তাহলে কি?
আপনাকে খুশি করার ব্যবস্থা করব।
আমাকে কিভাবে খুশি করবে?
পারুল বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল, আর ঠিক তখন তাহেরের বিস্মিত গলা শোনা গেল–পারুল।
পারুল পাশ ফিরে দেখল–তাহের ঠিক তার পেছনে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ শুকিয়ে এতটুক। সে তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
তার লঙ্গির গিঁট খুলে গেছে। এক হাতে সে লুঙ্গি সামলাচ্ছে। অন্য হাতে পর্দা ধরে।
পারুল!
কি?
করছ কি তুমি এখানে?
কিছু করছি না। ঘুম আসছে না তাই চেয়ারে বসে আছি। দোল খাচ্ছি।
তোমার কাণ্ডকারখানা আমি কিছুই বুঝি না। দুনিয়ার সব বাতি জ্বালিয়ে রেখেছ।
কি করব, ভয় লাগে যে!
ভয় লাগলে আমাকে ডেকে তুলবে। কত করে বলেছি বাতি জ্বলাবে না। বাড়ির দারোয়ান আছে, সে দেখে কি না কি রিপোর্ট করবে।
রিপোর্ট করলে ভালই হয়।
ভাল হয় মানে?
পারুল চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, তুমি তো আর এই বাড়ির মালিকের র চাকরি কর না যে রিপোর্ট করলে তোমার চাকরি চলে যাবে। যা হবে তা হচ্ছে উনি তোমাকে আর কখনো পাহারা দিতে বলবেন না। তুমি বেঁচে যাবে।
বেঁচে যাবার কি আছে এর মধ্যে? বাড়ি পাহারা দেয়া এমন কি কঠিন কাজ?
তোমার জন্যে কঠিন না, আমার জন্যে কঠিন। এই বাড়িতে আর কিছুদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।
পারুল উঠে দাঁড়াল। তাহের বলল, তুমি যাচ্ছ কোথায়?
খিদে লেগেছে। আমি একটা বিস্কিট খাব আর এক কাপ চা খাব। তুমি চা খাবে।
রাত দুটার সময় আমি কোন দিন চা খাই?
খাও না বলেই খেতে বলছি। আজ খেয়ে দেখ, ভাল লাগবে।
তাহের বসার ঘরের সবগুলি বাতি নেভাল। ঘুমে তার চোখ জুড়িয়ে আসছে, তারপরেও সে গেল পারুলের পেছনে পেছনে। মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনাই ভুল হয়েছে। বড়লোকি কাণ্ডকারখানা দেখে মাথা গেছে খারাপ হয়। মাথা খারাপ হবারই কথা।
স্টোভ থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। স্টোভে চায়ের কেতলি চাপিয়ে পারুল বসে আছে। এ বাড়িতে বিশাল রান্নাঘর আছে। একটি না, দুটি। একতলায় একটা, দোতলায় একটা। করিম সাহেব রান্নাঘর তালাবন্ধ করে গেছেন। তাহেরের জন্যে স্টোভ দিয়ে গেছেন। চাল-ডাল আছে, তার উপর প্রতিদিন ২৫ টাকা হিসেবে ৭৫০ টাকা, হাতখরচ হিসেবে আরো ২৫০। সব মিলিয়ে এক হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। সবই চকচকে ৫০ টাকার নোট–খরচ হতে মায়া লাগে। মাস প্রায় শেষ হতে চলল, খরচ হয়েছে চারশ। আর ছয়শ টাকা আছে। তাহের পারুলকে বাকি টাকা দিয়ে দিয়েছে। বিয়ের পর থেকে তো কখনো হাতে কিছু দেয়া হয়নি–থাকুক এই টাকাগুলি।
তাহের দেখল, পারুল দুকাপ চা বানাচ্ছে। গরম খানিকটা মিষ্টি পানি। কি হয় খৈলে? এই জিনিস পারুল এত আগ্রহ করে কেন খায় সে বুঝতে পারে না। রাত তিনটার সময় চা খেলে ঘুমের দফা রফা। তব খেতে হবে। বানানো জিনিস নষ্ট করা যায় না। চা বানাতে দেখেই তাহেরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে প্রকাশ করল না। পোয়াতী বউয়ের সঙ্গে মেজাজ করতে নেই। মেজাজ করলে বাচ্চাও মেজাজী হবে। বড় হয়ে বাপ-মার সঙ্গে মেজাজ করবে। বাবার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করবে।
পারুল বলল, আচ্ছা, তুমি কখনো হাত দেখিয়েছ?
তাহের কিছু বলল না। হাত দেখার প্রসঙ্গ কেন আসছে বুঝতে পারছে না। রাত তিনটা হল ঘুমের সময়, বকবকানির সময় না।
হাত দেখাও নি?
না।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একজন বড় জ্যোতিষকে হাত দেখিয়েছিলাম। তিনি আমার হাত দেখে বলেছিলেন আমার হাতে মীন পুচ্ছ আছে।
তাহের চায়ের কাপে বিরক্ত মুখে চুমুক দিচ্ছে। স্ত্রীর হাতের মীন পুচ্ছের ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। পারুলের চোখ গল্প বলার উত্তেজনায় চকচক করছে।
মীন পুচ্ছ কাকে বলে জান? মনিবন্ধের কাছে মাছের লেজ্জের মত একটা চিহ্ন।
মীন পুচ্ছ থাকলে কি হয়?
টাকা হয়–লক্ষ লক্ষ টাকা। কোটি কোটি টাকা।
ও, আচ্ছা।
শুধু টাকা না–গাড়ি বাড়ি…দেখি তোমার হাতটা দেখি। আমার মনে হয় তোমার হাতে মীন পুচ্ছ আছে। কারণ আমার টাকা হওয়া মানে তো তোমারও হওয়া।–আমার মীন পুচ্ছ থাকলে তোমারও থাকতে হবে। হাতটা দাও তো।
তাহের চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, চল শুয়ে পড়ি।
হাতটা দিতে বললাম না।
মীন পুচ্ছ-তুচ্ছ দেখে লাভ নেই। ঘুমতে চল।
এর আমার এখন ঘুম আসবে না।
ঘুম না আসলেও বিছানায় শুয়ে থাক।
পারুল বলল, শুধু শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতে পারব না।
কি করবে? এখানে বসে থাকবে?
হুঁ।
এইসব পাগলামির কোন মানে হয়?
পারুল হাসছে। মনে হচ্ছে তাহেরের বিরক্তিতে সে মজা পাচ্ছে।
হাসছ কেন?
একটা কথা মনে করে হাসছি।
কি কথা।
ব্যাঞ্জের মাথা।
তাহেরের এখন রাগ লাগছে। কি কথা ব্যান্ডের মাথা জাতীয় ছেলেমানুষীর বয়স কি পারুলের আছে? দুদিন পর যে মেয়ে মা হতে যাচ্ছে। তাহের উঠে দাঁড়াল। পারুল বলল, চলে যাচ্ছি না কি?
হুঁ।
কথাটা শুনে যাবে না? আমি কেন হাসলাম না জেনেই চলে যাবে? কেন হাসছি জেনে তারপর চলে যাও। যখন চা বানাচ্ছিলাম তখন ঐ জ্যোতিষের কথা আমার মনে পড়ল। উনিও খুব চা খেতেন। এক কাপ চায়ে চার চামুচ করে তাঁর চিনি লাগত।
ঘাটনটি কি সেটা বল।
বলছি তো–তুমি এত তাড়াহুড়া করছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এক্ষণি টন ধরতে যাবে। আরাম করে বোস তো। বাসে একটা সিগারেট খাও। আমি সিলেট এনে দিচ্ছি।
সিগারেট আনতে হবে না–আমি বসছি। কি বলবে তাড়াতাড়ি বল। স্টোটা নিভিয়ে দাও না–খামাখা তেল খরচ হচ্ছে।