না না–আরেকজন প্রিয় মানুষ আছে। সে বড় হচ্ছে। এদিন সে মায়ের পেটে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুছে। বাইরের ভয়াবহ ভয়ংকর পৃথিবী সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।
পৃথিবীর সমস্ত বাবা-মা চায় তাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে। তারা তা পারছে না। শিশুর জন্মের আগে বাবা-মারা তাদের জন্যে কত কি জোগার করে রাখেন। ছোট্ট বিছানা, ছোট্ট বালিশ, একটা ছোট্ট সার্টিনের লেপ। তুলতুলে মাখনের মত জুতা। তারা কোন কিছুই জোগার করতে পারেনি। মনে হয় পারবে না। তারা শুধু সুন্দর একটা নাম জোগার করে অপেক্ষা করবে। আনান–মেঘ।
জল ভরা দিন কালো মেঘ।
ফার্মেসীর নাম উপশম
ফার্মেসীর নাম উপশম।
বিশাল হুলুস্থুল কাণ্ডকারখানা। ফার্মেসীর মালিক আলাদা বসেন। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভদ্রলোকের নাম দেলোয়ার হোসেন। তবে দোকানের কর্মচারীরাও তাকে পল্টু নামেই চেনে। তাহেরের পল্টু সাহেবকে খুঁজে বের করতে দেরী হল না। পলু সাহেবের সামনে চার পাঁচটা চেয়ার। একজন সেই চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। পল্টু সাহেব তাহেরকে বসতে বললেন না। চোখ মুখ কুঁচকে চিঠি পড়তে শুরু করলেন এবং প্রবল বেগে পা নাচাতে লাগলেন। মনে হচ্ছে পা নাচানো তার অভ্যাস। তাহেরের মনে হল পুরো চিঠি তিনি দুবার পড়লেন। তারপর তাহেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস বাস। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো ন। পারুল ছিল আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। যতদূর মনে হয় তাকে তুই করে বলতাম। সেই হিসেবে তোমাকে তুমি বলছি।
অবশ্যই বলবেন স্যার।
আমাকে স্যার বলবে না। পারুল আমাকে পল্টু ভাই ডাকতো। তুমিও তাই ডাকবে। এবসুলিউটলি নো প্রবলেম। কি খাবে বল?
কিছু খাব না।
কিছু খাবে না বললেতো হবে না। পারুল যদি শুনে তার পল্টু ভাই কিছু না খাইয়ে তার স্বামীকে বিদায় করেছে তাহলে খুব অভিমান করবে।
এক কাপ চা খেতে পারি।
চা তো সবাই সবাইকে খাওয়ায়। তাতে বিশেষ কোন মমতা দেখানো হয় না। লাচ্ছি খাও। গরমের মধ্যে লাচ্ছি ভাল লাগবে। বাজে কটা, দশটা? গুড। পাশেই একটা দোকান আছে, দশটার দিকে গরম গরম সিঙ্গারা ভাজে। কলিজি সিঙ্গারা। একবার খেলে মুখে স্বাদ লেগে থাকে। বয়স হয়েছে, গুরুপাক জিনিস খেতে পারি না। তুমি খাও, ইয়াংম্যান, তোমার এখন লোহা হজম করার বয়স।
পল্টু সাহেব সিঙ্গারা ও লাচ্ছি আনতে দিলেন। হাসি হাসি মুখে তাকালেন। ভদ্রলোকের মাথার চুল ধবধবে শাদা। কিন্তু স্বাস্থ্য এখনো বেশ ভাল। ঠোঁট অবশ্যি ফোলা ফোলা।
তোমার নামটা কি তাতো জানা হল না।
আমার নাম তাহের।
শুধু তাহেরতো নাম হয় না। তাহেরের সঙ্গে আর কি আছে?
আবু তাহের।
ভেরী গুড। আবু তাহের। শুন আবু তাহের, পারুল চিঠিতে লিখেছে একবার তাকে গিয়ে দেখে আসতে। যাব, নিশ্চয়ই যাব। সময় পেলে হুট করে একদিন চলে যাব।
চাকরি বাকরি পাচ্ছ না বলে লিখেছে। আমি চেষ্টা করব। তুমি ছবিসহ বায়োডাটা দিয়ে যেও।
জ্বি আচ্ছ।
চাকরির বাজার খুবই খারাপ। তবু দেখি কি করা যায়। তোমরা যেখানে থাক সেই জায়গার ঠিকানাটা ভাল করে লিখে দাও দেখি। বাসে করে যদি যাই কোথায় নামব।
তাহের বলল, আপনি একা একা যাবেন না। বাড়িতে কুকুর আছে। কুকুরগুলা ভয়ংকর রাগী। আপনি কখন যেতে চান বলবেন, আমি নিয়ে যাব।
সেটাতো সবচে ভাল হয়। তবু তুমি ঠিকানা লিখে দাও। ঐ দিকে ব্যবসায় খাতিরে প্রায়ই যেতে হয়–অসময়ে উপস্থিত হয়ে পারুলকে চমকে দিয়ে আসব, হা হা হা।
তাহের সিঙ্গারা খেল, লাচ্ছি খেল, পান খেল। পল্টু সাহেব আরো ভদ্রতা করলেন। তিনি তাঁর গাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি কোথায় যাবে বল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। পারুলের তুমি হাসবেন্ড এইটুকু খাতির তো তোমাকে করতেই হবে।
অফিসে নেমেই তাহের শুনল রহমান সাহেব তার খোঁজ করছেন। বলেছেন তাহের এলেই যেন তার সঙ্গে দেখা করে। খুব জরুরী।
তাহের দেখা করতে গেল। রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–কামরুলকে খবর দিতে বলেছিলাম, তুমি দিয়েছ? কাল রাতে হঠাৎ বড় সাহেব বাসায় টেলিফোন করে জানতে চেয়েছেন কুকুরগুলিকে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে কি না। আমি না জেনেই বলেছি দেয়া হয়েছে। নয়ত উনি টেনশানে থাকবেন। অফিসে এসে শুনি কামরুল এখনো ইনজেকশন নিতে আসেনি। তুমি কি তাকে বলনি?
বলেছি, স্যার।
তাহলে আসছে না কেন? বড় সাহেব নেই বলে তেল বেশী হয়ে গেছে? চিপে তেল সব বের করে ফেলব—হারামজাদা–
তার শরীরটা খুব খারাপ এইজন্যে বোধহয় আসছে না। আজকেও জ্বর দেখে এসেছি। একটা কাজ করলে কেমন হয় স্যার। আমি ইনজেকশনগুলি নিয়ে যাই–আমি নিজের দায়িত্বে ইনজেকশন দেয়ায়ে দিব।
এটা মন্দ না। কোথায় নিতে হবে জানতো?
জানি স্যার, মহাখালি।
পারবে?
অবশ্যই পারব। অফিসের ভ্যান একটা নিয়ে যাও।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ভ্যান আছে কি-না এখন কে জানে। যখন যেটা প্রয়োজন সেটাতো কখনো থাকে না। দাঁড়াও, আমি দেখি ভ্যান আছ কি-না।
রহমান সাহেব টেলিফোন তুলে ভ্যানের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। তাহের তার মুখ দেখে বুঝতে পাল ভ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। তাহের বলল, ভ্যান না পাওয়া গেলেও অসুবিধা হবে না স্যার। আমি বরং ডাক্তার সাহেবকে বাড়িতে নিয়ে আসব, তিনি এসে ইনজেকশন দিয়ে দেবেন। আগে একবার দিয়ে গেছেন। তাকে তিনশ টাকা দিতে হবে। আর আপনি যদি বলেন তাহলে বেবীটেক্সী করে নিয়ে যেতে পারি।