আমি অবাক হয়ে আমার সাজ-পোশাক দেখছি। মা হাসিমুখে বললেন, তোকে শেষবারের মত দেখতে এসেছি রে খোকন। আমার সুন্দর চেহারাটা যেন তোর মনে থাকে এই জন্যেই সেজে এসেছি। তোর জন্যেই সেজেছি আমি, কোলে আয়। আমাকে কোলে নিলেন। এবং চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আমার খোকনের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার খোকনের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
তিন-চার বছরের কোন স্মৃতি মানুষের থাকে না। আমারো নেই। শুধু মার সবুজ শাড়িটার কথা মনে আছে। আপনার পরনে যখন সবুজ শাড়ি দেখি তখন…
আপনার মার সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি?
জ্বি না। মা ইংল্যাণ্ডে যাবার ছবছরের মাথায় মারা যান। ঐখানেই তার কবর বাঁধানো আছে। কোন দিন যদি টাকা হয়–মার কবরটা ছুঁয়ে দেখার জন্যে একবার ইংল্যাণ্ডে যাব।
আপনি কি আরেক কাপ কফি খাবেন
জ্বি-না।
প্লীজ খান, প্লীজ।
না না–লাগবে না। চা-কফি এম্নিতেই আমি খাই না।
তাহের বের হয়ে গেল। কোথায় যাবে সে বুঝতে পারছে না। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা। করছে না। আজকের দিনটাও সে বাইরে বাইরে ঘুরবে। সন্ধ্যার পর ফিরবে। কাল থেকে বাসাতেই থাকবে। কুকুরের যত্ন করবে। বাগান করবে। লনের ঘাস বড় হয়ে গেছে। ঘাসগুলি ছেটে সমান করে দিতে হবে। মালীর কাজও সে-ই করবে। যেন নীলা হাউসে অন্য কেউ ঢুকতে না পারে।
এখন কোথায় যাওয়া যায়? পল্টু সাহেবের ফার্মেসিতে গেলে কেমন হয়? উপশম। উনার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। ভদ্রলোককে বলতে হবে, স্যার, আমার জন্যে চাকরি খুঁজতে হবে না। আমি খুব ভাল আছি। সুখেই আছি। I am a happy man.
পল্টু সাহেব ফার্মেসিতে ছিলেন না। কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতে পারল না। সকাল বেলাই বেরিয়ে গেছেন। তার গাড়ি নেননি।
তাহেরের কেন জানি মনে হল, উনি গিয়েছেন নীলা হাউসে। পারুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।
তাহের পার্কের দিকে রওনা হল। বেঞ্চিতে শুয়ে আজ বিশ্রাম করবে। কাল থেকে নানান কাজ–বিশ্রামের সময়ই পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা জমাট ঘুম দেবে। নাক ডাকিয়ে ঘুমুবে।
পল্টু ভাই
গেটের দরজা খুলে পারুল হাসিমুখে বলল, আসুন পল্টু ভাই, আপনি সত্যি সত্যি আসবেন ভাবতেই পারিনি।
পল্টু সাহেবের গায়ে সুন্দর একটা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বোতামগুলি সোনার। আলো পড়ে ঝকঝক করছে। তার চোখে সানগ্লাস। তিনি সানগ্লাস খুলে হাতে নিতে নিতে খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, এত বড় বাড়ি।
হুঁ। বিরাট বাড়ি।
বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে এত সুন্দর একটা বাড়ি। তোমার স্বামী কোথায়? তাহের, আবু তাহের?
ও বাসায় নেই। এ তো সকালে যায়। একেবারে সন্ধ্যায় আসে।
তাহেরকে বলেছিলাম ছবিসহ বায়োডাটা দিতে। দেয়নি। আমি দু-এক জায়গায় কথা বলেছি। ওকে পাঠিয়ে দিও।
জ্বি আচ্ছা, পাঠাব।
পারুল গেটে তালা দিতে দিতে বলল, আপনি আসায় আমি কি যে খুশি হয়েছি। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, আবার একবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
তুমি খুব সুন্দর হয়েছ পারুল।
সত্যি বলছেন তো?
হ্যাঁ সত্যি।
আপনি কিন্তু আগের মতই আছেন।
বুড়ো হয়েছি তো।
বুড়ো বুড়ো কিন্তু লাগছে না।
তুমি ছাড়া আর কেউ এ বাড়িতে থাকে না?।
না।
পারুল হাসছে। খিল খিল করে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, একটু দাঁড়ান পল্টু ভাই। এক মিনিট। আমার তিনটা কুকুর আছে। এদের ছেড়ে দিয়ে আসি। এই সময় এরা খানিকক্ষণ বাগানে চক্কর দেয়। সময়মত না ছাড়লে খুব রাগ করে।
কি ধরনের কুকুর?
গ্রে হাউন্ড।
গ্রে হাউড ভাল কুকুর। বাড়ি পাহারার জন্যে আদর্শ। আমার নিজেরো একটা ছিল। কুমিল্লার সরাইলের কুকুর। গ্ৰ হাউরেই একটা ভ্যারাইটি। মারা গেছে। তোমার এই কুকুরগুলির ভেতর মাদি কুকুর আছে?
আছে–নিকি। নিকি হল মেয়ে কুকুর।
বাচ্চা হলে দেখ তো আমাকে একটা দেয়া যায় কি-না।
আপনি চাইলে অবশ্যই দেব। আপনি কিছু আমার কাছে চাইবেন আর আমি দেব না, তা কখনো হবে না। যা চাইবেন তাই পাবেন। কুকুরের ছানা ছাড়া আর কিছু চান?
পল্টু সাহেব আনন্দের হাসি হেসে বললেন–আপাতত এক কাপ চা চাচ্ছি। তারপর দেখা যাক…
পারুল কুকর ছেড়ে দিয়েছে। তারা একবার অপরিচিত মানুষটার দিকে তাকালো, তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বাড়ির চারদিকে হাঁটতে শুরু করল। পল্টু সাহেব বললেন–এ তো দেখি ভংয়কর কুকুর। এদের ম্যানেজ কর কিভাবে?
এরা আমাকে খুব পছন্দ করে। আমাকে খুব মানে। যা করতে বলি তাই করে। পল্টু ভাই আসুন, আমরা বাগানে বসে চা খাই। চা খাবার পর আপনাকে ঘরে নিয়ে যাব। এখানে দাঁড়ান, আমি চেয়ার নিয়ে আসি।
চেয়ার লাগবে না। আমি ঘাসের উপরই বসছি।
তাহলে বসুন। আমি চা বানিয়ে আনছি।
তিনি বসলেন। সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়েই তার গা হিম হয়ে গেল। তিনটা কুকুর পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনজন তিন দিক থেকে আসছে। পালিয়ে যাবার পথ নেই। তিনি ভাঙা গলায় ডাকলেন–পারুল, এই পারুল।
পারুল স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের কেতলি বাসিয়েছে। তার মুখ হাসি হাসি। পল্টু সাহেব উঁচু গলায় ডাকলেন–পারুল, পারুল!
পারুল বলল, চা বানাচ্ছি তো।
দুটি কুকুর পটু সাহেবকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে। একজন স্থির হয়ে আছে। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সে কোন একটা সংকেতের অপেক্ষা করছে। সংকেত পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তার পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে জব জব করছে। তিনি পেছনে ফিরলেন–পিছনে বড় একটা গর্ত।