চা-টা ভাল হয়েছে পারুল।
সরে বোস, বৃষ্টির ছাট লাগছে।
তাহের সরে বসল। পারুল বলল, ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এতে একটা লাভ হল। রক্ত ধুয়ে মুছে চলে গেল। এখন বাকি শুধু ডেডবডি মাটিতে পুঁতে ফেলা।
তাহের এমন ভাব করল মেন কথা শুনতে পাচ্ছে না। কথা শুনলেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। পারুলের পাগলামী আরো বাড়বে। এই পাগলামীকে কোন অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।
পারুল চুক চুক করে চা খাচ্ছে। এরকম শব্দ করে সে তো কখনো খায় না। নাকি আগেও এরকম শব্দ করেই খেতো? সে লক্ষ্য করেনি। পারুল হালকা গলায় বলল, বৃষ্টি কমবে না। তোমাকে বৃষ্টির মধ্যেই কাজটা করতে হবে।
তাহের হতভম্ব গলায় বলল, কি কাজ?
গর্ত করতে হবে। বাগানে কোদাল আছে। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি হয়েছে নরম। তোমাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
মোটেই পাগল হইনি। গর্ত খুঁড়ে ডেডবড়ি চাপা না দিলে কুকুর ছিঁড়ে খুড়ে খাবে। সেটা ভাল হবে? কাল তুমি যখন ঘর থেকে বের হবে তখন দেখবে দরজার কাছে কামরুলের হাতের কব্জি পড়ে আছে। তখন কেমন লাগবে?
আমাদের পুরো ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ যা করার করবে। আমরা কিছুই করব না। রাতটা কোন মতে পার করে পুলিশের কাছে যাব।
পারুল শান্ত গলায় বলল, পুলিশ এসে আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। হাজতে রাখবে। টর্চার করবে। আমার পেটে একটা বাচ্চা আছে, সেটা কি তার জন্যে ভাল হবে?
তোমাকে টর্চার করবে কেন? তুমি কি করেছ?
আমি কুকুর তিনটাকে দিয়ে ঐ লোকটাকে মারিয়েছি। লোকটা ছিল ভয়ংকর বদ–আমি তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছি।
চিন্তা-ভাবনায় তোমরা মাথা পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে। তোমার যা দরকার তা হচ্ছে প্রচুর ঘুম, প্রচুর বিশ্রাম, নিরিবিলি।
পারুল সহজ গলায় বলল, প্রচুর ঘুম, প্রচুর বিশ্রাম এবং প্রচুর নিরিবিলির জন্যেই ডেডবডিটা কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি বুঝতে পারছ না–আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি–পুলিশের ঝামেলায় এখন আমরা যেতে পারব না। পুলিশ যদি আমাদের কিছু না করে একটা জিনিশ করবে–বাড়ি থেকে বের করে দেবে। দেবে কিনা তুমি বল।
পুলিশ না দিলেও ম্যানেজার সাহেব বের করে দেবেন।
তখন আমি যাব কোথায়? এমন কোন জায়গা কি তোমার আছে যেখানে তুমি আমাকে নিয়ে তুলতে পার? গল্পে উপন্যাসে গাছতলায় সংসার পাতার কথা থাকে। আমরা তো গল্প-উপন্যাসের মানুষ না। ঠিক বলছি?
হুঁ।
আমাকে এখান থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় থাকব? রেলস্টেশনের প্লাটফরমে? হ্যাঁ সেখানে থাকা যায়–একদিন, দুদিন, তিনদিন–ধরলাম সাত দিন–তারপর? আমি তো একা না–আমার ভেতর আরেকজন আছে। তার সমস্যা আমি দেখব না?
তাহেরের মাথা ঝিম ঝিম করছে। কি পরিষ্কার কথাবার্তা নিখুঁত যুক্তি। তাহের অভিভূত হয়ে গেল।
পারুল শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিল। তাকে এখন একজন কিশোরীর মত লাগছে। সে আরো খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, ডেডবড়ি মাটির নিচে পুঁতে ফেললে আমরা অন্তত কিছুদিনের জন্যে নিরাপদে থাকতে পারব। সেই কিছুদিনও তো আমাদের কাছে অনেক দিন।
তাহের চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না, কিছুদিনের জন্যেও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারবে না। ম্যানেজার সাহেব এসে খোঁজ করবেন।
ম্যানেজার সাহেব কামরুলের খোঁজে আসবেন না। তিনি আমার খোঁজে আসবেন। আমাকে পাবেন না। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ফেরত যাবেন।
তোমাকে পাবেন না কেন?
আমাকে পাবেন না–কারণ আমি দোতলার সবচে কোণার ঘরটায় চলে যাব। ওখানেই থাকব। ম্যানেজার সাহেব জানেন দোতলায় ঐ ঘরগুলির চাবী আমার কাছে নেই।
আসলেই তো নেই।
আছে। সব চাবী আমি খুঁজে বের করেছি।
কিন্তু ম্যানেজার সাহেব খন আসবেন তখন তো দারোয়ানের খোঁজও করবেন।
করতে পারেন। তুমি বলবে সে দোকানে কিছু একটা কিনতে গেছে।
তাহের আর কি বলবে ভেবে পেল না। যুক্তি তার মাথায় ভাল আসে না। অন্যের যুক্তিই তার কাছে সব সময় শক্ত যুক্তি বলে মনে হয়। পারুল বলল–আদা দিয়ে আরেকটু চা করি?
না।
খাও না–ঠাণ্ডার মধ্যে ভাল লাগবে। চা খেয়ে বাগানে চলে যাও–গর্তটা গভীর করে করবে। ঘাসের চাপাড়াগুলি আগে খুব সাবধানে আলাদা করে নিও। পরে ঐ ঘাসের চাপড়াগুলি উপরে দিয়ে দেবে। বর্ষাকাল তো, দেখতে দেখতে সুন্দর ঘাস গজিয়ে যাবে।
তাহের আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি কখনো এই কাজ করব না। বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে গোল। কপালে ঘাম জমল।
করবে না?
না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি করবে।
না পারুল, আমি করব না। তোমার জন্যে আমি অনেক কিছুই করব কিন্তু এই কাজটা করব না।
বেশ, তুমি না করলে আমিই করব। কষ্ট হবে–সময় বেশি লাগবে কিন্তু আমি করব।
তুমি নিজে কবর খুঁদবে?
হ্যাঁ। আমি যা বলি তা কিন্তু করি। তুমি অনেকবার তার প্রমাণ পেয়েছ। পাওনি?
তাহের জবাব দিল না। সে সিগারেট টেনে যাচ্ছে–পরপর তিনটি সিগারেট খাওয়ার জন্যেই হয়ত শরীর কেমন কেমন করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। পারুল বলল, তুমি শুধু শুধু জেগে থেকো না। শুয়ে পড়। বিছানায় যাবার আগে একটু শুধু কষ্ট করে যাও। ঐ কোনায় দেখ একটা বড় ডেগচি আছে। ডেগচি ভর্তি করে পানি চুলায় দিয়ে দাও।
পানি দিয়ে কি করবে?।
সব কাজ-টাজ শেষ করে, সারা গায়ে সাবান মেখে গরম পানি দিয়ে গোসল করব। গোসল না করলে শরীর ঘিন ঘিন করবে।
তাহের মূর্তির মত বসে রইল। পারুল হাসিমুখে বলল, মনে হচ্ছে পানিও এনে দেবে না। থাক, আমিই আনব। তুমি শুয়ে পড়। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। ভয়ের কিছু নেই।