তাহের মন্ত্রের মত বলল, তুমি সত্যি মাটি খুঁড়তে যাবে?
পারুল সহজ গলায় বলল, হুঁ।
তোমার যেতে হবে না। আমিই যাব। কুকুর তিনটা তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওরা বাঁধা আছে।
কে বাঁধল?
আমিই বাধলাম, আবার কে।
কোদল কোথায় আছে বললে?
পারুল আঙ্গুল তুলে দিক দেথল। তাহের উঠে দাঁড়াল। নাক জ্বালা করছে। নাক জ্বালা করছে কেন? সে অজ্ঞান টান হয়ে যাবে না তো? অজ্ঞান হবার আগে কি মানুষের নাক জ্বালা করে?
পারুল বলল, বৃষ্টি দেখি আরো জোরে নামল। তুমি এক কাজ কর–খালি গায়ে যাও। শার্ট গায়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে। ভেজা কাপড় থেকে ঠাণ্ডা বেশি লাগে। আমি কি আসব তোমার সঙ্গে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকব?
না।
তাহের টলতে টলতে এগিয়ে যায়।
অসুখ-বিসুখ
রহমান সাহেব বললেন, তোমার কি অসুখ-বিসুখ?
তাহের নিচু গলায় বলল, জ্বি-না স্যার। ঠাণ্ডা লেগেছে।
চোখ টকটকে লাল, ঠাণ্ডায় চোখ লাল হয় নাকি?
তাহের ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল। কিছু একটা বলা উচিত–কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার গায়ে জ্বর আছে সে বুঝতে পারছে–সব কেমন হলুদ হলুদ লাগছে।
রহমান সাহেব বললেন, কাল তোমার ওখানে যাব বলে ভেবেছিলাম–বৃষ্টি-টৃষ্টি দেখে আর যাইনি। তোমার স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছ তো?
জ্বি স্যার। ওর বড় চাচার বাসায় দিয়ে এসেছি।
গুড। ভেরী গুড।
একা একা থাকতে খারাপ লাগে তো, এই জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। অন্যায় হয়েছিল। কিছু মনে করবেন না স্যার।
নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে রাখবে এতে অন্যায় কি? কমপ্লেইন হচ্ছিল। স্যারের কানে গেলে স্যার রাগ করতে পারেন এই জন্যেই, অন্য কিছু না।
আমি বুঝতে পারছি স্যার।
ঠিক আছে, তুমি যাও। ও আচ্ছা শোন, কি একটা জরুরী কথা বলতে চাচ্ছিলাম–ভুলে গেলাম। ঠিক আছে মনে হলে বলব।
আমি কি স্যার ঘন্টাখানিক পরে আসব?
কেন?
কথা যেটা ভুলে গিয়েছিলেন সেটা যদি মনে পড়ে!
আসতে হবে না। এমন কিছু জরুরী কথা না। জরুরী কথা হলে মনে থাকত।
চলে যাব স্যার?
হ্যাঁ। বাড়ি-ঘর ঠিক-ঠাক রাখবে।
অবশ্যই স্যার। এর মধ্যে কি আপনি একবার আসবেন?
আসব। বাড়িটা রঙ করাতে হবে। র মিস্ত্রীকে নিয়ে এসে এস্টিমেট করাতে হবে।
কবে আসবেন স্যার?
দিন-তারিখের দরকার কি, চলে যাব এক সময়। ও আচ্ছা, কথাটা মনে পড়েছে–কামরুলের খবর কি?
তাহেরের বুক ধ্বক করে উঠল–মনে হল সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কামরুলের খবর কি? এই প্রশ্নের উত্তরে সে কি বলবে?
তাহেরকে কিছু বলতে হল না। রহমান সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, কুকুর তিনটাকে ইনজেকশন দেয়ার জন্যে তার নিয়ে যাবার কথা–আমি ইনজেকশন আনিয়ে রেখেছি–সে আসছে না কেন? সব সময় এ রকম করে। একবারের জায়গায় দশবার বলতে হয়। ওকে খবর দেবে।
জ্বি আচ্ছা।
স্যার চিঠিতে জানতে চেয়েছেন ইনজেকশন দেয়া হয়েছে কি না। এক সপ্তাহ আগে তাকে বলেছি, আশ্চর্য, এমন গাফিলতি। তুমি তাকে কালই আসতে বলবে।
জ্বি বলব। তবে কাল বোধহয় আসতে পারবে না। জ্বর হয়েছে। বিছানায় শুয়ে আছে দেখলাম। কাছে অবশ্যি যেতে পারি নাই। কুকুরগুলির কারণে কাছে যেতে ভয় লাগে। কোন দিন এরা আমাকে মেরে ফেলে কে জানে।
রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও। তাহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বের হয়ে এল। জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে। মাথা ঘুরছে। সকালে সে নাশতা না খেয়ে বের হয়েছে। পারুল নাশতা বানিয়েছিল–রুটি, আলু ভাজা। তার খেতে ইচ্ছে করেনি। তার ঘর থেকে বেরুতেও ইচ্ছা করেনি। পারুলই তাকে প্রায় জোর করে বাইরে পাঠিয়েছে। সহজ গলায় বলেছে–এই বাড়িতে থাকলেই তোমার আরো খারাপ লাগবে। গত রাতের কথা মনে পড়বে। তুমি বরং ঘুরে টুরে আস। সন্ধ্যাবেলা যখন ঘরে ফিরবে দেখবে আগের মত খারাপ লাগছে না।
কোথায় ঘুরব?
অফিসে যাও। সবার সঙ্গে গল্প-টল কর। যত গল্প করবে তত দ্রুত তুমি সহজ হবে। তাতে মাথা থেকে রাতের ব্যাপারটা চলে যাবে।
তুমি একা থাকবে?
একা কোথায়? আমার কুকুর তিনটা আছে না? আমি ভালই থাকব, আমার কোন সমস্যা হবে না–তুমি আসার সময় কিছু চা-পাতা নিয়ে এসো। চা-পাতা, আরেকটা বই–শিশুদের নামের বই। বাচ্চাদের নাম রাখার এখন সুন্দর সুন্দর বই পাওয়া যায়। এলফাবেটিকেলী সাজানো। বই-এ নাম, নামের অর্থ সব দেয়া থাকে। মনে থাকবে?
হুঁ, থাকবে।
চা-পাতা আনতে যদি ভুলেও যাও–বই আনার কথাটা কিন্তু ভুললে চলবে না।
তাহের ভুলেনি–তার মনে আছে। তার শরীর খারাপ, মাথা ঘুরছে, গায়ে জ্বর, তারপরে সবকিছুই তার মনে আছে। সে ম্যানেজার রহমান সাহেবের ঘর থেকে লবীতে চলে এল। রিসেপসনিস্ট মেয়েটি আজও সবুজ শাড়ি পরেছে। সম্ভবত তার অনেকগুলি সবুজ শাড়ি। মেয়ে শাড়ির রঙ মিশিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়–সবুজ রঙের লিপস্টিক কি পাওয়া যায়? নিশ্চয়ই যায়। সে তো আর খোঁজ-খবর করে না। খোঁজ-খবর করলে দেখত দোকান ভর্তি সবুজ বরে লিপস্টিক। আজ যখন বইমের দোকানে যাবে তখন সে লিপস্টিকের দোকানে খোঁজ করবে। কিনতে পারবে না, টাকা নেই। দামটা শুধু জানবে। দোকানদার বিরক্ত হবে। ওরা আবার চট করে ধরে ফেলে কে কিনতে এসেছে আর কে শুধু দরদাম করতে এসেছে।
হঠাৎ তাহেরের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল–তার মনে পড়ল এখন পর্যন্ত সে পারুলকে কোন উপহার দেয়নি। কোন কিছুই না। এর মধ্যে তার একবার জন্মদিন গেল। তারা তখন সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় থাকে। সকালবেলা পারুল বলল, বুঝলেন জনাব, আজ আমার জন্মদিন। আজ অবশ্যই আমার জন্যে কয়েকটা গোলাপ ফুল কিনে আনবেন। বেশি আনার দরকার নেই–যা দাম। দুটা আনলেই হবে। খবর্দার, উপহার-টুপহার আবার আনতে যাবেন না।