তিনি রাগী চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। দারোয়ান মাথা চুলকাতে কবে। তখন ড্রয়িং রুমে খুট করে শব্দ হবে। তিনি বলবেন না–ড্রয়িং রুমে কে? রোয়ান সে কথার জবাব না দিয়ে আরো দ্রুত মাথা চুলকাতে থাকবে।
মেসবাউল করিম সাহেবের কাছে চাবি আছে, তিনি সেই চাবি দিয়ে ড্রয়িং রুমের প্রজা খুলে দেখবেন অত্যন্ত পিবতী একটি মেয়ে রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। গর ল্যাম্পের আলোয় তাকে পরীর মত দেখাচ্ছে। মেয়েটার গায়ে কাপড়ও বেশি ই। শুধু একটা শাড়ি। ঘুমুবার সময় সে শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরতে পারে না। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, হু আর ইউ? তুমি কে?
আমি পারুল।
পারুল। পারুল কে? তুমি এখানে কি করছ?
দোল খাচ্ছি।
দোল থাছি মানে কি?
আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করছি না। আপনার রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছি। আর বাতিগুলি শুধু জ্বালিয়ে রেখেছি।
তুমি কে? তুমি আমার বাড়িতে ঢুকলে কি করে?
এত চেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন? আমার স্বামী ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেলে ও খুব করে।।
স্বামী-সংসার নিয়ে উঠে এসেছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার স্বামী?
ওর নাম তাহের। আপনার গ্রাম সম্পর্কের চেনা মানুষ। আপনি যখন দেশের রে যান তখন ওকে বলেন মাঝে মাঝে আপনার বাড়ি পাহারা দিতে। ও হচ্ছে একজন পাহারাদার। ভদ্র ভাষায় কেয়ারটেকারও বলতে পারেন। বছরে এক মাস দু মাস সে আপনার বাড়ি পাহারা দেয়। বিনিময়ে প্রায় কিছুই পায় না। তারপরও হাসিমুখে পাহারা দেয় এই আশায় যে, একদিন আপনি তাকে কোন একটা সুবিধা করে দেবেন। কোন একটা চাকরি জোগাড় করে দেবেন। ও বেকার। এখন কি আপনি ওকে চিনতে পেরেছেন? সুন্দর মত চেহারা। লম্বা, মাথা ভর্তি চুল। সুন্দর হলে কি হবে—মাকাল ফল। কোন কাজের ফল না। চিনতে পারলেন?
হ্যাঁ। কিন্তু ও যে বিয়ে করেছে তা তো জানতাম না।
ওর বিয়ে তো এমন কোন বড় ব্যাপার না যে আপনার মত মানুষ জানবে। গরীব মানুষের আবার বিয়ে কি? আমরা বিয়ে করেছি কাজির অফিসে। আমাদের বিয়েতে কত খরচ হয়েছিল জানেন? সর্বমোট খরচ হয়েছে তিনশ একুশ টাকা। তারপরেও তাহের মুখ কালো করে বলেছে–ইস, এতগুলি টাকা চলে গেল।
তোমার এইসব কেচ্ছা কে শুনতে চাচ্ছে?
আহা, একটু শুনুন না। কেউ তো শুনতে চায় না। বিয়ের পর কি ঘটনা ঘটল শুনলে আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। আমাদের গোপন বিয়ের ছবির পরদিন রাত। দশটার দিকে জানাজানি হয়ে গেল। আমি থাকি বড়চাচার সঙ্গে। তিনি হাউই বাজির মত লাফালাফি করতে লাগলেন। কি রাগ! তারপর তিনি করলেন কি জানেন–চাচীকে বললেন–লাথি দিয়ে হারামজাদীকে বের করে দাও। আমাকে রাত এগারোটায় সত্যি সত্যি বের করে দিল। আচ্ছা, গল্পটা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে? ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছেন কেন?
তুমি আমার বাড়িতে এসে জুটলে কি করে?
ও এনে তুলেছে। ওর একা একা থাকতে খারাপ লাগে, তাই নিয়ে এসেছে। নতুন বিয়ে তো, বৌকে সব সময় কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। এর মত অবস্থায় পড়লে আপনিও তাই করতেন। ভাল কথা, আপনার স্ত্রীর নাম কি?
আমার স্ত্রীর নাম দিয়ে তোমার দরকার নেই। তাহের কোথায়?
একটু আগেই না আপনাকে বললাম, ঘুমুচ্ছে। পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। ডাকব?
তোমরা কি আমার বেডরুমে ঘুমুচ্ছ?
ছি না। আপনার বেডরুম তালাবন্ধ। তালা খোলা হয়নি। এখন ঘুমুচ্ছি গেস্টরুমে। একতলায় আপনি যে ঘরে ওকে ঘুমুতে বলেছিলেন ও সেখানেই থাকত। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন ঐ ঘরের ফ্যানটা নষ্ট। ও আবার গরম সহ্য করতে পারে না। কাজেই আমরা দোতলায় গেস্টরুমে চলে এসেছি। ওর খুব ইচ্ছা ছিল গেস্টরুমের এসিটা চালানোর। চেষ্টাও করেছে। চলে না। আচ্ছা, আপনার গেস্টরুমের এসিটা কি নষ্ট?
গেস্টরুম তো তালাবন্ধ ছিল, তোমরা ঢুকলে কি করে?
আমি তালা খুলেছি। কি ভাবে খুলেছি জানেন? চুলের কাটা দিয়ে। চুলের কাটা দিয়ে তালা খোলায় আমি একজন বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের যে কোন চোরের দল আমার এই প্রতিভার খবর পেলে আমাকে তাদের দলে নিয়ে নিত।
ঢং ঢং করে দুটা ঘন্টা পড়ল। গ্রান্ডফাদার ক্লকে দুটা বাজার সংকেত দিচ্ছে। পারুল চমকে উঠল। মনে হল ঘণ্টাগুলি ঠিক বুকের মধ্যে পড়েছে। অবিকল পরীক্ষার হলের ঘন্টার মত। আশ্চর্য, ঘণ্টার শব্দ থেমে যাচ্ছে না, ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে। টননননন শব্দ হচ্ছেই। এরকম তো কখনো হয় না। আজ হচ্ছে কেন? ঝাড়বাতিটাও দুলছে। আগে তো দুলেনি। ঘরে এত আলো। দিনের মত চরিদিক ঝক ঝক করছে, তারপরেও তীব্র ভয়ে পারুল অস্থির হয়ে গেল। ভয়ের আসল কারণ ঘণ্টার শব্দ না, ঝাড়বাতির দুলুনিও না–আসল কারণ হচ্ছে পারুলের মনে হচ্ছে মেসবাউল করিম নামের ঐ ভদ্রলোক সত্যি সত্যি চলে এসেছেন। একা আসেননি, পুলিশ নিয়ে এসেছেন। পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেবেন। পুলিশ তাদের কোন কথাই শুনবে না–সরাসরি জেলখানায় ঢুকিয়ে দেবে। কখন ছড়িবে কে জানে? যদি সাত-আট মাস রেখে দেয় তাহলে তো সর্বনাশ। তখন বাবুর পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে যাবে। তার জন্ম কি জেলখানায় হবে নাকি? তাদের যেন জেলখানায় না দেয়া হয় এই ব্যবস্থা করতে হবে। পারুল বলল–
আমরা যে আপনার গেস্টরুম দখল করে বসে আছি তার জন্যে কি আপনি রাগ করেছেন?
রাগ করারই তো কথা।
প্লীজ, রাগ করবেন না। আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না। যদি না দেন তাহলে…।