তাহের ক্যাটিনে ঢুকল। এক কাপ চা খাবে। চা খেলে যদি মাথাধরাটা কমে। পারুল মাথা ধরলেই চা খায়। তার না কি এতে মাথা ধরা কমে।
চা শেষ করেও তাহের বসে রইল। এক হাজার এক বার দোয়া ইউনুসটা পড়তে পারলে কাজ হত। চরম বিপদে এই দোয়া খুব কাজ করে। ইউনুস নবী মাছের পেটে বসে এই দোয়া পড়েছিলেন বলে অক্ষত শরীরে মাছের পেট থেকে বের হতে পেরেছিলেন। সেও বলতে গেলে এখন মাছের পেটের ভেতরই আছে।
পারুলের বড় চাচা অফিসে ছিলেন। তাহের ঘরে ঢুকেই টেবিলের নিচে ঝুঁকে পড়ে তাঁর পা খুঁজে বের করল। টেবিলের নিচ থেকেই বলল, চাচা ভাল আছেন?
আজহার সাহেব উত্তর দিলেন না। গলা টেনে কাশলেন। তাহের টেবিলের নিচ থেকে হাসি মুখে বের হয়ে এল। আবারও জিঞ্জেস করল, চাচা ভাল আছেন?
আজহার সাহেব ঘোঁৎ জাতীয় শব্দ করলেন। তাহের বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম চাচাকে ভাল খবরটা দিয়ে যাই।
আজহার সাহেব চোখ ছোট ছোট করে বললেন, কি ভাল খবর?
তাহের বিপদে পড়ে গেল। কথার টানে সে বলে ফেলেছে চাচাকে ভাল খবরটা দিয়ে যাই। আসলে ভাল খবর কিছু নেই। সবই মন্দ খবর। ভয়ংকর ধরনের খবর।
তাহের ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার পা কাঁপছে। পা কাঁপার কিছু নেই, তবু কাঁপছে। খিদের জন্যে বোধহয়। এখন বাজছে দুটি। সে সকালে নাশতা না খেয়ে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক কাপ চা ছাড়া কিছু খায়নি।
আজহার সাহেব বললেন, বোস।
তাহের বসল। না বসতে বললেও সে বসত। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না।
ভাল খবরটা কি বললে না তো। চাকরি পেয়েছ?
জ্বি।
কি চাকরি?
তাহের রীতিমত ঘামছে। আশ্চর্য কাণ্ড। সে একের পর এক মিথ্যা বলছে কেন? একবার মিথ্যা শুরু করলে অনেকক্ষণ ধরে বলতে হয়। মিথ্যার এই নিয়ম। মিথ্যা হল চাকার মত। একবার চলতে শুরু করলে চলতেই থাকে।
আজহার সাহেব কে এসে বললেন, কি চাকরি?
চা বাগানের চাকরি।
চা বাগানে তো অনেক রকম চাকরি আছে। কুলীর চাকরিও আছে। তোমার পোস্টটা কি?
এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার।
তাহের অবাক হয়ে লক্ষ করল, আজহার সাহেব তার এই মিথ্যা কথাটা বিশ্বাস করেছেন। এতক্ষণ সরু চোখে তাকিয়েছিলেন, এখন চোখের সরু ভাব দূর হয়েছে। সেখানে জমা হয়েছে বিস্ময়।
বেতন কি?
বেতন বেশ ভাল।
চা বাগানের চাকরিতে বেতন তো ভাল হবেই। বিদেশী কোম্পানী, এরা পেটে ভাতে কর্মচারি রাখে না। কোয়ার্টার দিয়েছে?
দি চাচা দিয়েছে। ফার্নিসড্ কোয়ার্টার।
ওদের নিয়মই এরকম। ফ্রী ফানিসড কোয়ার্টার–বেয়ারা বাবুর্চি। গাড়ি দিয়েছে?
ছি না, তবে দিবে বলেছে।
দিবে বলেছে যখন তখন অবশ্যই দেবে। আর এদের বাংলোগুলিও খুবই সুন্দর। ছবির মতন। আমি একবার একটা টি গার্ডেনে দুরাত ছিলাম অপূর্ব। তুমি এই চাকরি জোগাড় করলে কিভাবে?
আমার এক বন্ধুর খালু সাহেবের গার্ডেন…
বুঝেছি রেফারেন্সে চাকরি হয়েছে। এইসব চাকরি এডভাটাইজে হয় না। রেফারেন্সে হয়। তোমার ভাগ্য খুবই ভাল।
জঙ্গলে মন টিকলে হয়।
টিকবে, মন টিকবে। পেট শান্ত থাকলে মন শান্ত থাকবে। তোমার সুসংবাদ শুনে খুশী হয়েছি। তুমি কি খাওয়া-দাওয়া করেছ?
জ্বি না।
খাও, আমার সঙ্গে খাও। আমি টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে আসি। তোমার চাচী দিয়ে দেয়। দুজনের হবে না, কাচ্চি বিরিয়ানী খাবে? এখানে একটা বিহারীর দোকান আছে, ভাল বিরিয়ানী বানায়। আমার বয়স হয়ে গেছে, রিচ ফুড সহ্য হয় না।
আজহার সাহেব বিরিয়ানী আনতে তাঁর বয়কে পাঠালেন। হাফ বিরয়ানী আর একটা ঠাণ্ডা সেভেন আপ। তাহের বসে বসে ঘানতে পাগল। এ কি করছে সে? মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যাচ্ছে। মিথ্যা বলতে একটু গলা পর্যন্ত কাঁপছে না। অভাব-অনটনে তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? অভাবী মানুষরা কি বেশি মিথ্যা বলে?
তাহের।
জ্বি।
পারুল আছে কেমন?
ভাল আছে।
ওকে বাসায় নিয্যে এসো, অনেকদিন দেখি না।
আজই নিয়ে আসব।
আচ্ছা, এসো।
কয়েকদিন থাকুক আপনাদের সঙ্গে।
থাকুক।
বিকেলে নিয়ে আসব। ও আপনাদের দেখতে চাচ্ছে।
আজহার সাহেব টেবিল থেকে ফাইলপত্র সরিয়ে খবরের কাগজ বিছিয়ে দিলেন। নিজেই দুগ্লাস পানি এনে রাখলেন। তাঁর টিফিন ক্যারিয়ার খুললেন। তাহের বলল, আপনি খেতে শুরু করুন চাচা।
একসঙ্গেই খাই। তোমার চা বাগানের নাম কি?
তাহের অতি দ্রুত কোন একটা নাম ভাবতে চেষ্টা করল। নাম মনে আসছে না। মাথার যন্ত্রণাটা হঠাৎ আরও বেড়ে গেল। চোখ পর্যন্ত জ্বালা করছে। চোখে-মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে পারলে ভাল হত। তাহের বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চা বাগানের নাম মনে পড়ছে না চাচা।
আমাদের কোম্পানীর নাম জানতে চাচ্ছি।
কোম্পানীর নামটাও মনে পড়ছে না।
আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকালেন। তাহের ঢোঁক গিলে বলল, আপনাকে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বলেছি চাচা।
আজহার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, মিথ্যা কথা বলেছ?
জ্বি। আমার চাকরি বাকরি এখনো কিছু হয়নি।
আজহার সাহেব তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। তাহের খুক খুক করে কাশল। আজহার সাহেব বললেন, এতগুলি মিথ্যা বললে কেন? কারণটা কি?
তাহের অস্পষ্ট গলায় বলল, জানি না। এম্নি বলে ফেলেছি। চাচা, আমি তাহলে যাই?
আজহার সাহেব কিছু বললেন না। তাহের উঠে পাড়াল। টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ে কদমবুসি করল। আবারও বলল, চাচা যাই। আজহার সাহেব তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বললেন না।
তাহের বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল–যদি আজহার সাহেব তাকে ডাকেন। কাচ্চি বিরিয়ানীর প্যাকেট থেকে আসা গন্ধটা বাতাসে ভাসছে। ক্ষুধার্ত মানুষ খাবারের গন্ধে খুব বিচলিত হয়–বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তাহের দাঁড়িয়ে আছে বোধহীন একজন মানুষের মত। বয়টার হাত থেকে বিরিয়ানীর প্যাকেট এবং সেভেন আপের বোতল নিয়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?