অস্থির হব না?
না। আর যদি এসেই পড়ে আমরা গেট খুলব না। সে তো আর দেয়াল টপকে ভেতরে আসবে না। আর যদি এসেই পড়ে তাহলে…
তাহলে কি?
আমার তিন বন্ধু আছে, ওরা মজা দেখাবে।
পারুল হাসছে। হাসতে হাসতে সে মুখে আঁচল দিল। মনে হচ্ছে গড়িয়ে পড়বে। তাহের বলল, এই পারুল, এই!
পারুলের হাসি থামছে না। খিলখিল করে সে হেসেই যাচ্ছে। তাহের পুরোপুরি নিশ্চিত হল পারুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সুস্থ মানুষের হাসি না। কোন সুস্থ মানুষ এই অবস্থায় এমন ভঙ্গিতে হাসে না। বদ্ধ উন্মাদের লক্ষণ। উন্মাদ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এত বড় বাড়িতে একটা ডেডবডি নিয়ে থাকলে যে কেউ উন্মাদ হয়ে যাবে।
পারুল, পারুল।
উঁ।
হাসি থামাও।
শুধু শুধু হাসি থামাব কেন? কেঁদে বুক ভাসাবার মত কিছু হয়নি। আমি হাসি থামাব না।
বলতে বলতেই পারুল হাসি বন্ধ করল। হাসি যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। পারুল সহজ গলায় বলল, রাতে কি খাবে?
কি খাব মানে?
রাতে ভাত তো খাবে। উপোস নিশ্চয়ই দেবে না। তেমন কিছু রাঁধতে পারিনি। আলু ভেজে দি। কড়া করে আলু ভেজে দেব। ভাজা শুকনো মরিচ ডলে আলু ভাজা দিয়ে খেতে খুব মজা। ঘি থাকলে খুব ভাল হত। আলু ভাজার উপর এক চামচ গাওয়া ঘি দিয়ে দিলে খেতে চমৎকার হয়। এমন এক ঘ্রাণ বের হয় যে ঘ্রাণ দিয়েই এক থালা ভাত খাওয়া যায়।
এই সময় তুমি খাওয়ার কথা ভাবছ? অবশ্যই ভাবছি। কেন ভাবব না? মৃত্যুর সঙ্গে খিদের কোন সম্পর্ক নেই। দুটা আলাদা ব্যাপার। আমার মার বেলায় কি হয়েছে শোন–মা মরে গেল ভোররাতে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। চিৎকার করে বিকট কান্না। সারাদিন বাবা কিছু খেল না। দুপুরে আমার বড় খালা তাকে খেতে বলেছে–বাবা দিয়েছে ধমক। রাত আটটার দিকে বাবা নিজেই খেতে চাইল। বাবা ভাত নিয়ে বসেছে–আমাকে দেখে বলল, খুকি, দেখ তো লেবু আছে কি না। আর একটা পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কেটে দিতে বল।
তাহের তাকিয়ে আছে। পারুল গল্প শেষ করে বলল, এই যে গল্পটা বললাম, তার সারমর্ম হচ্ছে–একটু দূরে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে–তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা যথাসময়ে খাওয়া-দাওয়া করব। আরাম করে মুতে যাব। এবং যাতে তোমার যদি অন্য কোন আন্সার থাকে,
পারুল, চুপ করতো।
পারুলের ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। কে জানে, সে হয়ত আবার হাসতে শুরু করবে। পাগলের হাসি একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না।
পারুলের কথাই বোধহয় ঠিক। ক্ষুধার্ত মানুষ মৃত্যু-টৃত্যু নিয়ে ভাবে না। তারা খেতে বসে যায়। রাত দশটার দিকে তাহের খেতে বসল। অনেক ভাত খেয়ে ফেলল। আরো থাকলে আরো খেত। পাতিলে আর ভাত ছিল না। পারুল বলল, তোমার বোধহয় পেট ভরল না।
ভরেছে। পেট ভরেছে। শরীরের খিদে মিটছে–চোখের খিদায় ভাত চেয়েছি।
চট করে একটা পরোটা ভেজে দেব, খাবে?
কি যন্ত্রণা। বললাম না পেট ভরেছে।
তাহের বারান্দায় মোড়ায় বসে সিগারেট টানছে। পারুল থালা বাসন মাজামাজি করছে। তাহের এই মুহূর্তে ভাবতে চাচ্ছে না যে তাদের কাছ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে। আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। শীত শীত লাগছে। এক ঘুমে রাতটা কার করে দিয়ে–সকাল বেলা ভেবে-চিন্তে একটা পথ বের করতে হবে। পথ আর কি–পুলিশকে গিয়ে বলা–কুকর বাড়ির দারোয়ানকে মেরে ফেলেছে।
থানার ওসি জিজ্ঞেস করবেন–কখন মেরেছে? তখন একটু ঘুরিয়ে বলতে হবে–কখন মেরেছে সেটা স্যার বলতে পারি না। আমরা দেখেছি সকালে। দেখেই আপনাকে খবর দিয়েছি।
কুকুর মানুষ মেরে ফেলল, আপনারা কিছুই বলতে পারলেন না?
স্যার, এগুলি ভয়ংকর কুকর। আগেও একটা মানুষ মেরেছে।
বলেন কি?
খাঁটি কথা স্যার। এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমরা স্যার, কুকুরের ভয়ে রাতে ভালমত ঘুমুতেও পারি না।
আমরা বলছেন কেন? আমরা মানে কি? আর কে?
স্যার, আমার স্ত্রী।
আপনার স্ত্রীও কি ঐ বাড়িতে থাকে? তারও তো একটা জবানবন্দি নেয়া দরকার।
তাহের আগের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরাল। ভালমত চিন্তা করতে হবে। পারুলকে কিছুতেই পুলিশের কাছে নেয়া যাবে না। ওর মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলে বসবে। যা বলার পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে। পুলিশ তো আর জানে না–অভাবে অনটনে পারুলের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
পারুল!
উঁ।
চা দাও, একটু চা খাব।
দাঁড়াও, হাতের কাজ সেরে নেই। তুমি তো চা খেতে চাও না, আজ দেখি একেবারে সেধে সেধে খেতে চাচ্ছ।
তাহের জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে পারুলের থালা-বাসন ধোয়া দেখছে। কি সহজ ভঙ্গিতে সে থালা বাসন ধুচ্ছে–আবার গুন গুন করছে। মনে কোন রকম দুঃশ্চিন্তা নেই। না, পারুলকে কিছুতেই পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিতে দেয়া যাবে না। জবানবন্দি দিতে গেলেই উল্টাপাল্টা কিছু বলবে। যা করতে হবে তা হচ্ছে–খুব ভোরবেলা ওকে অন্য কোথাও দিয়ে আসতে হবে। তারপর যেতে হবে পুলিশের কাছে। পুলিশ যখন জিজ্ঞেস করবে–আপনি একাই এ বাড়িতে ছিলেন? তখন বলতে হবে কিছুদিন আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে ছিল–তারপর ম্যানেজার সাহেব আপত্তি করলেন–আমি ওকে নিয়ে গেলাম।
কোথায় নিয়ে গেলেন?
ওর বড় চাচার বাসায়।
সেটা কবে? তারিখ বলুন, সময় বলুন।
এই যে আবার প্যাঁচের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
চা নাও।
তাহের আগ্রহ করে চা হাতে নিল। এখন নিজেকে হালকা লাগছে। সমস্যা সমাধানের পথ পাওয়া না গেলেও পাওয়া যাবে। কিছু মিথ্যা বলতে হবে। তবে খুব গুছিয়ে বলতে হবে। এমন মিথ্যা যেখানে ফাঁক থাকবে না।