তাহের খেতে বসেছে। পাগলের মত খাচ্ছে। মুঠি ভর্তি ভাত মুখে দিচ্ছে। ঠিকমত চিবুচ্ছে না, গিলে ফেলছে। পারুল অবাক হয়ে দেখছে। তাহের লজ্জিত মুখে বলল, রাক্ষসের মত খিদে লেগেছে।
তাই তো দেখছি।
একবেলা খাই তো, মনে হয় এই জন্যে। কুকুর স্বভাব হয়ে গেছে একবেলা আওয়া। হা হা হা।
এরকম অদ্ভুত করে হাসছ কেন।
তাহেরের মুখ ভর্তি ভাত। কখা বলা সমস্যা। তার মধ্যে বলল, একটা অসাধারণ। ভাল খবর আছে। মেসবাউল সাহেবের ক্যান্সার হয়েছে।
পারুল বলল, মুখের ভাত শেষ করে কথা বল। পানি খাও।
তাহের মুখের ভাত গিলে ফেলল। পুরো এক প্রান পানি খেয়ে হাঁপাতে লাগল।
পারুল বলল, কি বলছিলে?
আমার স্বভাব হয়ে গেছে শয়তানের মত। মিথ্যা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। বাইরে এখন বলতে গেলে সারাক্ষণই মিথ্যা বলি। খুব গুছিয়ে বলি।
মিথ্যা সব সময় গুছিয়ে বলতে হয়। সত্য গুছিয়ে বলতে হয় না।
ঠিক বলেছ। ভেরি রাইট। মিথ্যা বলায় এখন এমন এক্সপার্ট হয়েছি, যাকে যা বলি তাই সে বিশ্বাস করে।
মেসবাউল করিম সাহেবের সম্পর্কে কি যেন বলছিলে?
উনার ক্যান্সার হয়েছে। দুঃখজনক খবর, কিন্তু আমি বললাম, কি রকম করে দেখেছ? আমি বললাম–একটা অসাধারণ ভাল খবর আছে …, একেবারে কুকুরের মত হয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন পর হতে দেখলে মেঝেতে চার পায়ে হামা দিচ্ছি।
পারুল শান্ত গলায় বলল, মেসবাউল করিম সাহেবের ক্যান্সার হওয়ায় আমাদের কিছু সুবিধা হয়েছে এই জন্যেই তুমি বলেছ–অসাধারণ ভাল খবর। মানুষ মাত্রই নিজের ভালটা আগে দেখে। এটা অপরাধ না। এবং এটা কুকুরের স্বভাবও না। মানুষের স্বভাব। সাধারণ মানুষের স্বভাব।
তাও ঠিক। আরো একটা খবর আছে। সেই খবরটা আরো ভাল। আন্দাজ কর তো খবরটা কি?
পারুল বলল–রহমান সাহেব তোমাকে বলেছেন যে তুমি আমাকে এনে তোমার সঙ্গে রাখতে পার।
আশ্চর্য তো। আসলেই তাই। কি করে বললে?
আমি উনাকে চিঠিতে অনুরোধ করেছিলাম।
চিঠি তো উনাকে দেইনি। চিঠির কথা মনে ছিল। দেয়ার সাহস হয়নি।
চিঠি না পড়েই তিনি আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিলেন?
হ্যাঁ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আনান-এর জন্ম পর্যন্ত আমরা এ বাড়িতে থাকতে পারব।
তুমি কি পল্টু ভাইয়ের চিঠিটাও তাকে দাও নি?
হ্যাঁ, দিয়েছি।
উনি কি বললেন?
খুব খুশি হয়েছেন। বলেছেন একবার এসে তোমাকে দেখে যাবেন।
কবে আসবেন?
তা বলেননি। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ছবিসহ বায়োডাটা দিতে বললেন। আমার জন্যে চাকরির চেষ্টা করবেন। করবেন না কিন্তু তা জানি–তবুও তো বলল। আজকাল তো মুখের বলটাও কেউ বলে না।
পারুল হাসছে। তার হাসির বেগ বাড়ছে। সে আঁচলে মুখ চাপা দিল। তাহের তাকিয়ে আছে। এ কি বিশ্রী অভ্যাস হচ্ছে পারুলের! হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে কুকুর তিনটা এসেছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাদের লম্বা মুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে। পারুল হাসতে হাসতে বলল, খবর শুনেছিস? পল্টু ভাই আমাকে দেখতে আসবেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। উনি এলে তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। উনাকে খুব ভাল লাগবে।
তাহের বলল, কুকুরের সঙ্গে কথা বলছ?
নগর মাছ সব সময়ই তো বলি। নতুন কি?
এইসব লক্ষণ ভাল না। খারাপ লক্ষণ।
খারাপ লক্ষ কেন? তোমার কি বা হাবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমিও এক সময় করে হয়ে যাব? চার পায়ে হামা দেব? এটা মন্দ না কিন্তু। তুমি আমি দুজনেই হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে হাঁটছি–হি হি হি।
তাহের খেতে শুরু করেছে। খাওয়া বন্ধ করে অনেকক্ষণ কথা বলার জন্যে খিদে। মরে গেছে, এখন আর খেতে ভাল লাগছে না। পারুল বলল, এই শোন। তাকাও আমার দিকে।
তাহের তাকালো। পারুল বলল, এখন এ বাড়িতে আমাদের গুছিয়ে বসতে হবে। কাজেই কামরুল যে নেই এটাও তোমাকে অফিসে জানাতে হবে।
কি বলব তাদের? আমরা তাকে মাটিতে পুঁতে রেখেছি, যাতে ফুলের বাগানে ভাল সার হয়?
কি বলবে তা তুমিই ঠিক করবে। একটু আগেই না বললে তুমি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পার। খুব গুছিয়ে কিছু একটা বলবে। ভাল কথা, তোমাকে যে একটা চিঠি লিখেছিলাম সেটা পড়েছ?
তাহের বিরক্ত মুখে বলল, কিছুই তো সেখানে লেখা নেই। শাদা একটা পাতি। এই রকম ঠাট্টা করার মানে কি? আমি তো ঘাম খুলে হতভম্ব।
পরুল আবার হাসতে শুরু করেছে। তার হাসির বেগ বাড়ছে। এই তো এখন মুখে আঁচল চাপা দিল। তাহের ঘাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে সে পরুলকে দেখছে। নিকি, ফিবো ও মাইক ওর। ও দেখছে। তবে তারা অবাক হচ্ছে না। পশুদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা থাকে না।
এত হাসছ কেন?
আনন্দ হচ্ছে এই জন্যে হাসছি। আচ্ছা শুন কুকর যে হাসতে পারে তা-কি তুমি জান?
কুকুর হাসতে পারে?
হ্যাঁ পারে। আজ সকালে কি হয়েছে শোন–আমি নিকিকে বললাম, এই নিকি তুই দুই স্বামী নিয়ে ঘুরে বেড়াস তোর লজ্জা লাগে না? তখন দেখি নিকি চুপ করে আছে। ফিবো হাসছে।
পারুল তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার?
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ ফিবো হাসছে। দেখ ভাল করে।
তাহের তাকাল।
সে রকমই তো মনে হচ্ছে। তাহেরের গায়ে কাঁটা দিল।
পা ছুঁয়ে কদমবুসি
টেবিলের নিচে রহমান সাহেবের পা। সেই পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে হলে প্রায় হামাগুড়ির পর্যায়ে যেতে হয়। তাহের তাই করল। নিজেকে এখন তার সত্যি সত্যি কুকুর কুকুর লাগছে।
রহমান সাহেব বললেন, থাক এক। সালাম লাগবে না। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছো?
জ্বি স্যার।