নিকি মুখ তুলে তাকাল। চাপা শব্দ করল। পারুল বলল, এই তো লক্ষ্মী মেয়ে। আদব-কায়দা জানে। এখন থেকে তোমাদের আমি আদব-কায়দাও শেখাব। গান গাইতে পারলে গান গেয়ে শুনতাম। গান জানি না। কবিতা জানি না। একটা শুধু জানি–দুই বিঘে জমি–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সেই কবিতা তো তোমাদের আগে একবার শুনিয়েছি। এই কবিতাটি ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিলাম। আমাদের পাড়ায় একবার রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে। আমার সেখানে দুই বিঘে জমি কবিতা আবৃত্তি করার কথা। রোজ পল্টু ভাইদের বাড়িতে বিহার্সেল হত। চা-সিঙ্গারা খাওয়া হত। খুব মজা হত। আমার এত ভাল লাগত। শেষ পর্যন্ত আমি অবশ্যি রবীন্দ্র জয়ন্তীতে কবিতা আবৃত্তি করিনি। কেন শুনবে? আচ্ছা শোন–খবর্দার, কাউকে বলবে না। মানুষদের তোমরা বলতে পারবে না তা তো জানি, অন্য কুকুরদেরও বলবে না, কারণ খুব লজ্জার ব্যাপার। যেদিন রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে তার আগের দিন রাতে স্টেজ রিহার্সেল হবে। সেদিন আবার খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। হারিকেন জ্বালিয়ে রিহার্সেল হল। রিহাসেলের পর সবাই চলে যাচ্ছে, পল্টু ভাই আমাকে বললেন–পারুল, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তুই একা যাবি কি করে? তুই থাক, আমি পৌঁছে দেব। ড্রাইভার এক্ষুণি আসবে, তোকে নামিয়ে দেবে। আমি থেকে গেলাম–সবাই চলে গেল। পল্টু ভাই তখন একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড করল। মানুষেরা যে কি ভয়ঙ্কর কাণ্ড করতে পারে তোরা জানিস না, কারণ তোরা হলি পশু। মানুষের কত ভয়ঙ্কর তোরা জানবি কি করে? আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস? ঐ ভয়ঙ্কর কাণ্ডের পর পল্টু ভাই গাড়ি করে আমাকে বাসায় পোঁছে দিলেন। সহজ গলায় বললেন–কবিতা আবৃত্তির সময় তুই মাঝে মাঝে ফাম্বল করিস। কথা জড়িয়ে যায়। পরিষ্কার করে আবৃত্তি করবি। নো ফাম্বলিং।
তোদের সঙ্গে তো তখন পরিচয় হয়নি। তোদের বোধহয় তখন জন্মও হয়নি। তোরা যদি তখন আমার সঙ্গে থাকতি তাহলে অবশ্যই পলটু ভাইকে বুঝিয়ে দিতাম–দুই বিঘে জমি আসলে কতটুকু জমি।
পল্টু ভাই এখনো রবীন্দ্র শতবার্ষিকী, নজরুল জয়ন্তী এসব করে বেড়াচ্ছে। বিরাট ফার্মেসী দিয়েছে। ফার্মেসিীর নাম–উপশম। এইবার আমি তাকে উপশম শিখিয়ে ছাড়ব। সুন্দর করে পল ভাইকে একটা চিঠি লিখে এ বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ করব। উনি চিঠি পেয়ে দেরি করবেন না, সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবেন। এই সব লোক কখনো কোন সুযোগ নষ্ট করে না। আমি গেট খুলে উনাকে ঢুকাব। হাসিমুখে বলব, কেমন আছেন পল্টু ভাই?
উনি বলবেন, ভাল। আরে, তুই এত বড় হয়ে গেছিস। বিয়ে-টিয়ে করে একেবারে ঘরণী হয়ে গেছিস। তোকে তো দারুন লাগছেরে।
আমি বলব, সুন্দর হয়েছি, তাই না? ছোটবেলায় তো আর এত সুন্দর ছিলাম না। আমি যখন ছোট ছিলাম সেই সময়ের কথা কি আপনার মনে আছে?
উনি একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলবেন, কিসের কথা বলছিস?
ঐ যে রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে, ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল–আপনি আমাকে থেকে যেতে বললেন, তখন ছোট ছিলাম, কিছু বুঝতাম না–এখন আপনাকে সব জেনেশুনে ডেকেছি। আর আপনাকে ফিরে যেতে দেব না।
উনি অস্বস্তির সঙ্গে কথা ঘুরাবার জন্যে বলবেন–এত বড় বাড়ি, এটা কার?
তখন আমি বলব, আমার বাড়ি। আবার কার? ঐ মে কুকুর লি দেখছেন ওরাও আমার। গায়ে শাদা ফুটকি সেটার তার নাম–নিকি। ও হল মেয়ে। ও সবচে ভয়ংকর। মেয়েরা মাঝে মাঝে দারুণ ভয়ংকর হতে পারে, জানেন তো? নাকি জানেন না?
পল্টু ভাই ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলবেন। বুদ্ধিমান মানুষ তো। আঁচ করতে দেরি হবে না। আঁচ করে ফেললেও লাভ হবে না। ততক্ষণে আমি গেট বন্ধ করে দিয়েছি। হি হি হি।
তোদের তখন আমি ডেকে পাঠাব। তোরা এক সঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে পড়বি। পারবি না? কিংবা একজন ঝাঁপ দিয়ে পড়বি। বাকি দুজন তাকে ঘিরে চক্কর লাগাবি। নিকি তুই ঝাঁপ দিবি। তুই তো মেয়ে, তোর দায়িত্ব বেশি।
নিকি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাইক এবং কিবো লেজ নাড়ছে।
পারুল চাপা গলায় বলল, কাজটা শেষ হবার পর–তোদের আমি খুব সুন্দর করে দুই বিঘে জমি আবৃত্তি করে শোনাবো। নাকি এখনই শুনতে চাস?
নিকি, মাইক, কিবো তিনজনই একসঙ্গে লেজ নাড়ল। মনে হচ্ছে তারা শুনতে চায়। পারুল চাপা গলায় শুরু করল–
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সব গেছে ঋণে
বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।
কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভুমির অন্ত নাই
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়োজোর মরিবার মত ঠাঁই।
গেটে শব্দ হচ্ছে। তিনটি ককর এক সঙ্গে গেটের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। পারুল বলল–ও এসেছে। যা, তোরা খেলা কর গিয়ে। বাকি কবিতাটা অন্যদিন শুনাব। যা বললাম।
পারুল চাবি হাতে গেটের দিকে রওনা হল। গেটের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে না কে এসেছে। অন্য কেউও হতে পারে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে গেট খোলা যাবে না। তাহেরকে গেটে ধাক্কা দেবার একটা কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। পরপর তিনবার ধাক্কা দেবে থামবে তারপর দুবার দেবে।
তাহেরের গলা শোনা গেল, সে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকছে–পারুল। এই পারুল! গেট খোল।
পারুল গেট খুলল। তাহের বিব্রত গলায় বলল, দেরি করে ফেললাম।
না, দেরি কোথায়! এসো। আমার বই এনেই?
হুঁ।
চা আর চিনি?
ভুলে গেছি।
থাক। ভুলে গেলে কি আর করা–এসো, ঘরে চল। দাঁড়িয়ে আছ কেন?
তাহের হাত তুলে দেখাল। নিকি, ফিবো আর মাইক–এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তাদের চোখ জ্বল জ্বল করছে। পরুল বলল–ওরা তাকিয়ে আছে তো কি হয়েছে? এসো। পারুল তাহেরের হাত ধরল।