গোমট লাগছে, চল ছাদে যাই। আজ ম্যাগনিফ্রাইং গ্লাস নিয়ে এসেছি, তোমার হাত ভাল করে দেখব। আমি বললাম–চলুন। ছাদে যাওয়ার পর সিঁড়িতে…
তাহের অস্বস্তির সঙ্গে বলল, থামলে কেন? সিঁড়িতে কি?
থাক, শোনার দরকার নেই।
বল, কি হয়েছে শুনি।
তেমন কিছু হয়নি।
যা হয়েছে সেটাই শুনি …।
পারুল হাই তুলতে তুলতে বলল, কোন স্বামীরই উচিত না তার সুন্দরী স্ত্রীর জীবনের সব ঘটনা শোনা। একটা রূপবতী মেয়ের জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে যা বলে বেড়ানোর না। চল ঘুমাতে যাই। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
অরবিন্দ দাস–ঐ ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?
কোথায় থাকেন জেনে কি করবে? দেখা করবে?
তাহের কিছু বলল না। তার মুখ খানিকটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। পারুল জানে রেগে গেলে এই মানুষটার মুখে বিষণ্ণ ভাব চলে আসে। পারুল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ভদ্রলোক ইন্ডিয়া চলে গছেন।
কবে গেছেন?
কবে গেছেন সেই দিন-তারিখ তো আমি জানি না। অনেকদিন বাসায় আসেন না, তারপর এক সময় শুনলাম ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন।
ছাদের সিঁড়িতে ঐ লোক কি করেছিল? চুমু খাবার চেষ্টা করেছিল?
প্রায় সে রকমই।
প্রায় সে রকমটা আবার কি?
বললাম তো স্ত্রীর জীবনকথা সব শুনতে নেই।
তুমি তখন কি করলে?
কখন কি করলাম?
এখন ঐ হারামজাদা তোমাকে চুমু খেতে চাইল তখন?
ভদ্রলোককে শুধু শুধু গালি দিচ্ছ কেন?
চুমু খেয়ে বেড়াবে আর আমি গালি দেব না?
গালি দিতে হলে আমি দেব। তুমি কেন দেবে? তোমাকে তো চুমু খায়নি।
তোমার সঙ্গে কথা বলাই উচিৎ না।
দুজন আবার এসে বিছানায় বসল। পারুল তাহেরের দিকে ঘন হয়ে এল। ঘুম জড়ানো হালকা গলায় বলল–অরবিন্দ দাসের কথা ভেবে মাথা গরম করো না তো। অরবিন্দ দাসের কথা আমি তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। আমার বাসার অবস্থা তুমি জান না? আমার চাচা-চাচী থাকতে কার কি সাধ্য আছে রোজ রোজ আমাদের বাসায় এসে আমার হাত ধরে বসে থাকার? আমার চাচা তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। না? শুধু কি খাবে? খাওয়ার আগে কচলে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে।
বানিয়ে বানিয়ে এ রকম গল্প বলার মানে কি?
তোমার ঘুম চটিয়ে দেবার জন্যে গল্পটা বলেছি। আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই–আর তুমি আরাম করে ঘুমাবে, তা হবে না। এখন নিশ্চয়ই তোমার আর ঘুম দুম ভাব নেই–না কি আছে?
না, নেই।
তাহলে এক কাজ কর। আমাকে আদর কর। এমন রূপবতী একটা মেয়ে, তাকে তোমার আদর করতে ইচ্ছা করে না। আশ্চর্য!
বাড়ির নাম নীলা হাউস
বাড়ির নাম নীলা হাউস।
বিনয় করে নাম রাখা হয়েছে হাউস। প্যালেস হলে মানাত। না, প্যালেস মানাত না। প্যালেসে প্রকাশ্য ব্যাপার থাকে। প্যালেস মানে দর্শনীয় কিছু। লোকজন দেখবে, অভিভূত হবে। এ বাড়ি বাইরে থেকে দেখা যায় না। তের ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে বাড়ি ঘেরা। পাঁচিলের উপর আরো দুই ফুট ঘন করে কাটাতারের বেড়া। বাড়ির গেট লোহার। সাধারণত গেটের ফোঁকর দিয়ে বাড়ির খানিকটা দেখা যায়। এ বাড়ি গেটটি নিশ্চিদ্র লোহার। লখিন্দরের সূতা-সাপের ঢোকার ব্যবস্থাও নেই।
গেট পেরিয়ে কোনক্রমে ঢুকতে পারলে–কি সুন্দর বলে একটা চিৎকার দিতেই হবে। কারণ দোতলা বাড়ির ঠিক সামনেই নকল ঝিল করা হয়েছে। ঝিলে বাড়ির ছায়া পড়ে। আকাশের ছায়া পড়ে। বাড়িটাকে তখন মনে হয় আকাশ-মহল।