সোনালা রঙের লিপস্টিক আছে?
জ্বি আছে। দেখবেন?
একটু দেখান না—প্লীজ।
কিনবেন?।
দামে পুষলে কিনব। পঞ্চাশ-পাঁচপঞ্চাশ টাকার ভেতর যদি হয়।
সোনালী রঙের লিপস্টিকের দাম তেত্রিশ শ টাকা।
কত বললেন?
তেত্রিশ শ টাকা। তিন হাজার তিন শ–সঙ্গে একটা লাইনার আছে। লাইনারটার দাম আলাদা।
লাইনার কি?
পেন্সিলের মত একটা জিনিস। লিপস্টিক দেয়ার পরে লাইনার দিয়ে বর্ডারের মত দিতে হয়। তাহলে লিপস্টিক ছড়িয়ে যায় না।
লাইনারটার দাম কত?
আটশ। তবে লিপস্টিক আর লাইনার একসঙ্গে কিনলে চার হাজারে দেয়া যাবে।
তাহের হতভম্ব গলায় বলল, সত্যি বলছেন না ঠাট্টা করছেন?
দোকানী সহজ গলায় বলল–ঠাট্টার কোন ব্যাপার না। খদ্দেরের সঙ্গে ঠাট্টা করা যায় না।
আমি আপনার খদ্দের না। আমি কোনদিন এই জিনিশ কিনতে পারব না। ভাই, যদি কিছু মনে না করেন–সোনালী রঙের লিপস্টিকটা আমি দূর থেকে একটু দেখব। হাতও দেব না।
হাত দিন। হাত দিয়ে দেখতে অসুবিধা কি? এটা তো আর আগুন না যে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে।
তাহের গভীর আগ্রহে সোনালী রঙের লিপস্টিক হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে। সামান্য এতটুক একটা জিনিশ, ঠোঁটে লাগানো হয়–এর দাম তেত্রিশ শ টাকা।
ভাই, এই লিপস্টিকের বিশেষত্ব কি?
বিশেষত্ব কিছু না। নামী কোম্পানী র্যাভলন। নন স্টিক। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে চা খেলে চায়ের কাপে লিপস্টিকের দাগ লাগবে না।
চায়ের কাপে লিপস্টিকের দাগ পড়ে যায় এই তথ্যই তাহেরের জানা ছিল না। এই পৃথিবীতে কত কিছুই না আছে জানার।
কেউ কি এই লিপস্টিক কেন?
কেন কিনবে না? হরদম কিনছে। না কিনলে আমরা বাঁচব কি ভাবে?
ভাই, মেনি মেনি থ্যাংকস।
দুপুর হয়ে গেছে। মাথায় উপরে গনগনে সূর্য। এই রোদে বাসে করে রওনা হতে ইচ্ছা করছে না। পার্কের কোন বেঞ্চিতে ছায়ার মধ্যে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। আসলে বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছা করছে না। তারপরেও ফিরতে হবে–পারুল বেচারী একা আছে। না জানি কত ভয় পাচ্ছে। কি জানি সে কিনতে বলেছিল মনে পড়ছে না। জরুরী কথা মনে পড়ে না। শুধু অদরকারী কথা মনে পড়ে। তাহের হেঁটে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হল। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে–কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়বে কি-না।
তাহের বিকেল পর্যন্ত ঘুমালো। পাকের লম্বা বেঞ্চে শুয়ে দীর্ঘ সুম। আরামের ঘুম। অনেকদিন এত আরাম করে সে ঘুমায়নি।
তাহের ঘুম ভাঙার পর অবাক হয়ে দেখল তাকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড়। একজন পানওয়ালা, এই প্রচণ্ড গরমে সুয়েটার পরা এক বুড়ো লোক, মাস্তান টাইপ দুটা ছেলে। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, কি হয়েছে?
তাহের বেঞ্চিতে উঠে বসল। সে আরাম করে ঘুমুচ্ছিল। এর বেশি তো কিছু হয়নি। গায়ে জ্বর ছিল–টানা ঘুম দেয়ায় ঘরটা সেরে শেছে বলে মনে হয়। তাকে ঘিরে এই জটিলার কারণটা কি?
বুড়ো ভদ্রলোক ঝুঁকে এসে বললেন, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করছিলেন। তাহের বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, স্বপ্ন দেখছিলাম।
সে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত সরে পড়া উচিত। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, বই ফেলে যাচ্ছেন তো।
তাহের বইটা হাতে নিল। বইটা সে কিছুক্ষণ আগে কিনেছে এটা মনে করতে তার কিছুটা সময় নিল। আশ্চর্য, সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মস্তান ধরনের ছেলে দুটির একটি বলল, ব্রাদার, শরীর ঠিক আছে তো?
জ্বি, ঠিক আছে।
পার্কে এইভাবে ঘুমাবেন না। পকেট থেকে মানিব্যাগ হাপিস হয়ে যাবে। মানিব্যাগ পকেটে আছে?
জি, আছে।
তাহের হাঁটা ধরেছে। একবার পেছন ফিরল–লোকগুলো এখনো তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে কৌতূহল। ঘুমের মধ্যে সে এমন কি করেছে যে লোকগুলো এখনো তাকিয়ে আছে? সাধারণত ভয়ংকর কোন স্বপ্ন দেখলেই মানুষ চেঁচিয়ে উঠে। সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেনি। শান্তির একটা ঘুম ঘুমিয়েছে।
এখন কটা বেজেছে? তাহেরের হাতে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা থাকলে ভাল হত। ফিরতে ইচ্ছা করছে না। রাত হোক, সে রাতের অন্ধকারে ফিরবে। এমন ভাবে কবে যেন কেউ তাকে না দেখে। এতক্ষণ কি করবে? হাঁটবে রাস্তায় রাস্তায়? মন্দ কি?
ভদ্র হও নিকি
নিকি, তুমি কিন্তু দুষ্টামি করছ। ভদ্র হও নিকি। অন্যদের খেতে দাও। দেখ, তোমার জন্যে ফিবো খেতে পারছে না। এই তো লক্ষ্মী মেয়ে। মেয়েদের লক্ষ্মী হতে হয়। তুমি মেয়ে হয়ে ছেলে দুটিকে খেতে দিচ্ছ না, এটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা মেয়ে কি করি জান না? পুরুদের খাওয়া হয়ে গেলে তারপর খেতে বসি! ভাল ভাল খাবার পুরুষদের প্লেটে তুলে দিয়ে তারপর যা থাকে তাই সোনামুখ করে খেয়ে ফেলি। এটাই সাধারণ নিয়ম। মাইক, তোমার আর কি হল? দাঁত বের করে কাকে ভয় দেখাচ্ছ? লেজ মুলে দেব?
পারুল বড় একটা গামলায় কুকুরদের খেতে দিয়েছে। গরম গরম ভাত ডাল দিয়ে মাখানো। গোশত ছাড়া এরা কিছু খায় না। সারা দিনে এক বেলা খায়–হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করা মাংস। পুরোপুরি সেদ্ধ না–আধাসেদ্ধ। ঘরে মাংস নেই, তাহেরকে দিয়ে আনতে হবে।
ফিবো। তোমার সারা গায়ে কাদা লেগে আছে এটা কেমন কথা। নিকি আর মাইকের গায়ে তো কাদা লাগেনি। তুমি বুঝি কাদায় গড়াগড়ি করেছ? এখন যদি এক বালতি পানি তোমার গায়ে ঢেলে দি তাহলে ভাল হবে? কাল দুপুরে তোমাদের গোসল। করিয়ে দেব। সাবান মেখে ব্রাস ঢেলে দেব। বুঝেছ? আরেকটা কাজ করব–তোমাদের নাম বদলে দেব। ইংরেজি নাম আমার ভাল লাগে না। সুন্দর বাংলা নাম দেব। নামের বই ও আজ নিয়ে আসবে–সেই বই দেখে নাম রাখব। আচ্ছা, এই যে আমি এত কথা বলছি–ফিবো আর মাইক শুনছে–কিন্তু নিকি, তুমি কিছুই শুনছ না। এটা অভদ্রতা না?