তোমার গা গরম। জ্বর এসেছে?
বোধ হয়।
পারুল বলল, জ্বরের আমি একটা খুব ভাল চিকিৎসা জানি। এক্ষুণি সেই চিকিৎসা করা হবে– দেখলে কোথায় পালিয়েছে জ্বর।
পারুল সহজ স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে। যেন কিছুই হয়নি, সব আগের মত আছে। তাহের পারুলের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকল। কুকুর তিনটা এখনো তাকিয়ে আছে।
বাথরুমে তোমার জন্যে গরম পানি দিচ্ছি। আরাম করে গা ডলে গোসল কর।
জ্বর-গায়ে গোসল করব?
জ্বর-গায়ে গোসলই হচ্ছে জ্বরের অষুধ। একে বলে জল-চিকিত্সা। তুমি কি তোমাদের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেছ?
হুঁ।
উনি কিছু বলেছেন
না।
কিছুই বলেননি?
কি কি যেন বলেছেন–ভুলে গেছি।
ভুলে যাওয়াই ভাল। পৃথিবীতে সবচে সুখী মানুষ কারা জান? যারা দ্রুত সব ভুলে যেতে পারে তারা। যারা কিছুই ভুলতে পারে না তারা দারুণ অসুখী। আজ রাতের খাওয়া কিন্তু খুব সাধারণ–শুধু ডাল আর ভাত। ঘরে যে কোন বাজার নেই তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কাল বাজার করে দেবে।
আচ্ছা।
নিকি, ফিরো, মাইক এদের মাংস আনতে হবে।
আচ্ছা।
আজ সারাদিন কি করলে? মনে আছে না ভুলে গেছ?
পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়েছি।
এই তো একটা কাজের কাজ করছে। বেঞ্চিতে না ঘুমিয়ে গাছের নিচে ঘুমালে আরো মজা হত। ছেলে হয়ে জন্মানোর অনেক সুবিধা। যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পার। তুমি কি গোসলের পর এক কাপ চা খাবে? ঘরে সামান্য চা-চিনি আছে।
গোসল করব না।
অবশ্যই করবে। গোসলের পর পর দেখবে শরীরের জং পরা ভাব সেরে যাবে।
পারুলের কথাই ঠিক। গোসলের পর তাহেরের শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল। মাথায় চাপা যন্ত্রণা ছিল, সেটিও সেরে গেল। আরাম করে ভাত খেল। ডালভাতি তবে তার সদে শুকনো মরিচ পড়িয়ে পেয়াজ মেখে একটা ভতার মত বানিয়েছে। আগুনের মত ঝাল–কিন্তু খেতে অসাধারণ। পারুল খাওয়ার মাঝখানে হঠাৎ বলল, তুমি কি কাল আমাকে একটা কাজ করে দেবে?
-কি কাজ?
আমি একটা চিঠি লিখে রেখেছি–একজনকে পৌঁছে দিতে হবে। পারবে না?
হুঁ, পারব।
কি লিখেছি সেই চিঠিতে জানতে চাও না?
তাহের কিছু বলল না। পারুল চোখ বড় বড় করে বলল, কার কাছে চিঠি লিখলাম, কি ব্যাপার কিছুই জানতে চাও না?
তুমি বললেই জানব। না বললে জানব কিভাবে?।
পল্টু ভাইকে একটা চিঠি লিখেছি। ভাল নাম মনে নেই। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এই সব নিয়ে তিনি সব সময় খুব ব্যস্ত থাকেন। বাচ্চাদের নিয়ে তার একটা সংগঠন আছে–কিশোর মেলা।
ও অচ্ছি।
বিরাট একটা ফার্মেসী আছে। টুকটাক ব্যবসা আছে। ফার্মেসীটা কোথায় আমি জানি–তোমাকে বলে দেব–খুঁজে বের করে তাকে চিঠিটা দেবে।
আচ্ছা।
তোমার মাথা ধরা কমেছে, না?
হুঁ।
চল, খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা এই বাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়াব।
কেন?
কেন আবার কি? মানুষ বেড়ায় কেন? আজ জোছনা আছে–ছাদ থেকে জোছনা দেখতে খুব ভাল লাগবে।
ঘুম পাচ্ছে তো।
ঘুম পেলে স্থানে ঘুমিয়ে পড়বে। সঙ্গে করে চাদর নিয়ে যাব, বালিশ নিয়ে যাব। চল এক কাজ করি–দুজনেই ছাদে ঘুমুব।
তাহের ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ পড়ল বাড়ির পেছনের বাগানে–বেশ বড়সড় একটা গর্ত। গর্ত নতুন করা হয়েছে। মাড়ি স্তূপ হয়ে আছে। মাটির পাশে কোদাল পড়ে আছে।
পারুল বলল, এত মন দিয়ে কি দেখছ?
তাহেরের বুক ধ্বক ধ্বক করছিল। সে আতংকিত গলায় বলল, ঐ খানে গর্ত কে করল?
আমি করেছি।
আমি করেছি মানে কি?
সারাদিন কিছু করার ছিল না–ভাবলাম, দেখি তো আমি গর্ত করতে পারি কি না। কোদাল দিয়ে কোপ দিয়ে দেখি মাটি মাখনের মতো নরম।
এই গর্ত তুমি করেছ?
এম্নি করেছি। গর্ত খোঁড়া তো অপরাধ না। বাংলাদেশের সংবিধানে কি কোথাও লেখা আছে গর্ত খোঁড়া যাবে না?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তাহের প্রায় কাদো কাঁদো গলায় বলল, পারুল, তোমার কিছু একটা হয়েছে। আমি তোমার পায়ে ধরছি–চল আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।
পারুল হালকা গলায় বলল, চলে তো যাবই। চির জীবনের জন্যে তো এখানে থাকতে আসিনি। যে অল্প কদিন আছি–ভালমত থাকি। দেখ কি সুন্দর চাঁদ।
তাহের চাঁদ দেখছে না, সদ্য খোঁড়া গর্তের দিকে ভয় ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
তুমি একা একা এত বড় গর্ত খুঁড়েছ?
বললাম না মাটি খুব নরম। ফ্লাওয়ার বেড় করার জন্যে আগেই বোধহয় কেউ মাটি খুঁড়ে রেখেছিল।
তাহের মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে। কুকুর তিনটাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। এর গর্তের চারপাশে একটা চক্কর দিল। থমকে দাঁড়িয়ে গর্তের দিকে তাকালো। তিনজন এক সঙ্গে উপরের দিকে তাকালো–কিছু খুঁজল, আবার হাঁটতে শুরু করল। পারুল বলল, কুকুর যে জোছনা পছন্দ করে না সেটা কি তুমি জান?
তাহের বলল, না।
ওরা জোছনা একেবারেই পছন্দ করে না। আজ পূর্ণিমা তো, দেখবে ওরা কি রকম ছটফট করবে। মাঝরাতে কি করবে জান?
না।
মাঝরাতে তিনজনই চাঁদের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করবে। কুকুরের কান্না তুমি কখনো মন দিয়ে শুনেছ?
না।
ভয়ংকর। না শোনাই ভাল। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
তাহের পকেটে হাত দিল। তার গা ঝিমঝিম করছে। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ঝিমঝিমানি হয়ত দূর হবে। পকেটে সিগারেট নেই। নিচে ফেলে এসেছে। পারুল বলল, আমি ঠিক করেছিলাম কুকুর তিনটার নাম বদলে বাঙালী ধরনের নাম রাখব। এখন ভাবছি সেটা ঠিক হবে না। ওরা তো আর দিশি কুকুর না। দিশি নাম ওদের পছন্দ হবে না। ঠিক না?
হুঁ।
ওদের বিদিশী নামই ভাল–নিকি, মাইক, ফিবো…।