তাই ভাল–ছাদে বসে ভাবী গান গাইবে, আপনি শুনবেন।
তফাজ্জল সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, নিন আরেকটা সিগারেট নিন।
তাহের সিগারেট নিল।
প্যাকেটা রেখে দিন। আমার কাছে থাকা না থাকা একই। আমি তো খেতে পারছি না।
খেয়ে ফেলুন একটা। ভাবীতো আর দেখছে না?
ওকে চেনেন না। লুকিয়ে সিগারেট খেলেও ঠিক ধরে ফেলবে।
তাহলে না খাওয়াই ভাল।
তফাজ্জল তাহেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
পাঁচটা বাজে।
ম্যানেজার সাহেবকে টেলিফোন করার সময় হয়ে এসেছে। তফাজ্জল সাহেবের বাসায় আরো কিছুক্ষণ থাকলে সেখান থেকে কথা বলা যেত। তবে টেলিফোনের কথাবার্তা তফাজ্জল সাহেব শুনলে সমস্যা হয়ে যেত। অংকের প্রফেসর কুকরের ইনজেকশন নিয়ে ছোটাছুটি করছে… কেমন যেন লাগে।
কে কথা বলছেন?
স্যার, আমি তাহের।
ও আচ্ছা, তাহের।
ইনজেকশন দেয়া হয়েছে স্যার।
গুড।
বেবী টেক্সীতে তিনটাকে একসঙ্গে ঢোকানো একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেছি।
ভেরী গুড। ডাক্তার ইমুনাইগ্রেশন সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেনতো?
জ্বিনা–কাল এসে নিয়ে যেতে বলেছেন।
দেশের কি অবস্থা। সামান্য একটা কাজ একবারে হয় না। দুবার তিনবার যেতে হয়। তুমি মনে করে কাল সাটিফিকেটটা নিয়ে এসো।
অবশ্যই নিয়ে আসব।
তাহের বলে, স্যার, তাহলে টেলিফোন রেখে দেই?
আচ্ছা। ও শোন–বড় সাহেবের একটা খবর আছে, তোমাকে দেয়া দরকার। খারাপ খবর। ভেরি ব্যাড নিউজ। উনার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
কি বলছেন স্যার?
এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবু ক্যান্সার বলে কথা। স্যার চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা চলে যাবেন। তোমাকে আরো বেশ কিছুদিন বাড়ি দেখাশোনা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
কোন অসুবিধা নেই স্যার।
তোমার কাজকর্মে আমি খুশি। বড় সাহেব এলে উনাকে বলে আমি তোমার জন্যে অফিসে পার্মানেন্ট একটা ব্যবস্থা করব। তুমি এম. এ. পাশ আমি জানতাম না। মনিকার কাছে শুনলাম।
থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম স্যার। থার্ড ক্লাস এম. এ. আর মেট্রিক একই।।
কথাটা মন্দ বলনি। যাই হোক, আমি দেখব–আরেকটা কথা–এতদিন যখন তোমাকে থাকতেই হবে–তুমি বরং তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এসো। দুজন মিলেই থাক। বাড়ি দেখাশোনা কর।
আপনার দয়ার কথা কোনদিন ভুলব না স্যার।
তাহের কান্নায় মত একটা শব্দ করল। হেঁচকি তুলে ফেলল। যে দোকান থেকে টেলিফোন করা হচ্ছে সেই দোকানের দুজন কর্মচারী অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তারা। অনেকদিন এমন উৎকৃষ্ট অভিনয় দেখেনি।
টেলিফোনের ওপাশ থেকে রহমান সাহেব কোমল গলায় বললেন, কি মুশকিল, কাঁদছ কেন? যাও, এখনি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আস। বিছানা, টুকটাক জিনিস সব নিয়ে চলে এসো। টেক্সি নিয়ে যাও। অফিসে বিল করে দিও। টেক্সি ভাড়া দিয়ে দেবে।
জ্বি আচ্ছা, স্যার।
টেলিফোনের জন্যে দোকানে পাঁচ টাকা দিতে হয়। তাহের দশ টাকা দিয়ে বলল, বাকিটা রেখে দিন ভাই। চা খাবেন।
প্রথম দিন পারুল যখন এ বাড়িতে এসেছিল, ভয়ে সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার কেন জানি ভয় লাগছে। ভয়টা সন্ধ্যা থকে শুরু হয়েছে। মতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। বারান্দায় স্টোভ জ্বালিয়ে ভাতের চুলা বসানোর সময় গ্রিলের পাশে খক খক কাশির শব্দ শুনল। কাশির পর থু করে থুথু ফেলার শব্দ। অবিকল কামরুল যেমন থুথু ফেলত সে রকম। পারুল চোখ তুলে কিছু দেখার চেষ্টা করল না। আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। আগুন মানুষের ভয় কাটিয়ে দেয়, তার ভয় কাটছে না। বরং ভয়টা একটু একটু বাড়ছে। স্টোভ থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। শব্দটার ভেতরও কিছু আছে। সে কি স্টোভ নিভিয়ে শোবার ঘরে চলে যাবে? দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে? দরজা বন্ধ করে বসে থাকা যাবে না। শোবার ঘর থেকে গেটের শব্দ শোনা যায় না। তাহের এসে গেটে ধাক্কা দেবে, কলিংবেল টিপবে। সে শুনতে পাবে না। কাজেই তাকে বসে থাকিতে হবে বারান্দায়।
কে যেন বরান্দার পেছনে হাঁটছে। পা টেনে টেনে হাঁটছে। পারুলের হাত-পা শক্ত হয়ে আসছে। সে ঢাপা গালায় ডাকল, ফিবো, নিকি, মাইক।
কুকুর তিনটির ছুটে আসার কথা। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে থাকার কথা–কেউ আসছে না। ওরা আসছে না কেন? কেউ কি ওদের বলেছে–না, তোমরা যাবে না, ওদের পরিচিত কেউ?
স্টোভের শব্দ কমে আসছে। পাম্প করতে হবে। আশ্চর্য! পাম্প করার শক্তিও তার নেই। পারুল উঁচু গলায় ডাকল–নিকি, ফিবো, মাইক।
ঝন ঝন করে শব্দ হল। তখনি পারুলের মনে পড়ল, এরা শিকল দিয়ে বাধা। পারুল নিজেই বেঁধে রেখেছে, খুলে দিতে মনে নেই। এরাই হয়ত কাশছিল। কুকুরের ঠাণ্ডা লাগলে এরা অবিকল মানুষের মত কাশে।
গেটে শব্দ হচ্ছে। প্রথম পর পর তিনবার, একটু থেমে আবার দুবার। তাহের চলে এসেছে। এখন মুখ তুলে গ্রিলের বাইরে তাকানো যায়। পারুল কিছু দেখবে ভাবেনি। তারপরেও অস্পষ্টভাবে দেখল–মাটির স্তূপের উপর কে যেন বসে আছে। পাত অটছে। কামরুল না? হ্যাঁ, কামরুলই তো।
চোখের ভুল। অবশ্যই চোখের ভুল। ভয় পেলেই মানুষ চোখে ভুল দেখতে শুরু করে। গেটে শব্দ হচ্ছে। তিনবার–দুবার। তিনবার দুবার। আশ্চর্য! ছায়া ছায়া লোকটাও শব্দ শুনে গেটের দিকে তাকাচ্ছে।
পারুল উঠল। গেটের দিকে রওনা হল। যে তীব্র ভয় শুরুতে লাগছিল এখন তা লাগছে না। পারুলকে দেখে নিকি, ফিবো, মাইক ডাকাডাকি শুরু করেছে। পারুল। আগে তাদের দিকে গেল। ওদের ছেড়ে দিতে হবে। ওরা ছাড়া থাকলে ভয় থাকবে না। এরা বাড়ির চারপাশে চক্কর দেবে। মাটির স্তূপের উপর কাউকে থাকতে দেবে না।