পারুল বাথরুমে–তার গায়ে কোন কাপড় নেই। খয়েরি রঙের একটা টাওয়েল দড়ি থেকে ঝুলছে। ইচ্ছা করলেই এই টাওয়েলটা সে তার গায়ে ফেলে খানিকটা আব্রুর ভেতর নিজেকে রাখতে পারে। তা সে করছে না। ইচ্ছে করেই করছে না। নগ্ন শরীরে সে অপেক্ষা করছে–আসুক, কুকুরের সর্দারটা আসুক। মনের সাধ মিটিয়ে তাকে দেখুক। তারপর দেখা যাবে। কেউ আসছে না। এলেই সে টের পাবে। সে তার সমস্ত চেতনা জাগ্রত করে অপেক্ষা করছে। তার সামনে গামলা ভর্তি পানি। পানির গামলায় তার ছায়া পড়েছে। অন্ধকারের ছায়া অলোর ছায়ার চেয়ে আলাদা।
ভক করে তামাকের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগল। কি বিশ্রী, কি উৎকট গন্ধ। লোকটা এসে দাড়িয়েছে। পারুল নিজের মনে হাসল। গামলার পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল। পানিতে তার ছায়াটা লজ্জাবতী গাছের পাতার মত কুকড়ে গেল। পারুল উঠে দাড়াল। সে এখন দরজা খুলে লোকটাকে ধরবে। তার আগে সে কি গানে টাওয়েলটা। জড়াবে না, যেমন আছে তেমনি বেরুবে? যেমন আছে তেমন বেরুলেও ক্ষতি নেই। কেউ দেখছে না–বাড়ির দেয়ালের ভেতর তিনটি ভয়ংকর কুকুর এবং কামরুল নামের লোকটি ছাড়া আর কেউ নেই। কুকুরের চোখে পোশাক নিশ্চয়ই কোন বড় ব্যাপার না। কুকুরের জগৎ হচ্ছে গন্ধের জগৎ। মানুষের গায়ের গন্ধটাই তার কাছে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। আর কামরুল? সে তো তাকে দেখছেই। পারুল দরজা খুলে বের হল। আশ্চর্য! তার লজ্জা লাগছে না, অস্বস্তি লাগছে না–তার কাছে কেমন যেন ঘোরের মত মনে হচ্ছে। কিশোরী বয়সে একবার তার ১০৫ ডিগ্রী জ্বর উঠেছিল, সে সময় সে এক ঘোরের জগতে চলে গিয়েছিল। আশেপাশের সবাইকে তখন কেমন চকচকে লাগছিল যেন সবার গায়ে তেলমাখা। আলো পড়ে তেলমাখা শরীর চকচক ঝকঝক করছে–এখনো তেমন হচ্ছে। পারুল তীক্ষ্ণ ও তীব্র গলায় ডাকল, কামরুল, এই কামরুল।
কামরুল বাথরুমের পেছনে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে মুখ বের করল। পারুলের মনে হল বাথরুমের দেয়ালটা একটা কচ্ছপের খোলস। কামরুলের মাথাটা হচ্ছে কচ্ছপের মাথা। পারুল হেসে ফেলল। সেই হাসিতে কিছু বোধহয় ছিল, ভয় পেয়ে কামরুল দৌড় দিল। সে দৌড়ে বাগান পেরুচ্ছে। ছুটে যাচ্ছে তার নিজের খুপড়ির দিকে। পারুল ডাকল—মিকি, মাইক, ফিবো।
তিনটি কুকুরই বিদ্যুতের মত ছুটে এল। কামরুল তখনো ছুটছে, প্রাণপণে ছুটছে। পারুল কুকুর তিনটির দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, তোরা দেখছিস কি? ঐ বদ লোকটাকে ধর। এক্ষুণি পর। এক্ষুণি। এক্ষুণি।
পারুল তর্জনী দিয়ে কামরুলের দিকে ইঙ্গিত করছে। তার মুখ দিয়ে হিস হিস জাতীয় শব্দ হচ্ছে।
তিনটি কুকুই কামরুলের দিকে ছুটছে। কামরুল দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পেছন ফিরে সে দৃশ্যটা দেখল, তারপর ছুটে যেতে গিয়ে পা পিছলে মাটিতে পড়ে গেল। বাঘ যেমন শিকারের উপর ঝাঁপ দেয় অবিকল সেই ভঙ্গিতে ফিবো কামরুলের পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাকি দুজন ওদের ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে।
পারুল দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।
মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। পারুল তার মাথায় পানি ঢালছে। হিমশীতল পানি–গায়ে ঢালকেই গা জুড়িয়ে যায়। গামলার পানি শেষ হয়ে গেছে–এখন সে। চৌবাচ্চা থেকে পানি নিচ্ছে। চৌবাচ্চার পানি আরও ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে কেউ যেন। বরফের কুচি মিশিয়ে দিয়েছে। বরফের কুচি মেশানো এই হিমশীতল পানিতে গলা। পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। পানির উপর শুয়ে থাকার কোন উপায় যদি থাকত। পাল চৌবাচ্চার ভেতর ঢুকে গেল।
বাড়ির প্রধান গেটটা বন্ধ। তাহের অনেকক্ষণ ধরেই কলিংবেল টিপছে। কেউ দরজা খুলছে না। তাহের প্রথমে ভেবেছিল, কলিংবেল কাজ করছে না–কলিংবেল টিপে সে কান পেতে রইল–এতে একটানা ক্রিইং শব্দ আসছে। গেটে মাঝে মাঝে সে ধাক্কা দিচ্ছে। কোন শব্দ নেই–। মাঝে মাঝে কুকুর তিনটার দ্রুত চলে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কুকুর তিনটা না থাকলে সে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে নেমে যেত। তার ভয়ংকর দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। ছটা থেকে সে গেটে ধাক্কাধাক্কি করছে। এখন বাজছে, সাড়ে ছটা। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। পারুলের কোন বিপদ হয়নি তো! ভয়ংকর কোন বিপদ।
এখন তাহের আর কলিংবেল টিপছে না বা দরজাও পাকাচ্ছে না–ভীত গলায় ভাকছে, কামরুল। কামরুল মিয়া! এই কামরুল!
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে আসছে? কামরুল? তাহের বলল, কে কামরুল? ব্যাপার কি? কি হয়েছে?
কেউ জবাব দিল না। কিন্তু গেট খোলা হচ্ছে। তাহেরের বুকের ধ্বকধ্বকানি এখনও থামছে না। সে আবারও ডাকল, কামরুল! এই কামরুল!
আমি পারুল।
গেট খুলেছে। তাহের বিস্মিত গলায় বলল, কামরুল কোথায়?
আছে কোথাও।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া ঘরের ভেতর থেকে গেটের শব্দ শোনাও যায় না।
ভয় চলে যাওয়ায় তাহেরের এত শান্তি লাগছে! সারাদিন মে মাথাব্যথা ছিল হঠাৎ পাওয়া এই শান্তিতে তাও চলে গেছে। নিজেকে হালকা লাগছে।
তাহের বলল, সন্ধ্যাবেলা ঘুমের যে অভ্যাস করেছ–এটা ঠিক না। স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই খারাপ।
পারুল জবাব দিচ্ছে না। আগে আগে যাচ্ছে, তাহের যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে। তাহের বলল, কামরুল ব্যাটাকে তো দরকার।
কেন?
বাড়ি তার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। আজই যেতে হবে।
কেন?
ম্যানেজার সাহেবের কাছে অবর গেছে আমি এই বাড়িতে সংসার পেতেছি। তিনি অর্ডার দিয়েছেন তোমাকে অন্য কোথাও রেখে আসতে। বলেছেন, সন্ধ্যাবেলা চেক করতে আসবেন। উনি আসার আগেই আমরা চলে যাব। দেরি করা যাবে না। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে।