তাহের উপহার আনেনি, ফুলও আনেনি। ভুলে গিয়েছিল। জন্মদিনের সেই উপহার আজ কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কিছু টাকা সঙ্গে আছে। লিপস্টিকের দাম কত সে জানে না–চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ টাকায় হলে কিনে ফেলা যায়। রিসেপসনিস্ট মেয়েটাকে কি সে জিজ্ঞেস করবে লিপস্টিকের দাম কত? রাগ করবে না তো আবার সুন্দরী মেয়েরা সব সময় রেগে থাকে। ব্যতিক্রম অবশ্যি আছে। যেমন পারুল কখনো রাগে না। সে রূপবতী এ কথাটা বোধহয় তার জানা নেই। জানলে সেও সারাক্ষণ রেগে থাকত।
রিসেপসনিস্ট মেয়েটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই শুনুন। তাহের তার দিকেই তাকিয়েছিল–সে চমকে উঠল।
আপনি কিছু বলবেন?
জ্বি-না।
কিছু বললেন না, তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মেয়েদের দিকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যে অভদ্রতা এটা কি আপনার জানা নেই? আজ তো নতুন না, আপনাকে আগেও বলেছি।
তাহের নিজের অজান্তেই বলল, আপনার কি অনেকগুলি সবুজ রঙের শাড়ি?
মেয়েটি হকচকিয়ে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তার মুখে কোন জবাব আসছে না। তাহের বলল, সুন্দর করে যে সাজে সে তো অন্যকে দেখাবার জন্যই সাজে। কাজেই মানুষজন যদি তাকে অবাক হয়ে দেখে তাতে রাগ করার কিছু নেই–বরং খুশি হওয়া উচিত।
জ্বরের ঘোরে বোধহয় তাহেরের মাথায় কিছু হয়েছে কিংবা কাল রাতের ভয়াবহ ঘটনার ফলও হতে পারে–কেমন সুন্দর কথার পিঠে কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটিকে কোণঠাসা করে–এক ধরনের আনন্দও সে পাচ্ছে।
রিসেপসনিস্ট মেয়েটি থমথমে গলায় বলল–আপনি কি এই অফিসে কোন কাজে এসেছেন?
জ্বি-না। আমি এখানে কাজ করি। আমি এই প্রতিষ্ঠানেরই একজন।
কই, আমি তো জানি না। কি কাজ করেন?
আমি দারোয়ান। বড় সাহেবের বাড়ি পাহারা দেই। উত্তরখানে উনার একটা বাড়ি আছে। আমি ঐ বাড়ির পাহারাদার। পাহারাদার শুনেই এমন ছোট চোখে তাকাবার দরকার নেই। ছোটবেলায় বই-এ পড়েননি–পৃথিবীর কোন কাজই ছোট না। আপনার কাজের যে মর্যাদা একজন গোর খোদকের কাজেরও একই মর্যাদা।
প্লীজ, আপনি আমাকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন। আর করবেন না।
জ্বি আচ্ছা–আর বিরক্ত করব না। ইচ্ছা থাকলেও করা যাবে না। আমাকে নিউ মার্কেটে বইয়ের দোকানে যেতে হবে–একটা বই কিনতে হবে। শিশুদের নামের উপর একটা বই–যেখানে নাম সব এলফাবেটিকেলী সাজানো থাকে–নামের অর্থ দেয়া থাকে। আমরা স্ত্রী বেবী এক্সপেক্ট করছেন–এখনো দেরি আছে। মেয়েরা বাচ্চার নাম-টাম নিয়ে আগেভাগেই চিন্তা করতে ভালবাসে।
রিসেপসনিস্ট মেয়েটি তীব্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার চোখে সামান্য হলেও ভয়ের ছায়া। ভয়ের এই ছায়াটি কি জন্যে তাহের পরতে পারছে না। তার এলোমেলো কথা বলার জন্যে? না-কি জ্বরে তার চেহারা অন্য রকম হয়ে গেছে সে জন্যে? ভয় পাওয়া মানুষকে আরো ভয় পাইয়ে দিতে ইচ্ছে করে। তাহেরেরও করছে, তবে সে বুঝতে পারছে না–ঠিক কি করলে মেয়েটা আরো ভয় পাবে। তাহের হাই তুলল। সুন্দরী মেয়েদের সামনে কোন পুরুষ কখনো হাই তুলে না। তাহের তুলছে। কারণ মেয়েটিকে এখন আর তার তেমন সুন্দর লাগছে না। তাহের সহজ গলায় বলল–যাই, পরে কথা হবে। দারোয়ানের সঙ্গে অনেক কথা বলায় আপনি যদি মনে করে থাকেন আপনার সম্মানহানি হয়েছে, তাহলে ভুল করবেন–আমি দারোয়ান হলেও শিক্ষিত দারোয়ান। এম. এ. পাশ। জিওগ্রাফী। এম. এ. অনার্স, দুটাতেই থার্ড ক্লাস, এই জন্যে কলেজে চাকরি হল না। প্রাইভেট কলেজেও লেকচারার-এর চাকরির জন্য অনার্স এম. এ.-এর একটাতে মিনিমাম সেকেন্ড ক্লাস লাগে। যাই, কেমন?
মেয়েটি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তাহেরের মাথা ঘুরছে। বুক জ্বালা করছে। মুখে টুক টুক ঝঝ। এসিডিটি নিশ্চয়ই। কিছু খাওয়া দরকার। খিদে হচ্ছে না–খাবে কি? খিদে হলে অফিস কাটিনে ঢুকে একটা সিঙারা খেয়ে নিত। নিউ মার্কেটে বই কেনার পর কয়েকটা চক্কর লাগালে খিদে হতে পারে।
বইয়ের দাম ত্রিশ টাকা। দোকানদার পাঁচ টাকা কমিশন দিল। না চাইতেই দিল। না চাইলে এই যুগে কেউ কমিশন দেয় না। বইয়ের দোকানদার দিয়েছে। তাহের তার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, ভাই, মেনি মেনি থ্যাংকস। আমি দরিদ্র মানুষ তো–পাঁচটা টাকা আমার কাছে পাঁচশ টাকার মত।
আপনার কি শরীর খারাপ?
জ্বী, শরীর খুবই খারাপ। বলতে গেলে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজেছি। রাতেই জ্বর এসেছে।
বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকেন।
তাই করব। এক্ষুণি রওনা দেব–বাড়ি অবশ্যি শহরের বাইরে। যেতে যেতে দুঘণ্টা লাগবে। ভাই যাই। এগেইন মেনি মেনি থ্যাংকস।
তাহের সরাসরি বাড়ির দিকে রওনা হল না। নিউমার্কেটে দুটা চক্কর দিল। আরো কি যেন তার কেনার কথা। মনে পড়ছে না। মনে করার জন্যে চক্কর দেয়া। পারুল বই ছাড়াও আরো কি যেন কিনতে বলেছে। সেটা কি? লিপস্টিক? না, লিপস্টিক না। লিপস্টিকের কথা কেউ তাকে বলেনি— এটা তার নিজের মাথায় এসেছে। আচ্ছা, লিপস্টিকের খোঁজটা নিয়ে গেলে হয় না? তাহের জমকাল করে সাজানো একটা দোকানে ঢুকে পড়ল।
ভাই, আপনাদের কি লিপস্টিক আছে?
আছে। কোন কোম্পানীর, কি রঙ?
যে কোন কোম্পানীর হলেই হবে।
রঙটা কি?
সবুজ রঙ।
সবুজ রঙ?
জ্বি সবুজ। গাঢ় সবুজ–কলাপাতার মত সবুজ।
সবুজ রঙের লিপস্টিক হয় না।
লাল ছাড়া অন্য কোন রঙের হয় না?
হবে না কেন? হয়। মেরুন আছে, মেটে রঙ আছে, হালকা ব্লু আছে, কালো আছে–সোনালী আছে।