তাহের এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কুকুর তিনটি গর্তের চারপাশে আবার ঘুরছে! ওরা কি কিছু আঁচ করতে পারছে?।
পারুল বলল, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে নাকি?
হুঁ।
তাহলে চল শুয়ে পড়ি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনিকক্ষণ গল্প করি। তোমার তো আবার বিশ্রী অভ্যাস–বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম। আজ কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত আমরা গল্প করব। দুজনে মিলে আমাদের বাবুর নাম ঠিক করব।
কুকুর তিনটা গর্তের চারপাশে ঘুরছে কেন?
কে জানে কেন? নতুন কিছু দেখেছে–কাজেই ঘুরে ঘুরে দেখছে। কুকুরের মনের কথা তো জানার উপায় নেই। চল ঘুমুতে যাই।
তাহের নিঃশব্দে নেমে এল।
বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমে তাহেরের চোখ জড়িয়ে আসে–আজ আসছে না। খাটের পাশে সাইড টেবিলে পারুল টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে। ল্যাম্পের আলো চোখে লাগছে। পারুলের হাতে নাম-এর বই। পারুল শান্ত গলায় বলল, আমি নামগুলি পড়ে যাব–প্রথম পড়ব মেয়েদের নাম, কারণ আমার ধারণা আমাদের প্রথম বাচ্চাটি হবে মেয়ে। তুমি চুপচাপ শুনে যাবে। যখনই কোন নাম পছন্দ হবে তখনি বলবে, স্টপ। নামের সঙ্গে সঙ্গে আমি অর্থও বলব। ঠিক আছে?
তাহের কোন উত্তর দিল না। তারা আজ আবার মেসবাউল করিম সাহেবের মূল শোবার ঘরে শুয়েছে। এই ঘরটার ভেতর দম বন্ধ করা কিছু আছে। তাহেরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসকষ্টের মত হচ্ছে।
পারুল বলল, প্রথম শুরু করছি আ দিয়ে–
আজরা–কুমারী
আতিয়া—দানশীল
আসিয়া—স্তম্ভ
আদিবা—শিষ্টাচারী
আতিকা–সুন্দরী
আরজু–ইচ্ছা
আনান—মেঘ
আনিকা–রূপসী
আসমা–অতুলনীয়।
কি ব্যাপার, এর মধ্যে একটাও তোমার পছন্দ হল না? আমার তো এর মধ্যে একটা পছন্দ হয়ে গেছে–আনান। আনান মানে কি বল তো? একটু আগে বলেছিলাম। কি, বলতে পারছ না?
না।
আনান মানে হচ্ছে–মেঘ। সুন্দর না নামটা?
তাহের বলল, আমার কেন জানি দম বন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
নিঃশ্বাস নিতে পারবে না কেন? নিঃশ্বাস নিতে পারছ। জব ভালভাবেই পালছ। তুমি নানা কিছু ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে। অস্থির হবার কিছু নেই। মানুষ বর্তমানে বাস করে–অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না। এই কথাটা তো তোমাকে আগেও বলেছি। বলিনি? আমাদের বর্তমানটা কি খারাপ যাচ্ছে? না, খারাপ যাচ্ছে না, ভালই যাচ্ছে। আরাম করে কত বড় একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমাদের পাহারা দিচ্ছে তিনটি ককল। এরা কাউকে আমাদের কাছে আসতে দেবে না। এরচে ভাল আর কি হতে পারে বল?
আমার সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কি কালে তোমার বন্ধ দম খুলবে?
জানি না।
যখন জান না তখন চুপ করে শুয়ে থাক–আমি নাম পড়ে যাচ্ছি–তুমি নাম সিলেক্ট কর। প্রাথমিকভাবে আমরা কিন্তু একটা নাম সিলেক্ট করে ফেলেছি–আনান। আনান মানে কি বল তো?
জানি না।
ওমা–একটু আগে না কললাম–মেঘ।
তাহের হঠাৎ ভয়ংকর রকম চমকে উঠল। বাইরে থেকে বিশ্রী বিকট রক্ত জমাট করা শব্দ আসছে। তাহের বিছানায় উঠে বসল। সে থর থর করে কাঁপছে। তার কপালে ঘাম জমেছে। সে আতংকিত গলায় বলল, কি হচ্ছে পারুল?
কুকুর কাঁদছে। জোছনা দেখে কাঁদছে।
আলো তে কখনো কাঁদত না।
এরকম জোছনা আগে তো কখনো হয়নি–এ জন্যে কাঁদেনি। কিংবা হয়ত কেঁদেছে, তুমি ঘুমুচ্ছিলে বলে শুনতে পাওনি।
কামরুলের জন্যে কাঁদছে না?
তার জন্যেও কাঁদতে পারে। এতদিন একটা মানুষ তাদের সঙ্গে ছিল, এখন নেই।
আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।
ভয়ের কিছু নেই। এক কাজ কর–আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক। আমি তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেব।
তাহের লরা গলায় বলল, পানি খাব।
সাইড টেবিলে পানির গ্লাস, ছগ ছিল। পারুল পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। কুকুর রক্ত হিম করা শব্দে ডেকেই যাচ্ছে। এখন তাদের কান্না–মানুষের কান্নার মত শুনাচ্ছে। যেন শত বছর বয়েসী তিন খুনখুনে বুড়ো হাপড়ের মত শ্বাস টানতে টানতে কেঁদে যাচ্ছে। তাহের বলল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। জানালা খুলে দাও।
জানালা খোলাই আছে।
খুব খারাপ লাগছে।
পারুল বলল, তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক। ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি। গায়ের উপর চাদর টেনে শুয়ে থাক। শীত শীত ভাব থাকলে ভাল ঘুম হয়। আজ হঠাৎ করে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে না?
হুঁ।
দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। দূরে বৃষ্টি হলে–যেখানে বৃষ্টি হয় সেখানটা ঠাণ্ডা হয় না, কিন্তু আশেপাশের জায়গাগুলি ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
আনান নামটা কি পছন্দ হয়েছে?
তাহের তার জবাব না দিয়ে বলল, কুকুরগুলি কতক্ষণ কাঁদবে?
যতক্ষণ চাঁদ দেখা যায় ততক্ষণই কাঁদবে।
তাহের শুয়েছে। পারুল বলল, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?
হুঁ।
হুঁ আবার কি? দেব কি দেব না সেটা বল।
তাহের পাশ ফিরল। কুকুর তিনটা এখনো ডাকছে। কুকুরের ডাক শুনতে শুনতেই তাহের ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ় ঘুম। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় কিছু কিছু মানুষের গাঢ় নিদ্রা হয়।
পারুল উঠে দাঁড়াল। চিঠিটা লিখে ফেলা দরকার। কাগজ এবং কলম খুঁজে বের করতে হবে। এ বাড়িতে কোথাও না কোথাও কাগজ-কলম নিশ্চয়ই আছে। সবগুলি ঘর পারুল খুলে দেখতে পারেনি। তার কাছে চাবির গোছ আছে। চাবিগুলির নম্বর—টম্বর কিছু দেয়া নেই। ট্রায়াল ও এরার মেথডে ঘর খুলতে হয়। প্রতিবারই অনেক সময় লাগে। এখন থেকে সে একটা কাজ করবে–যে ঘর খুলবে, সে ঘর আর বন্ধ করবে না। ঘর খোলাই থাকবে।
কাগজ-কলম পাওয়া গেছে। শুধু কাগজ-কলম না, থাম, পোস্টাল ট্রাম্প, গাম, কাঁচি! বড়লোকের সবকিছু খুব গোছানো থাকে। আর গরীবদের থাকে সব এলোমেলো। খাম পাওয়া গেলে কাগজ পাওয়া যায় না। কাগজ পাওয়া গেলে কলম পাওয়া যায় না।