কোথায় যাবে।
আজকের রাতটা আপাতত কোন হোটেলে কাটাই, তারপর… পারুল, তোমার কি শরীরটা খারাপ? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।
পারুল ক্ষীণ স্বরে বলল, শরীর একটু খারাপ।
কতবার বলেছি সন্ধ্যাবেলা ঘুমুবে না। সন্ধ্যাবেলা ঘুমানো খুব বেড হেভিট। শরীরের বারোটা বেজে যায়।
তাহের বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুচ্ছে। বাথরুমের দরজা খোলা। পারুল বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুমের বাল্ব নষ্ট বলে বাথরুমটা অন্ধকার। তাহের হাতে-মুখে শনি ঢালতে ঢালতে বলল–তুমি দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করো না। ব্যাগ দুটা চট করে গুছিয়ে নাও। ম্যানেজার ব্যাটা আসার আগেই কেটে পড়তে হবে।
কোন হোটেলে উঠবে, কিছু ঠিক করেছ?
উহুঁ। ওল্ড ঢাকার দিকে মোটামুটি সস্তায় ফ্যামিলি রুম পাওয়া যায়। আর একটা মাত্র রাত।
একটা রাত কাটিয়ে কোথায় যাবে?
এখনও ঠিক করিনি। গামছাটা দাও তো।
পারুল গামছা এনে দিল। খুব সহজ গলায় বলল, ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।
তাহের অবাক হয়ে বলল, কি সমস্যা?
কুকুর তিনটা কামরুলকে মেরে ফেলেছে। ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলেছে।
তাহের বিরক্ত গলায় বলল, সব সময় রসিকতা ফাজলামি ভাল লাগে না। সব কিছুর সময়-অসময় আছে।
পারুল শীতল গলায় বলল, রসিকতা না। সত্যি। বারান্দায় এসে দাঁড়াও। বারান্দায়। দাঁড়ালেই দেখবে। বারান্দা থেকে দেখা যায়।
এইসব তুমি কি বলছ?
যা সত্যি তাই বলছি।
তাহেরের হাত থেকে মগ পড়ে গেল। এইসব সে কি শুনছে? স্বপ্ন দেখছে না তো? মাঝে মাঝে স্বপ্ন বাস্তবের মত হয়।
পারুল বলল, তুমি কি আগে চা খাবে না সরাসরি ভাত দেব?
তাহেবের মাথায় কিছু না। এই সময় কি করে একটা মেয়ে ভাত খাওয়ার কথা বলতে পারে। তাহের বলল, দাও, চা দাও। বলেই সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। আশ্চর্য! সে চা চেয়েছে, সহজভাবেই চেয়েছে। ভয়ংকর দুঃসময়ে মানুষ কি খুব স্বাভাবিক আচরণ করে? তাহেরের মুখ ধোয়া হয়ে গেছে, তারপরে সে অন্ধকার বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে পারুল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নীরবতা ভঙ্গ করার জন্যেই তাহের আবারও বলল, ম্যানেজার সাহেব সন্ধ্যার পর আসবেন। কথাগুলি বলল নিজের কানে নিজের কথা শোনার জন্যে। ম্যানেজার সাহেব যে সন্ধ্যর পর আসবেন এটা তো সে আগেই বলেছে।
পারুল শান্তি গলায় বলল, আসুক। কুকুররা তাকেও খেয়ে ফেলবে।
কি বলছ তুমি!
যা ঘটবে তাই বলছি। এ বাড়ির গেটের ভেতর যেই ঢুকবে তাকেই কুকুররা খেয়ে ফেলবে। তোমাদের বড় সাহেব এলে তাকেও খাবে।
পারুল, তোমার তো পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
হুঁ।
ব্যাপারটা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
বিশ্বাস না হবার কিছু নেই। বারান্দায় এসে দাঁড়াও, আমি বাগানের বাতি জ্বেলে দিচ্ছি। সব দেখা যাবে। তবে না দেখাই ভাল। দেখলে তুমি চা-টা কিছু খেতে পারবে না। বমি করে ফেলবে। আস, বারান্দায় আস।
না থাক।
চা বানাচ্ছি–চা খেতে আস। সারারাত বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকবে?
তাহের বাথরুম থেকে বের হল। তার ডান পাটা পাথরের মত ভারি হয়ে আছে। প টেনে টেনে তাকে আসতে হচ্ছে। এটাও এক আশ্চর্য ব্যাপার। পা ভারি হলে পাই ভাবি হবে। একটা পা ভারি হয়েছে অন্যটা ঠিক আছে এটা কেমন কথা!
শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে স্টোভে। কেতলিতে পানি বিজ বিজ করে ফুটছে। চুলার আগুনের আঁচে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে পারুলকে! কুকুর তিনটি এই সময় গ্রীলের কি দিয়ে মুখ বের করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তা করছে না, তবে মাঝে মাঝে তাদের ক্রুদ্ধ চাপা হুংকার শোনা যাচ্ছে। তাহের নিচু গলায় ডাকল, পারুল!
হুঁ।
তোমার চাচার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে। উনার অফিসে গিয়েছিলাম।
পারুল তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। তাহের ভেবে পেল না। এই সময়ে সে চাচার অফিসে যাবার গল্পটা কি করে বলছে। একটা মানুষ তাদের কাছ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে মরে পড়ে আছে–আর সে চা খেতে খেতে গল্প করছে। মাথা তো পারুলের খারাপ হয়নি। মাথা তার খারাপ হয়েছে।
পারুল!
পারুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, কি?
আমরা এখন কি করব?
চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে পারুল নরম গলায় বলল, তুমি কি করতে চাও?
পুলিশে খবর দেয়া দরকার। কুকুরে মেরে ফেলেছে–আমাদের তো কোন দোষ নেই। আমরা তো মারিনি।
কুকুর তো আর নিজ থেকে মারেনি। সে হচ্ছে কুকুরের সর্দার। কুকুর তাকে শুধু শুধু মারতে যাবে কেন? আমি বলেছি বলেই মেরেছে।
সে কি।
পারুল তার চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, চা খাও। চা তো ঠাণ্ডা হচ্ছে।
চা ঠাণ্ডা হচ্ছে কি না তাহের জানে না, তার নিজের হাত-পা যে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তা সে বুঝতে পারছে। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে পারুল ঠাট্টা করছে? মেয়ের মাঝে মাঝে বাজে ধরনের ঠাট্টা করে। মা-বাপ নেই টাইপ ঠাট্টা।
এ কি, কাপ হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? ঠাণ্ডা হলে আবার গরম করে দেব।
তাহের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। ঠাণ্ডা-গরম কিছুই বোঝা গেল না। তাহের বিড় বিড় করে বলল, সন্ধ্যার পর ম্যানেজার সাহেব আসবেন।
পারুল বলল, উনি আসবেন না। কার দায় পড়েছে ঢাকার বাইরে এত দূর এসে খোঁজ নেবার? তিনি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে এইসব বলেছেন। যাতে তুমি ভয় পেয়ে সুর সুর করে চলে যাও।
উনি খুব কাজের। চলে আসবেন।
আসবেন না। আকাশের অবস্থা ভাল না–ঝড় বৃষ্টি হবে। এই রকম আবহাওয়ায় উত্তরখানের বিরান ভূমিতে কেউ আসবে না। তুমি অস্থির হয়ো না।