চিঠি কোথায় বসে লিখবে পারুল বুঝতে পারছে না। তাহেরের কাছে বসেই লেখা উচিত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তাকে না দেখে চমকে উঠতে পারে। চিঠি লিখতে হবে গুছিয়ে খুব সুন্দর করে, যেন পল্টু ভাই চিঠি পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে যান। এত গুছিয়ে সে কি লিখতে পারবে? তারাই গুছিয়ে চিঠি লিখে যাদের চিঠি লিখে অভ্যাস আছে। তার অভ্যাস নেই। চিঠি লেখার মত মানুষ তার কখনো ছিল না। একজন ছিল, সব সময় ছিল। এখনো আছে। সে এত কাছে যে তাকে চিঠি লেখা হয়নি। আজ তাকেও একটা চিঠি লিখবে। পারুল তাহেরের মাথার কাছে বসল। হাঁটুর উপর কাগজ রেখে সে লিখছে। কাগজের নিচে শক্ত মলাটের একটা বই। বই ভর্তি মেয়েদের ছবি। চিঠি লেখা শেষ। সে ছবিগুলি দেখবে। ফ্যাশানের বই। মেসবাউল করিম সাহেবের ঘরে ফ্যাশানের বই কেন কে জানে!
পারুল লিখতে শুরু করেছে। তার হাতের লেখা সুন্দর, আজ তত সুন্দর হচ্ছে না।
শ্রদ্ধেয় পল্টু ভাই,
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছো? আমার নাম পারুল। এক সময় আপনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দুই বিঘে জমি কবিতাটি আপনি আমাকে খুব সুন্দর করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখন কি মনে পড়ছে?
কতজনের সঙ্গে আপনার পরিচয়! হয়ত মনে করতে পারছেন না। মনে করিয়ে দেবার জন্যে অনেকটা ঘটনা বলি। কবিতাটি শেষ পর্যন্তু আমি আবৃত্তি করতে পারিনি। যেদিন অনুষ্ঠান হবার কথা তার আগের রাতে আপনার বাসায় একটা ঘটনা ঘটে গেল। এখন কি মনে পড়েছে?
সে রাতে আপনার উপর আমি খুব রাগ করেছিলাম। কিন্তু মনে মনে আপনাকে আমি এত শ্রদ্ধা করতাম, এত ভালবাসতাম যে পুরোপুরি রাগ করতে পারিনি। এক সময় মনে হল, যা হবার হয়েছে। ভালই হয়েছে। দু একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা সব মেয়ের জীবনেই থাকা উচিত। এখন আমার খবর বলি। আমার বিয়ে হয়েছে। আমি স্বামীর সঙ্গে বিরাট এক বড়লোকের বাগানবাড়িতে একা থাকি। একা, কারণ আমার স্বামী বেচারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইয়ে চাকরির সন্ধানে ঘুর ঘুর করে। আমি থাকি একা। আমার সময় আর কাটে না। পুরোনো দিনের কথা ভাবি। তখন আপনার কথাও মনে। হয়। আপনি কি একদিন এসে আমাকে দেখে যাবেন? আমার বানানো এক কাপ চা খেয়ে যাবেন? আমাদের বাড়িটা শহর থেকে দুরে। বাড়ির নাম নীলা হাউস। আপনার একটু কষ্ট হবে। দোহাই আপনার। যদি আসেন, গাড়ি নিয়ে আসবেন না। আমি চাই না লোকজন জানুক। বিশেষ করে আমার স্বামী জানুক। সব কিছু সবার জানতে নেই। চিঠির উল্টো পিঠে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলাম।
বিনীতা–
পারুল
চিঠি শেষ করে করে পারুলের মনে হল–চিঠি পড়ে পল্টু ভাই নাও আসতে পাবেন। একবার যদি সামান্যতম সন্দেহ জাগে তাহলে তিনি আসবেন না। বুদ্ধিমান মানুষেরা কখনো চান্স নেয় না। পল্টু ভাইকে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত করতে হবে। কাজেই পাল পুনশ্চ দিয়ে আবার লিখল—
পল্টু ভাই, আপনার কাছে আমার সামান্য আবদার আছে। আমার স্বামীর জন্যে একটা চাকরি জোগাড় করে দিন। আমরা খুব কষ্টে আছি।
এবারে পারুল নিশ্চিত হল। এখন আর সমস্যা হবে না। পল্টু ভাই ধরে নেবেন পারুল তাকে ডাকছে। ভালবাসায় অভিভূত হয়ে না, ডাকছে বিপদে পড়ে। এই সুযোগ তিনি নষ্ট করবেন না।
পারুল দ্বিতীয় চিঠি লিখতে বসল। ভেবেছিল দ্বিতীয় চিঠিটা তাহেরকে লিখবে। লিখতে গিয়েও লিখল না। দ্বিতীয় চিঠিটা তাহেরের অফিসের ম্যানেজার সাহেবকে লেখা যাক। শেষ চিঠিটা লিখবে তাহেরকে। সেই চিঠি তাহেরের মাথার কাছে বসে লিখবে না। অন্য ঘরে লিখবে। পারুল লিখছে–
ম্যানেজার সাহেব,
শ্রদ্ধাস্পদেষু।
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনাদের নীলা হাউসের সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যার হাতে–তাহের, তার স্ত্রী। আপনাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার। আমার সেই সুযোগ নেই বলে চিঠির আশ্রয় নিচ্ছি। এতে কোন বেয়াদবি হলে ক্ষমা করবেন।
আমার স্বামী ভীতু প্রকৃতির মানুষ। এত বড় একটা বাড়িতে ভয়ে অস্থির হয়ে সে বাস করে। তিনটি কুকুর এবং দারোয়ান কামরুল অবশ্যি আচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে সে এদেরও ভয় পায়। প্রায় সারারাত সে জেগে বলে থাকে। ভয়ে অস্থির হয়ে সে আমাকে নিয়ে এসেছিল। আমি আপনাদের বিনা অনুমতিতে কয়েকদিন থাকলাম। তারপর যখন শুনলাম আপনি খুব রাগ করেছেন, তখন সে আবার আমাকে আমার বড় চাচার বাড়িতে রেখে এল। কারণ সে আপনাকে ভয় পায়।
আমি তো আপনাদের কোন সমস্যা করছিলাম না। ভীতু স্বামীকে সঙ্গ দেবার জন্যে তার পাশে ছিলাম। আমাদের যে ছোট্ট ঘর দেয়া হয়েছিল আমি সেখানেই থাকতাম। আপনাদের ইন্দ্রপুরী আমি নোংরা করিনি বরং সাধ্যমত তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের দুজনকে আলাদা করে দিয়ে আপনার কি কোন লাভ হয়েছে? কোন লাভ হয়নি। মাঝখান থেকে আমরা দুজন কষ্ট পাচ্ছি।
ও আপনার খুব প্রশংসা করে। এর ধারণা আপনি একজন সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মযোগী পুরুষ। এমন একজন মানুষ অনেক কষ্ট বুঝবেন না তা তো হয় না। আপনি কি আপনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আরেকটু ভাববেন? আমাদের দুজনকে কিছুদিনের জন্যে একসঙ্গে থাকতে দেবেন?
বিনীতা–
পারুল
চিঠি দুটি সে আমে বন্ধ করল। তারপর সাবধানে খাট থেকে নামল। শেষ চিঠিটা সে এখন লিখবে। তাহেরের কাছে চিঠি। স্বামীর কাছে লেখা স্ত্রীর প্রথম পত্র। কি লিখবে সে এখনো জানে না। যা মনে আসে তাই লিখবে। শুরুটা কি করে করবে? প্রিয়তমেষু দিয়ে। না, তা ঠিক হবে না। যার অনেক প্রিয়জন থাকে, তারই থাকতে পারে একজন–প্রিয়তম। পারুলের একজনই প্রিয় মানুষ। এটা কি খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার না সে পুরো পৃথিবীতে একজন তার প্রিয় মানুষ?